বেশি বন্ধু-বান্ধব রাখা ঠিক হবে না। প্রেম-ভালোবাসায় সাফল্য আসবে। বিবাহযোগ আছে। কর্ম পরিবেশ পরিবর্তন হতে ... বিশদ
বিয়েবাড়ি আসলে পুনর্মিলন! বিয়ের দু’একদিন আগে থেকেই বাড়িতে আত্মীয়স্বজনদের ভিড়। রাতে বাড়ির প্রতিটা ঘরে ঢালাও বিছানা। বাকি বয়স্ক অতিথিদের রাত্রিযাপন পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়িতে। বিয়েটা তো শুধু একটা বাড়ির নয়, গোটা পাড়ার বিয়ে। নেমন্তন্নের তালিকা দীর্ঘ। বিয়ে বলে কথা! বাড়ির কাজের লোকেরা সপরিবারে তো বটেই, তাছাড়া বাড়িতে সম্বৎসর যিনি খবরের কাগজ দিতে আসেন, কিংবা পাড়ার নাইট গার্ড বা জমাদার—নেমন্তন্ন সকলের। বাড়ির উঠোনেই ছাদনাতলা। বাড়ির ছাদে কিংবা পাড়ার ক্লাবের একটুকরো জমিতে প্যান্ডেল করে ‘ভোজসভা’! বাড়ির দরজায় তোরণ, পালকির ছবি দেওয়া। বাড়ির পাশেই পুরসভার জলের গাড়ি দাঁড়াবে এসে। তোরণের অন্য পাশে নহবত বসবে, অথবা নিদেনপক্ষে বিসমিল্লার পাগলা সানাই, কী প্রেম-জাগানিয়া রাগ তার, মারু বেহাগ!
বাড়ির পিছনের জংলাজমিটা ত্রিপল দিয়ে ঘিরে নিয়ে ভিয়েন বসবে, আর তার পাশেই ইট-মাটি দিয়ে তৈরি উনুন, কাঠের আগুন। ওখানেই একটা ছোট টুলে বসে বাড়ির তিন পুরুষের পুরনো রান্নার ঠাকুর বাজারের ফর্দ দেবেন। নিখুঁত, মাপে মাপ, নো নষ্ট, নো অপচয়। রান্নার জায়গার ওপারে একাকী লোডশেডিংয়ের পথ চেয়ে থাকে সবুজ রঙের জেনারেটর। রাত হলে এক দুই বার তার গর্জে ওঠার সম্ভাবনা প্রবল। এবং ‘রজনী এখনও বাকি’। ভিড় থেকে দূরে, আধো অন্ধকারের সুযোগে সেখানে লুকিয়ে সিগারেট ফুঁকতে আসে সদ্য কলেজে ঢোকা পাড়ার বচ্চন-মার্কা ছেলেটা, সবান্ধবে। উচ্চ মাধ্যমিকে স্টার পাওয়া ছেলেটাও আসবে ওখানে, সঙ্গে সেই ভরত নাট্যমের মেয়েটি এবং সেই রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে মাতিয়ে দেওয়া মেয়েটিও! হলেও হতে পারে সেই চিরন্তন ‘দো ফুল এক মালি’-র গপ্পো! অবশ্য বিয়েবাড়ির অন্দরে বড়রাও বসে নেই। ছোটকাকুর তুতো-শালির সঙ্গে মেজোমাসির ছোট দেওরের সম্বন্ধ ‘হব হব’ প্রায়! অবশ্য এ সব ব্যাপারে শেষ কথা বলবে বাড়ির বড়পিসি, যে হেঁশেলে ঠায় বসে বিয়েবাড়ির অন্দরমহল সামলাচ্ছে! এমনকী ঠাকুমা পর্যন্ত যে কোনও দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা ওই বাল্যবিধবা মহিলার এজলাসে ঠেলে দিয়ে বলে, ‘কী রে, তুই কি বলিস’?
বিয়েবাড়িতে মেগা শো অবশ্য রাতে। একদিকে বাসর, অন্যদিকে ভাঁড়ার। ভাণ্ডারি হল বড়জেঠু, এক্কেবারে স্বশাসিত পরিষদ। অনুষ্ঠানের ফুড আর মানুষের মুড, দু’টোই তাঁর নখদর্পণে। মাংসে টান পড়লে কীভাবে বাকি প্রীতিভোজটা টেনে দিতে হবে, প্যান্ডেলে ‘বুথ জ্যাম’ হলে কীভাবে ভিড় ম্যানেজ করতে হবে, খাবারের স্বাদে খানিক ঘাটতি থাকলে কীভাবে আমন্ত্রিতদের মনমেজাজ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে হবে, এই সব বড়জেঠুর ফেভারিট সাবজেক্ট। তার আর একটা স্কিল হল পরিবেশনের লোক বাছাই। ওই টিমে ঢুকতে গেলে বড়জেঠুর কাছে অডিশন দিতে হবে। এই পরিবেশনের লোকরা নিমন্ত্রিতদের মুখ দেখে বলে দেবে কে ডাঁটিওয়ালা বেগুনভাজা খানিক বেশি সাঁটাবে, কার পাতে হাফ বালতি রসগোল্লা ঢেলে দিতে হবে, কে জলকাটা দই দেখলে খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়বে, কে দইমিষ্টি সাবাড় করে ফের সুক্তোতে ফিরবে, কে গেলাসে জলের বদলে সোনামুগের ডাল নেবে! ফুড শো’র সূচনা করে অবশ্য খুদে বাহিনী, কলাপাতায় নুন-লেবু আর মাটির গ্লাসে জল দিয়ে, তারপর তারা ম্যাচ ছেড়ে দেবে বড়দের হাতে। ফুড সেশনের মাঝখানে অবশ্য আর একবার জল ‘রিপিট’ হয়। শেষ দৃশ্যে ‘খোকাবাবুদের প্রত্যাবর্তন’! এবার সোনালি ট্রেতে রুপোলি রাংতায় মোড়া পান।
শেষ ব্যাচের খাওয়া হয়ে গেলে পরিবেশনের লোকরা কোমরে জড়ানো গামছা খুলে কাঁধে ঝুলিয়ে দল বেঁধে যাবে স্নান করতে। তারপর ওরা খেতে বসবে একসঙ্গে। তাদের ব্যাচ তদারকি করবে ভাণ্ডারি আর মালবাবু। আর এই দুই জনকে পরিবেশন করে খাওয়াবে রান্নার ঠাকুর স্বয়ং। উনি তাদের জন্য একটা স্পেশ্যাল মেশানো তরকারি রেঁধেছেন। সাদা ভাতের ওপর সেই তরকারি ঢেলে দিয়ে ঠাকুর শুধোবেন, ‘জমেছে, দাদাবাবুরা?’ পাতের সেই মেশানো তরকারি টেস্ট করে যেই দাদাবাবুরা ‘হ্যাঁ’ বলবে, অমনি ঠাকুরের উনুনের আঁচে ঝলসে যাওয়া কালচে মুখে লক্ষ চাঁদের কিরণ ছড়িয়ে পড়বে!
তা এই সব হল সেই সুপ্রাচীন অ্যালবামে জমে থাকা কিছু সিপিয়া রঙের গল্প। সেই সব দিন আর নেই গো বাবুমশাইরা। এখন নেমন্তন্ন বলতে ‘ই-ভাইট’! বিয়েটা এখন একটা ইভেন্ট। ডাক পড়ে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের লোকেদের। অনিবার্য কারণে তা যদি নাই-ই বা জোটে, তাহলে নিদেনপক্ষে কেটারিং তো আছেই। এখন প্রেমের জন্য বিয়েবাড়ি দরকার হয় না, প্রথম সিগারেটের জন্য দরকার হয় না আধো অন্ধকার। এখনকার বিয়েবাড়িতে বড়পিসি, বড়জেঠু, পিসামশাই, মেসোমশাইরা কর্মহীন। এখন তাঁরা ছাদনাতলার এককোণে জবুথবু হয়ে বসে টিভি সিরিয়ালের মতো করে বিয়ে দেখেন। আমন্ত্রিতরা সব এখন ক্ষণিকের অতিথি। আসলে বিয়েটাই তো এখন এক রাতের মামলা। আশ্চর্য, সেই প্রজাপতিরা সব কোথায় গেল? আর সেই পালকির ছবি! বিয়ে এখনও আছে, কিন্তু সেই বিয়েবাড়ি আর নেই। ‘একান্নবর্তী পরিবার’ আর ‘আমাদের পাড়া’-র মতো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সেই সব ‘বিয়েবাড়ি’! অবশ্য বিয়েবাড়ির আর দোষ কী! মানুষের জীবনটাই তো এখন ‘সোনার পাথরবাটি’!
শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়