গুরুজনের চিকিৎসায় বহু ব্যয়। ক্রোধ দমন করা উচিত। নানাভাবে অর্থ আগমনের সুযোগ। সহকর্মীদের সঙ্গে ঝগড়ায় ... বিশদ
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় অনেক নতুন কিছুর মতোই চিনতে শিখলাম যাঁর লেখা, তিনিই নবনীতা দেবসেন। একটু দেরিতেই ঘটল ঘটনাটা। সে যাই হোক, আমার এক বন্ধুর মুখে শুনলাম ওঁর একটি কবিতা। সম্ভবত কবিতাটি কুয়ো এবং একটি মেয়ে সংক্রান্ত। কবিতাটি ভালো লেগেছিল খুব। আর তারপরেই পড়লাম ওঁর একটি ভ্রমণকাহিনী ‘করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে।’ তবে সেক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাটা শুধুমাত্র আনন্দের হল না। একটা বেদনাও কাঁটার মতো মাথা তুলে দাঁড়াল প্রায় একইসঙ্গে। সেটি হল, কুম্ভমেলা দর্শন আমার ভাগ্যে তখনও ঘটেনি আর আদৌ কখনও ঘটার সম্ভাবনা যে বড় কম।
তারপরে ওঁর আরও অনেক লেখা পড়লাম। মাঝে মাঝে এই প্রশ্নটা মনে আসে। একজন লেখককে একজন পাঠক কীভাবে চিনে নেয়? আমি অন্তত পাঠক হিসেবে বুঝি, একটি পাঠের অভিজ্ঞতাই সেক্ষেত্রে যথেষ্ট হয়ে উঠতে পারে। একবার পড়লেই, যদি কোনও লেখা মনের দরজা, জানলা খুলে সটান ভেতরে ঢুকে পড়ে, তখন তাঁর জন্য আসন না পেতে কোনও উপায় থাকে কি?
এর অনেক পরে একটু-আধটু লিখতে এসে বিষয়টা অন্য চোখে দেখতে শুরু করলাম। এখন তো শেখার তাগিদ আছে। মানে একজন বড় মাপের লেখক কীভাবে চলছেন, দাঁড়াচ্ছেন, মাঝেমাঝে দু-একটা ছোটখাট ধাক্কায় সচেতন করছেন, সবটাই তো নজর করে দেখতে হয়। দেখা এবং গ্রহণ করার সেই পর্বে বারবার মনে হয়েছে এবং এখনও একই কথা মনে হয়, ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে।’ এর পেছনে অবশ্যই বেশ হিসাব-নিকাশ আছে।
এই ক’দিন ‘নবনীতা’ বইয়ের গল্পগুলো আবার পড়লাম। কিছুদিন আগে ‘মা দুর্গা আর তার ছেলেপুলে’ সংক্রান্ত একটি ছোটদের গল্পও পড়েছি। এইসব গল্পে মন ভালো হয়। খারাপ হয়ে থাকা মনের শুশ্রূষার জন্য যেমন কাজে লাগে গান, ঠিক তেমনি এই গল্পেরা মগজের মধ্যে জমে থাকা দূষিত ভাবনাগুলোকে নিমেষে ভাগিয়ে দিয়ে নিজের জায়গা করে নেয়।
আবার ফিরি লেখার কথায়। ওঁর গল্পের ঘোরাফেরা, দাঁড়ানো লক্ষ করতে করতে আমার কেমন যেন ঘুড়ি ওড়ানোর কথা মনে হয়েছিল। সময়মতো লাটাই থেকে সুতো ছাড়া হচ্ছে, ঘুড়িটা উড়ছে, ঠিকমতো প্যাঁচ খেলে আবার নামছে মাটিতে। আকাশে তার পাখনা মেলার পেছনে বসে আছেন এক নিপুণ খেলোয়াড়। তিনি সারাক্ষণ সুতো টানছেন আর সুতো ছাড়ছেন। তবু কোথাও জট পাকাচ্ছে না। গল্পে কোথায় রসের ফল্গু বইবে, সব যেন স্থির হয়ে আছে। প্রতিটি হিসাব ঠিকঠাক। আর দর্জির ফিতেতেও কোনও ভুলচুক নেই। অতিরিক্ত কথা নেই। রসিকতার মাত্রাটিও এমনই যা কখনওই সভ্যতার বেড়া টপকায় না। অথচ পড়ে হাসতেই হবে। হাসি থামবেও না খুব সহজে।
বাংলা সাহিত্যে লেখকের অভাব নেই কোনওকালেই। আগেও অনেকে লিখতেন। এখনও লেখেন। আমি যা পড়েছি, সেইসব আগেকার লেখায় ছোট ছোট কৌতুক থাকত। যাঁরা হাসির গল্পে পারদর্শী তাঁরা ছাড়াও অন্য লেখকদের টানা গদ্যের ফাঁকে ফাঁকে থাকত অমলিন হাসির ছোঁয়া। বড় উপন্যাসের দুরন্ত জটিলতার মধ্যে সেইসব কৌতুকেরা ছিল রঙিন ওড়নায় ঢাকা নববধূর মুখের মতোই আকর্ষণীয়।
এখন এসব কমেই এসেছে। যেভাবে শ্রীমতী দেবসেনের প্রতিটি লেখায় মিশে থাকা অনাবিল রসবোধ, সেরকমটা খুব কমই পাওয়া যায় না কি? কিন্তু গল্পগুলো আবার শুধুমাত্র হাসির গল্প নয়। কিছু অকৃত্রিম স্বীকারোক্তি, কিছু চেনা অথচ অচেনা অভিজ্ঞতার ছবি, আর এক সোজাসাপ্টা জীবন দর্পণ। মনোরঞ্জনের জন্য এখনকার লেখায় যে সবের আমদানি ঘটছে, এইসব গল্পে সে সবের প্রয়োজন পড়েনি কোথাও। ব্যঙ্গ আছে। তীব্র শ্লেষে বিদ্ধ করা আছে। তবু আমাদের প্রাচ্য জীবন দর্শনের গোড়ার কথাটাও কোথায় যেন আছে। লুচি খাওয়ার সময় ময়দায় মেশানো ময়ানটা যেমন নজরে আসে না ঠিক তেমন করেই চিনির রসের নীচে থিতিয়ে পড়া চিনিটাও বুঝতে পারা যায় বইকি। আর এরকম পাকা রাঁধুনির রান্না খেতে খেতে আমার মতো কাঁচা রাঁধুনিদের বারবার একই কথা মনে হয়। আহা! এরকম দু-একটি পদ যদি শিখে নেওয়া যেত!