কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির সূচনা। ব্যবসায়ীদের উন্নতির আশা রয়েছে। বিদ্যার্থীদের সাফল্যযোগ আছে। আত্মীয়দের সঙ্গে মনোমালিন্য দেখা দেবে। ... বিশদ
কিন্তু কেন এত খুশি ছিলেন বিচারপতি? কী এমন প্রশংসনীয় কাজ করেছিলেন শর্বরীদেবী?
দিল্লির বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে তিনি এই রাজ্য থেকে পাচার হয়ে যাওয়া আমিনা খাতুন (নাম পরিবর্তিত)-কে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিলেন। ধরে ফেলেছিলেন মাফিয়াচক্রের পান্ডাকে। শুধু ওই ঘটনাটিই নয়, শর্বরীর সাফল্যের ঝুড়িতে আছে আরও অনেক দুঃসাহসিক অভিযান। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হিঙ্গলগঞ্জের মেয়ে রানি (নাম পরিবর্তিত)-র মৃত্যুর কিনারা করা। উত্তরপ্রদেশের বুন্দেল শহরের যোগরাজ সিং পাচার হয়ে আসা ওই মেয়েটিকে বিয়ে করে নিয়ে যান নিজের গ্রামে। কিছুদিন পর থেকেই নিখোঁজ হয়ে যায় মেয়েটি। বহু তল্লাশি করেও তাঁর হদিশ পায়নি পুলিস। এ রাজ্যের পুলিস তাঁকে মৃত ধরে নিয়েই চার্জশিট দিয়ে দেয়। গুটিয়ে ফেলে যাবতীয় তদন্ত। তার বছর তিনেক বাদে যে কোনও ভাবেই হোক মৃত ওই তরুণীর হতভাগ্য বাবা কোর্ট চত্বরে প্রধান বিচারপতিকে নাগালে পেয়ে তাঁর পা জড়িয়ে ধরেন। আবেদন করেন কন্যাকে খুঁজে বার করার জন্য নতুন করে নির্দেশ দেওয়ার।
এই আবেদনে সাড়া দিয়েছিল প্রধান বিচারপতির কোর্ট। নির্দেশ দেওয়া হয় পুনরায় কেসটির তদন্ত শুরু করার। দায়িত্ব পান শর্বরী ভট্টাচার্য। ঘটনার তদন্তকারী পুলিস অফিসার সেদিন শর্বরীকে বলেছিলেন, এই কেসটিতে নতুন করে প্রাণসঞ্চার করা কঠিন। কেসের মেরিট খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিন্তু হতোদ্যম হননি শর্বরী। তিনি সিআইডি’র টিম নিয়ে সোজা হানা দেন যুবরাজের তল্লাটে। স্থানীয় পুলিস প্রথমদিকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেনি। মেয়েটির নিখোঁজ হওয়ার কথা স্বীকার করলেও, ঘটনার সুলুক সন্ধান দিতে প্রয়োজন অনুযায়ী মুখ খোলেননি প্রতিবেশীরা। যোগরাজ সিংকে ধরতে না পারলেও তুলে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর দুই আত্মীয় উত্তম সিং ও মহারাজ সিংকে। যাঁরা দু’জন মূল অভিযুক্ত না হলেও ছিলেন, ওই অভিযুক্তের শাগরেদ।
ঘটনার অনুপুঙ্খ বিবরণসহ যাবতীয় কেস হিস্ট্রি শর্বরী ও তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ প্রধান বিচারপতির কাছে দাখিল করলে, তিনি বুঝে যান শর্বরী নিরুপায়, তাঁকে আরও বেশি প্রশাসনিক সহায়তা না দিলে এই কেসের মূল অপরাধীকে অন্য রাজ্য থেকে ধরে আনা অসম্ভব। তাই বিচারপতি এই রাজ্যের পুলিসের তখনকার ডিজি-র মাধ্যমে উত্তরপ্রদেশের ডিজি’র কাছে নির্দেশ পাঠান কলকাতা হাইকোর্টে উত্তরপ্রদেশের পুলিসের প্রতিনিধিকে হাজির হয়ে কারণ দর্শাতে হবে, কেন পশ্চিমবঙ্গের সিআইডি অফিসারদের সঙ্গে যোগরাজকে গ্রেপ্তার করার বিষয়ে অসহযোগিতা করল, তাঁর রাজ্যের পুলিস। নির্দেশ পেয়ে কলকাতায় এসে কোর্টের কাছে সেদিন যোগরাজ সিংকে ধরার জন্য পূর্ণ সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হয়েছিল উত্তরপ্রদেশ পুলিস।
এরপর শর্বরী এবং তাঁর দলবল দ্বিতীয়বার ম্যাসিভ রেড করল যোগরাজের ডেরায়। ধরা পড়ল মূল অভিযুক্ত। তাঁকে নিয়ে আসা হল কলকাতায়। চলল ম্যারাথন জেরা। স্বীকারোক্তি মিলল। কিন্তু অপরাধ প্রমাণে তা যথেষ্ট ছিল না। তল্লাশি চালিয়ে শর্বরী যোগরাজের বাড়ির কাছের পুকুরে পেয়েছিলেন দু’টুকরো হাড়। যে হাড়কে অনেকে প্রথমে পশুর হাড় বলে চিহ্নিত করেছিলেন। এগিয়ে এলেন পিজি হাসপাতালের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কোহালি। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় তিনি প্রমাণ করলেন হাড়টি মানব শরীরের। হাড়টির বয়স নির্ধারণ, হাড়টি যে ফিমেল বোন অর্থাৎ মহিলা শরীরের তার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণও জোগাড় করে দিলেন ওই বিশেষজ্ঞ, সিআইডি’র তৎকালীন এই ইনস্পেক্টরকে। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হন যোগরাজ। যাবজ্জীবন হয় তাঁর। এই পুরো প্রক্রিয়ায় শর্বরীর ভূমিকাতে সেদিন খুশি হয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি।
আর শর্বরীর প্রতিক্রিয়া দু’রকমের। তিনি বলেন, শুধু পুলিস একা কোনও কেসের ফয়সালা করতে পারে না, তার জন্য চাই বিচারবিভাগ, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ সহ প্রশাসনিক পরিকাঠামোর সকলের সহযোগিতা। অন্যদিকে, যোগরাজকে জেরা করতে গিয়ে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সামনাসামনি হয়েছিলেন এই ইনস্পেক্টর। অপরাধ নিয়ে অভিযুক্তের কোনও হেলদোল ছিল না। বরং সেই বিষয়ে নির্বিকার ওই অপরাধী অনেক বেশি বিচলিত ছিলেন একজন মহিলা অফিসারের হাতে ধরা পড়ায়। রানি ছিল তার কাছে একজন ‘খরিদি হুয়ি চিজ’। টাকা দিয়ে কিনে আনা একটি বস্তু। আর জেরা করছেন যিনি সেই শর্বরী একজন ‘আউরত’। মহিলাদের সম্পর্কে এমন ধারণা খুবই নাড়া দিয়েছিল শর্বরীকে।
পরিবারের কেউ কোনওদিন পুলিসে চাকরি করেননি। বেহালা সরশুনা গার্লস হাইস্কুল এবং স্কটিশ চার্চ কলেজের প্রাক্তনী সেই মেয়েটিই পড়াশোনা শেষ করে সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়ে যোগ দিলেন পুলিসে।
প্রথমে ১৯৮৯ সালে ব্যারাকপুরে ট্রেনিং। সেই সময় ঘোড়ায় চড়া, বাইক চালানো, রাইফেল-পিস্তল চালনা, ড্রাইভিং, সুইমিং সবকিছুই শিখতে হয়েছিল। প্রথম পোস্টিং ১৯৯০ সালে মালদা জেলা পুলিসে। তারপর ইংলিশ বাজার থানা। মালদা জেলা তার আগে ‘মহিলা পুলিস’ দেখেনি। অনেক প্রতিকূলতা এসেছে। সিআইডি-তে আসেন ২০০৯ সালে। মাঝে কিছুদিন চন্দননগরের এসিপি পদের দায়িত্ব সামলে বর্তমানে ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের জয়েন্ট অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর পদে কর্মরত শর্বরী ভট্টাচার্য।
তবে শর্বরীর সর্বাধিক সাফল্য সিআইডি-র অ্যান্টি হিউম্যান ট্রাফিকিং ইনস্পেক্টর হিসাবে। পাচার কাণ্ডের বহু মাফিয়াকে তিনি পাকড়াও করে পাঠিয়েছেন গরাদের ভিতরে। কর্মকৃতিত্বের জন্য জুটেছে পুরস্কারও। বর্তমান সরকার তাঁকে দিয়েছে ‘বেস্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার’-এর পুরস্কার। মুখোমুখি হয়ে জানতে চেয়েছিলাম একজন গোয়েন্দা হিসাবে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে তিনি ভাবিত কি না। উত্তরে সেদিন নিজের দপ্তরে বসে ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন যাবতীয় ভয়ডরকে। বললেন, আমার কাজকে কনফিডেনশিয়াল বা গোপনীয়তার আড়ালে ঢেকে রাখতে আমি চাই না। বরং পাচারকাণ্ডে সূত্র, সম্ভাবনা ও ভয়াবহতা এবং তার বিরুদ্ধে আমাদের যাবতীয় প্রতিরোধ সম্বন্ধে মিডিয়া মারফত মানুষের সচেতনতা যত বাড়বে ততই কমবে এই সমস্যা।
উড়ান সিরিয়ালের আইপিএস অফিসারের চরিত্র তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। পরে হিন্দি ছবি লজ্জা ভাবিয়েছিল সমাজে মেয়েদের অবস্থান সম্পর্কে। তাছাড়াও বিপদে মানুষকে সাহায্যের মানসিকতা তাঁকে টেনে এনেছিল পুলিসের চাকরিতে।
দুই সন্তানের জননী শর্বরী ভট্টাচার্য নিজের উজ্জ্বল কেরিয়ারে সাহস আর জেদকে সঙ্গী করে আক্ষরিক অর্থেই রাজ্য পুলিসের একজন শক্তিরূপিণী বিজয়িনী।