গুরুজনের চিকিৎসায় বহু ব্যয়। ক্রোধ দমন করা উচিত। নানাভাবে অর্থ আগমনের সুযোগ। সহকর্মীদের সঙ্গে ঝগড়ায় ... বিশদ
ঘটনা দুই: প্রায়শই মউ শাশুড়ির কাছে মুখঝামটা শোনে গলায় কিছু না পরার জন্য। মউরা দুই জা। মউয়ের ছেলে আর জায়ের মেয়ে। জায়ের মেয়ে হবার পর থেকেই জায়ের কদর কমেছে। মউকে নিয়ে শাশুড়ির আদিখ্যেতার অন্ত নেই। গলায় হার না পরলে ‘ছেলের মায়ের গলা খালি রাখতে নেই। পুত্র সন্তান বংশের প্রদীপ।...’ এদিকে জায়ের হতাশাগ্রস্ত মুখ দেখলে ভীষণ অসহায় লাগে মউয়ের।
উপরে উল্লিখিত ঘটনাগুলো কিন্তু অজ পাড়াগেঁয়ে পরিবেশের নয়। একেবারে খাস শহরের আধুনিক পরিবারের গল্প। ভাবতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। যুগ যুগ ধরে কন্যা অপেক্ষা পুত্র শ্রেষ্ঠ, এই ধারণা নিয়ে চলছে আমাদের সমাজ। মঙ্গল কামনা, রীতি, রেওয়াজ সব ছেলেকে ঘিরে। শিবরাত্রি, ভাইফোঁটা সবেতেই পুরুষতন্ত্রের জয়জয়কার। আজকের দিনেও লিঙ্গবৈষম্যের ধারণা ও অবিচল সংস্কার এবং বিশ্বাস আমাদের সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হয়ে আছে।
চাঁদে মানুষ-এর অস্তিত্ব খোঁজা ও বসবাস করার অভিপ্রায় যখন বিজ্ঞানের অগ্রগতি চূড়ান্ত পর্যায়ে আসীন, বৈপ্লবিক সব আবিষ্কার পৃথিবীর বুকে ঘটে চলেছে, তখনও লিঙ্গবৈষম্যের ধারণা থেকে বেরতে পারেনি মানুষ! আজও ছেলে মানে সোনার আংটি। বংশের তিলক। ছেলে মানে পরম্পরার ধারক ও বাহক। ভরসার কাঁধ। আর মেয়ে মানে পরের ঘরের জিনিস, দানের সামগ্রী। এ কথা বললে অত্যুক্তি হয় না যে, কন্যার জন্মের বিপক্ষে থাকা অথবা নারীর যে কোনও স্বাধীনতায় বিরক্ত হওয়া ও তাকে পণ্যযোগ্য ভাবার পক্ষে থাকা নারীরাই পুরুষতন্ত্রের এক শক্তিশালী অস্ত্র। সেই শাণিত অস্ত্রেই নারী সত্তা বধ হয়ে আসছে যুগ যুগান্তর ধরে।
কন্যাসন্তান নিয়ে বিভেদের মনোভাব সর্বত্র। শুরুটা বোধহয় সাধ খাওয়ার দিন থেকেই। বাড়ির গুরুজন স্থানীয় মহিলাদের দেহের গড়ন দেখে ভবিষ্যৎবাণী। সেখানে ছেলে হবে এমন আশ্বাসবাণী থাকলে বাড়িতে খুশির খাওয়া অন্যথায় মুখ কালো। তারপর এল নার্সিংহোম। সমাজের সব স্তরে এক মনোভাব। হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে অ্যাটেনডেন্ট বার বার প্রসবের পরে ব্যথা যন্ত্রণায় আচ্ছন্ন নারীকে শিশুসন্তানকে দেখিয়ে প্রশ্ন করেন— ‘বলুন তো কী হয়েছে? ম্যাডাম খুশি তো?’ অথবা ‘কষ্টের সন্তান যা হয়েছে তাই ভালো। মেনে নিন।’
আসুন জেনে নেওয়া যাক এ বিষয়ে সমাজতত্ত্ববিদদের মতামত। সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক উজ্জ্বলকুমার দাসের কথায়— যেহেতু পুরুষরা ক্ষমতার পরিবৃত্তে ক্ষমতার অবস্থানকে ধরে রেখেছে তাই আমরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বলে থাকি। তবে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বৈষম্য জাতিভেদ, শ্রেণী এবং বর্ণতেও বিদ্যমান। এই সবের মূলে ক্ষমতাতন্ত্র। যে সমস্ত প্রথা, রীতি, নীতি তৈরি হয়েছিল তার সঠিক কারণ আমরা কেউ জানি না। এই সমস্ত কিছুরই দুটো দিক আছে। একটা অন্তর্নিহিত। একটা প্রকাশ্য। এই রীতি রেওয়াজ বা প্রথা কিছুটা মিথের ওপর নির্ভর করে চলে। ঠিক-বেঠিক না ভেবেই। এটা একটা দিক। তবে এ বিষয়ে আরও একটা কথা বলার— সামাজিক মানুষ যখন পুরুষতন্ত্রের মুখপত্র হিসেবে ক্ষমতার বৃত্তে অবস্থান করে, তখন কতটা ক্ষমতার অধিকারী বা অধিকারিণী সেটা জাহির করার জন্যই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। একজন শিক্ষিত মহিলা যখন জানেন এই বিশ্বায়নের যুগে নারী এবং পুরুষে বিশেষ প্রভেদ নেই, তবু এমন বৈষম্যমূলক কথা বলেন তখন ধরে নিতে হবে তিনি পুরুষতান্ত্রিকতার শিকার। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা বুঝতে সুবিধা হবে। সার্কাসে জোকার যখন কস্টিউম পরে হেসে খেলা দেখায় তখন সবাই হাসি, মজা উপভোগ করে। কিন্তু কস্টিউমের আড়ালে লুকিয়ে থাকে অব্যক্ত যন্ত্রণা।
এই মুখোশের জোকারের মতোই আমাদের রীতি ও প্রথাগুলো। এগুলো আসল বিষয়টাকে দূরে সরিয়ে রাখে। আমাদের কখনওই মনে থাকে না যে ভাইফোঁটা, নীলের উপাস বা শিবরাত্রির নিয়ম, কন্যাসন্তান পুত্রের বিভেদ বা প্রথা আদতে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোকে জেনে বুঝেও ধরে রেখেছে।
এ তো গেল সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গি। এবার জেনে নেওয়া যাক সমাজের নানা শ্রেণীর মহিলারা কী বলছেন এ নিয়ে— উত্তর কলকাতার শ্যামবাজার নিবাসী সাতাত্তর বছর বয়েসি প্রবীণা ছবি ব্যানার্জির কথায়, ‘আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগে আমার প্রথম মেয়ে হওয়ায় শাশুড়ি অত্যন্ত অখুশি হয়েছিলেন। শাশুড়ির তিন ছেলে, এক মেয়ে, তবু পক্ষপাতিত্ব ছেলেদের ওপর। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার কন্যাসন্তান নিয়ে কোনও আক্ষেপ সে যুগেও ছিল না। আজও নেই। নীলের ব্রত করতে গিয়ে দু’জনের জন্যই মঙ্গলকামনা জানাই। একজন মায়ের কাছে সব সন্তানই সমান আদরের বলে আমি মনে করি।
দমদমের মনুজেন্দ্র দত্ত রোডের বাসিন্দা আল্পনা দত্তের মেয়ে-জামাই, পুত্র-পুত্রবধূ, নাতনি ও স্বামী নিয়ে ভরপুর সংসার। তিনি বললেন, আমি এমন একটা পরিবারের গৃহিণী হিসেবে রয়েছি সেখানে ছেলে-মেয়ের বিভেদ একেবারেই নেই। বরং বিয়ের পর আমার এবং অন্যান্য বউদের ঘটা করে জন্মদিন পালন হতে দেখেছি। আমার দিদিশাশুড়ির সাতবছর বয়েসে বিয়ে হয়েছিল। উনি ছিলেন সারদা মায়ের পালিতা কন্যা। আমাদের দত্ত বাড়িতে তাঁকে মেসে রেখে পড়াশোনা শেখানো হয়েছিল। সুতরাং এই পরিবেশে আমার নিজের মেয়েকে অন্যভাবে দেখার প্রশ্নই নেই। বরং আমি বরাবর আপ্রাণ চেষ্টা করেছি মেয়েকে এবং ছেলের বউকে উপযুক্ত স্বাধীনতা দেওয়ার। আমার মেয়ে তো একাই একশো।
সব শেষে একেটা কথাই বলার, ছেলে না মেয়ে সেই কথা চিন্তা না করে বরং সন্তান হিসেবে তাদের দেখুন। তাহলে বৈষম্যের মনোভাব অচিরেই বিনষ্ট হবে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বয়ে আনা বিধান আর টিকবে না। এমন দিনের আশাতেই বুক বাঁধে নারী।