উচ্চতর বিদ্যায় আগ্রহ বাড়বে। মনোমতো বিষয় নিয়ে পঠন-পাঠন হবে। ব্যবসা স্থান শুভ। পৈতৃক ব্যবসায় যুক্ত ... বিশদ
দমদম মেট্রো রেল স্টেশনের কাছে সেন্টার সিঁথি রোড নিবাসী তানিয়া সান্যালকে এই চ্যালেঞ্জটাই খুব নাড়া দিয়েছিল। জীবনকে বাজি রেখে জীবন রক্ষার এই যুদ্ধে তাই শামিল হতে চেয়েছিলেন তিনি। বলছিলেন বছর ২৭-এর তানিয়া।
উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে ২০১৫ সালে স্নাতকোত্তর সম্পূর্ণ করার পর তৈরি হচ্ছিলেন সরকারি চাকরির পরীক্ষার জন্য। তখনই নজরে আসে বিজ্ঞাপনটি। ২০১৭ সালে ‘জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ইন ফায়ার সার্ভিস’ পদে লোক চেয়েছিল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। চাকরিটা বেশ অন্যরকম ভেবে চোখ বন্ধ করে অ্যাপ্লাই করেছিলেন তানিয়া। তারপর? পিছনে ফিরে আর তাকাতে হয়নি। একের পর এক হার্ডল পেরিয়ে এখন তিনি বিমানবন্দরের কাছে নারায়ণপুরের ‘কলকাতা এয়ারপোর্ট ফায়ার ট্রেনিং সেন্টার’-এর একজন প্রশিক্ষক। এবং শুধু কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের নয়, গোটা দেশের প্রথম মহিলা বৈমানিক অগ্নি নির্বাপণকারী। একটু অন্যধরনের পেশার প্রতি তাঁর আকর্ষণ বরাবরই ছিল।
আগামী দিনের হবু অগ্নি যোদ্ধাদের প্রস্তুত করার দায়িত্ব এখন এই বঙ্গকন্যার উপরেই ন্যস্ত।
ভুবনেশ্বরের আর্মি ব্যারাকে ট্রেনিং নেওয়ার সময় ল্যাডার ক্লাইম্বিং, রোপ ক্লাইম্বিং করতে হতো। পিঠে ৪০ কেজি ওজন চাপিয়ে দৌড়তে হতো ৫০ মিটার। আবার ১০০ মিটার অতিক্রম করতে হতো ২০ সেকেন্ডে। ড্রাইভিং প্রশিক্ষণে চালাতে হয়েছে বাসের মতো হেভি ভেহিকেলস। প্রতিদিন সাড়ে তিন ঘণ্টার গ্রাউন্ড অ্যাকটিভিটির ট্রেনিংয়ের নানা শারীরিক কসরত ছাড়াও ছিল থিওরিটিকাল ক্লাস। যেখানে শিখতে হতো টেকনিকের নানা খুঁটিনাটি। হোসপাইপের নজল দিয়ে জেটগতিতে বেরিয়ে আসা জলের গতি ঠিক রাখা বা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফোম ছড়ানোর কৌশল আয়ত্ত করা ছিল ওই টেকনিক শিক্ষার অন্তর্গত।
তানিয়া বলছিলেন, ২০১৮ সালের জুলাই মাসে দিল্লি থেকে সাড়ে চার মাসের ফাইনাল ট্রেনিং শেষ করার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাকে জানান যে, আমিই একমাত্র এবং প্রথম মহিলা এই পেশাতে। প্রথমে রোমাঞ্চিত হই। কারণ আমার আইডল যিনি সেই কিরণ বেদীও ছিলেন তাঁর পেশায় প্রথম মহিলা। তাঁর মতোই কর্মজীবনে ঝুঁকি নেব বলেই আমারও আসা এই পেশাতে। প্রায় দেড় বছর যাবৎ আমি কলকাতার ট্রেনিং সেন্টারে জুনিয়র অ্যাসিস্টেন্ট হিসাবে এখন কর্মরত।
এখন অবধি কলকাতা বিমানবন্দরে বড় কোনও বিপর্যয় না হওয়ায় সরাসরি দুর্ঘটনা সামলানোর অভিজ্ঞতা তানিয়ার হয়নি। তবে সব সময় আপৎকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য নিজেকে তৈরি রাখতে হয়, বলছিলেন তানিয়া। তাই মাঝে মাঝে মক ফায়ার ড্রিলে অংশ নিতে হয়। নকল মহড়ার সেই যুদ্ধে ব্রিদিং অ্যাপারেটার্স, এক্সিমিটি স্যুট পরে লড়াই করতে হয় আগুনের সঙ্গে।
আর এয়ারপোর্ট বা বিমানবন্দরের রানওয়ের ধারে আগুন নেভানোর যাবতীয় আধুনিক সরঞ্জামে সুসজ্জিত যে গাড়িটা এই কাজে বিমানবন্দরের দমকল কর্মীদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার, অস্ট্রিয়ার রোজেনবার্গ কোম্পানির সেই সি.এফ.টি বা ক্র্যাশ ফায়ার টেন্ডার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার কৌশলে নিয়মিত শান দেওয়া রপ্ত করতে হয় দুর্ঘটনা না ঘটার দিনগুলিতেও।
কিশোরকুমার সান্যাল ও রুমা সান্যালের ছোট মেয়ে শান্তশিষ্ট চেহারার তানিয়াকে দেখলে বোঝাই যায় না যে, সে এখন অনুপ্রেরণা জোগায় বাংলার অন্য মেয়েদের। চায়, পুরুষশাসিত এই সমাজে আড়ালে না থেকে সাহস করে এগিয়ে আসুক অন্য মেয়েরাও।
সম্প্রতি সেফটি অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার সেফটি অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী, সিঁথি রামকৃষ্ণ সংঘ সারদা বিদ্যামন্দিরের এই প্রাক্তন ছাত্রীটি স্কুলজীবনে লেখাপড়াতে কৃতিত্বের পাশাপাশি, স্কুল স্পোর্টসেও নজর কাড়তেন নিয়মিত। দিদি তনিমার মতো ভালোবাসতেন শাস্ত্রীয় নৃত্য।
ভুবনেশ্বরে ট্রেনিং নিতে যাওয়ার আগে দিদির তত্ত্বাবধানে পাইকপাড়ার টালা পার্কে রোজ সকালে তাঁকে দেখা যেত দৌড়-ঝাঁপ করতে। তাই অগ্নিযোদ্ধা হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শারীরিক সক্ষমতা ছিলই। সঙ্গে ছিল লক্ষ্যে পৌঁছানোর অদম্য ইচ্ছা। যা আজ তানিয়াকে পৌঁছে দিয়েছে ‘প্রথম’ হওয়ার শিখরে।
কৌশিক বসু