ব্যবসা সূত্রে উপার্জন বৃদ্ধি। বিদ্যায় মানসিক চঞ্চলতা বাধার কারণ হতে পারে। গুরুজনদের শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন ... বিশদ
অফিস থেকে ফিরতে সেদিন একটু বেশিই দেরি হয়ে গিয়েছিল অন্তরার। তার কাজটাই এমন। সময়ের ঠিক থাকে না। সেদিন বড় রাস্তায় ক্যাবের জন্য অপেক্ষা করার সময় কোথা থেকে একটা গাড়ি সামনে এসে দাঁড়ায়। নেমে আসে জনা দুই-তিন বীরপুঙ্গব। শুরু হয় অশ্লীল বাক্যবাণ। তার ওপরে হাত ধরে টানাটানি। পরিস্থিতি বুঝেই একদম শুরুতেই ১০০ ডায়াল করায় সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিল অন্তরা। রাগে, দুঃখে, অপমানে, ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিল সে, নিজের শহরে নিজের নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবে।
ঘটনা দুই
সন্ধেবেলায় বন্ধুর সঙ্গে স্কুটারে চেপে বেরিয়েছিল সোহিনী। পথে, পাশ দিয়ে যাওয়া অটোর ভেতর থেকে উড়ে এল কটূক্তি। প্রতিবাদ করায় মারধর। সঙ্গে শাসানি, হুমকি আর অকথ্য ভাষার গালিগালাজ। এরপর অভিযোগ জানানো হলেও চলে চাপান-উতোর, ন্যায়-অন্যায় বিচার, সোহিনীর পোশাক নিয়ে বিতর্ক। একবিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তির ধ্বজা ওড়ানোর সময়ে দাঁড়িয়েও একজন মেয়ের পথ চলাতে নিরাপত্তার কতটা অভাব সেটা এই ঘটনা থেকে সহজেই অনুমেয়।
ঘটনা তিন
কিশোরী কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে বাবা-মা বাসে উঠেছেন। চলন্ত বাসের সামনে বসা দুই যুবকের অশালীন আচরণ, কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি এবং শেষে মা-মেয়ের ছবি মোবাইল বন্দি করায় ঘটনা অন্য দিকে মোড় নেয়। মায়ের চিৎকারে ও বাসের লোকজনের সম্মিলিত প্রতিবাদে রক্ষা পান কিশোরী কন্যাটি। এখন শহরে কি গ্রামে দিনের আলো বা রাতের অন্ধকারে মেয়েরা নিরাপদ নয় একেবারেই। আজও ভাবলে শিউরে ওঠে কিশোরী কন্যা ও তার মা।
খবরের কাগজ খুললেই শিরোনামে নারীর ওপর নেমে আসা জঘন্য সব লাঞ্ছনার ঘটনা প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত আমাদের চোখে পড়ে। শুধু রাতবিরেতেই নয়, দিনের আলোয়, দুপুরে, সন্ধে সব সময় ঘটে চলেছে একটার পর একটা ঘটনা। শুধু অন্তরা, সোহিনীই নয়, অপর্ণা, আরতি, অনিন্দিতা, দেবস্মিতা অথবা করুণা, মালতী, ভজা বা পচা বা ক্যাবলার মা এছাড়া ছোট ছোট দুধের শিশু দিয়া, হিয়া, রিয়া এরাই বা কতটা নিরাপদ?
স্কুলে, কলেজে, পথে, ঘাটে, বাসে, ট্রামে, ট্রেনে, প্লেনে, কর্মক্ষেত্রে এমনকী নিজের বাড়িতেও কতটা নিরাপদ মেয়েরা? সবসময়ই একজন নারী নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। আজও সমাজে মেয়েদের দুর্বল ভাবা হয়। সমাজে, সংসারে মাথা উঁচু করে বাঁচার ক্ষেত্রে বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায় এই সমস্ত প্রতিকূল পরিস্থিতি। মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকাই বা কতটা? কী ব্যবস্থা গ্রহণ করলে নারী নিরাপদ থাকবে? নাকি এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা? সমাজ বা রাষ্ট্রের দায়ই বা কতটা? কী ব্যবস্থা নিয়েছে বা নিচ্ছে সমাজ? এই সমস্ত বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন সমাজতত্ত্ববিদ ডঃ পার্থসারথি দে।
সমাজে মেয়েদের নিরাপত্তার অভাববোধ করা কতটা সঙ্গত?
নিরাপত্তার অভাব বা নিরাপত্তাহীনতা যদি একজনের মধ্যে দানা বাঁধে তাহলে সেটা ধীরে ধীরে সমাজে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে সামগ্রিকভাবে বিষয়টাকে যদি আমরা দেখি, সমাজে তো আমরা সবাই চলাফেরা করছি। কখনও যদি দু-চারটে ঘটনা ঘটে তার ওপর ভিত্তি করে তো আমরা সাধারণীকরণ করতে পারি না। তবে হ্যাঁ, যদি সেটা নিরন্তর ঘটতে থাকে অনেক মেয়ের ওপর বারবার, তখন বলা যায় বিষয়টা সমাজের ওপর গাঢ় ছায়া ফেলেছে। তখন সেটা দূর করার বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা অবশ্যই করতে হবে। পাশাপাশি এটাও বলব যে, পুরুষদের নিরাপত্তার অধিকার তো একচেটিয়া হতে পারে না, মহিলাদেরও সমান অধিকার আছে সমাজে। তো সেই কারণে নিরাপত্তাহীনতার বোধটা মহিলাদের মধ্যে না থাকাই বাঞ্ছনীয়। মহিলারাও সব পেশায়, সব কাজে এগিয়ে আসছেন সমস্ত বাধা-বিপত্তি দূরে ঠেলে। সমাজের বুকে ঘটে চলা বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে একসঙ্গে গাঁথার ভাবনা থেকে দূরে থাকাই উচিত। এই ধরনের ঘটনা কাঙ্ক্ষিত নয়। একশো জন মহিলার মধ্যে হয়তো একজনের সঙ্গে কোনও একদিন অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটল এখন সেইটা ধরে নিয়ে যদি মহিলারা পিছিয়ে যান বা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন সেটাও ঠিক নয় একেবারেই। তবে আবারও বলছি মেয়েদের ওপর ঘটে চলা অপরাধমূলক কোনও একটি ঘটনাও কাম্য নয় একেবারেই।
কী করে সমাজে মেয়েদের অবস্থানের উন্নতি ঘটবে?
মেয়েদের অবস্থার উন্নতি ঘটার ক্ষেত্রে মেয়েদের পরিবারের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। লিঙ্গবৈষম্য শুরু হয় পরিবার থেকেই। এটা কাটানোর জন্য সামাজিক শিক্ষা খুব জরুরি। মানসিকতার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। পুরুষ ও নারীর সমানাধিকার এই ভাবনা তৈরি করার পিছনে বাবা-মা, দাদু-ঠাকুমা, কাকা-পিসি সহ পরিবারের প্রত্যেকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আবহমানকাল ধরে প্রথম পরিবারেই শুরু হয় মেয়েদের খাটো করার পদ্ধতি। একই পরিবারে ভাই-বোন দু’জন থাকলে ছেলেটিকে খাওয়া, খেলা, পড়া, আদর-আহ্লাদে প্রাধান্য দেওয়ার মানসিকতা দেখা যায়। এই মনোভাবের পরিবর্তন ভীষণভাবে দরকার। তবেই ছোট থেকে কন্যাসন্তানটির বোধ, ভরসা, বিশ্বাসের জায়গা তৈরি হবে। এছাড়া সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আরেক বিষয় উল্লেখ করা দরকার, সেটা হল গ্রাম এবং শহরে এই দুই ক্ষেত্রেই মহিলাদের সমান গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। গ্রামীণ মহিলাদের শুধু শিক্ষা নয়, স্বনির্ভর করতে হলে প্রশিক্ষণ জরুরি। সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে আইন, নিয়ম-কানুন নিয়ে। যে কোনও বয়েসের মহিলাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে স্বনির্ভর করে গড়ে তুলতে হবে তাই নয়, মেয়েটি যাতে শারীরিক নিগ্রহ বা লাঞ্ছনার শিকার হলেও প্রতিবাদের মনোবল অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে সেই মানসিকতা তার মনে গড়ে তুলতে হবে পরিবারের লোকজনদের। ভয়ে, লজ্জায় নয়, দৃঢ় মনোভাব নিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করার সাহসের শিক্ষা আসবে পরিবার থেকেই।
আজও সমাজে মেয়েদের দুর্বল ভাবা হয়। এই ধারণা কতটা সঠিক?
এমন ভাবনাই ভুল। সমাজের বুকে যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই ধারণার বদল দরকার। মেয়েরা তো সব পেশায়, সব ক্ষেত্রে ছেলেদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। ছেলেদের তুলনায় শারীরিক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তাদের আটকানো যাচ্ছে কি? শুধু দৌড়ে বেড়াচ্ছে বলা বোধহয় ভুল হবে নিজেদের সফল হিসেবে প্রমাণও করেছে মেয়েরা। তাহলে তাদের দুর্বল ভাবার কারণটা কী? এই মানসিকতার পরিবর্তন বাঞ্ছনীয়।
মেয়েদের আত্মসচেতনতা কতটা জরুরি?
ভীষণ জরুরি। এর পিছনে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবদান খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি মেয়ে আত্মসচেতন হলে তবেই পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব। এর জন্য কিছু সংস্থা, সংগঠন, সমাজের অন্য অংশের মানুষ, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় এবং রাষ্ট্রের পরিকল্পনা প্রয়োজন। গ্রামের মেয়েদের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র আর্থিক সহায়তা দিয়ে উন্নতি ও সচেতনতা সম্ভব নয়। সামাজিক শিক্ষা এবং বার্তারও প্রয়োজন। গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থার প্রতিবন্ধকতাও দূর করতে হবে।
আর্থিক স্বনির্ভরতা মেয়েদের কতটা নিরাপত্তার অনুভূতি জোগায়?
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জোগায়। মেয়েরা যদি আর্থিক দিক থেকে স্বয়ম্ভর হয় তাহলে নিরাপত্তার প্রশ্নে তারা অনেকটা সাহস পায়। প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো বা মোকাবিলা করার জোর আপনিই আসে। বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ মেয়েদের মনের প্রসার ঘটায়। শুধু তাই নয়, অনেক সময়ই দেখা যায় নিজের জীবন সম্পর্কে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারার মনোবল ও আত্মপ্রত্যয় স্বনির্ভরতা থেকেই আসে।
সমাজে ও সংসারে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হলে বিশেষ কী কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?
(১) প্রতিটি মেয়েকে শিক্ষা দিতে হবে। অর্থাৎ শিক্ষার অধিকার বাস্তবায়িত করতে হবে। (রাইট টু এডুকেশন)।
(২) সচেতনতার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। (অ্যাওয়ারনেস ট্রেনিং)
(৩) কী শহরে অথবা গ্রামে বিভিন্ন মহিলাদের বয়স অনুযায়ী হাতে-কলমে প্রশিক্ষিত করতে হবে। বয়স্ক শিক্ষা (অ্যাডাল্ট এডুকেশন) জরুরি।
(৪) প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মেয়েদের সহায়ক নানা ব্যবস্থা যে সমাজ ও রাষ্ট্রের আছে এটা মেয়েদের জানা জরুরি।
মেয়েরা নাকি লাইসেন্স নেওয়া বন্দুক কিনছে। এটা কি আদৌ জরুরি? নাকি বাড়াবাড়ি চিন্তা?
না, এটা একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়। বন্দুক মানে তো আরেকটা হিংস্রতার জন্ম দেওয়া। তার জন্য রাষ্ট্রের ব্যবস্থা রয়েছে, পুলিস আছে। তারা লাইসেন্স নিয়ে ব্যবহার করবে। গ্রামের ক’টা মেয়ে এটা পারবে? ধরা যাক, একটি ছেলে অভব্য আচরণ করল তাহলে সেই মেয়েটি নিরাপত্তার জন্য তাকে গুলি করে মেরে দেবে? তাহলে তো একটা অন্যায় আরেকটা অন্যায়ের জন্ম দেবে। এগুলো পশ্চিমী ধারণা। আমাদের দেশে এর থেকে অনেক ভালো পদ্ধতি রয়েছে। নিরাপত্তার জন্য বন্দুক না রেখে মেয়েরা বরং ক্যারাটে, জুডো শিখুক।
মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য, উন্নতির জন্য সমাজ কী ব্যবস্থা নিয়েছে বা নিচ্ছে?
ভারতবর্ষের সামাজিক যে পরিকাঠামো, যে ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি রয়েছে তাতে সব সময় যে মহিলাদের খুব খারাপ অবস্থা ছিল তেমনটা নয়। স্বাধীনতার পর থেকে মহিলাদের অবস্থার ক্রমশ উন্নতি হয়েছে। এরও পরে একবিংশ শতাব্দীতে এসে সামাজিক, রাজনৈতিক অথবা অর্থনীতিতেও মহিলাদের অংশগ্রহণ দেখবার মতো। সমস্ত কঠিন শিক্ষাও দেয় তাদের সহজাত দক্ষতায়। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অর্থনীতিবিদ, সোশ্যাল প্ল্যানার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, এয়ার ক্রাফট পাইলট এবং অনেক ধরনের এমন পেশা যেগুলোয় পুরুষদের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল, সেই সব পেশা যেমন যুদ্ধবিমান পরিচালনা এবং আর্মিতে মহিলাদের স্কোয়াড তৈরি হয়েছে। কোনও ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই তারা। এই যে সমাজের সর্বস্তরে মহিলাদের উত্তরণ এর পেছনে কোনও না কোনওভাবে রাষ্ট্র এবং সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও নানা সদর্থক পদক্ষেপ গ্রহণের ফলেই এসব সম্ভব হয়েছে।