ঝগড়া এড়িয়ে চলার প্রয়োজন। শরীর স্বাস্থ্য বিষয়ে অহেতুক চিন্তা করা নিষ্প্রয়োজন। আজ আশাহত হবেন না ... বিশদ
এই কাশ্মীর উপত্যকা ‘আমার দেশ’ নয়!
কারণ এই ‘কাশ্মীর’-এর জন্যই বুক জুড়ে হা হা শূন্যতা নিয়ে মাটির ঘরের দাওয়ায় বসে আছেন হাকিমন বিবি। দিন যায়, রাত যায়। খাওয়া নেই, দুই চোখে তাঁর ঘুম নেই। এই বুঝি বাপ-বেটা এল, এসেই তো বলবে, ‘খিদে পেয়েছে, খেতে দাও’! আর তখন অড়িঘড়ি তৈরি করতে হবে পছন্দসই জলখাবার। এই নিয়েই ভাবনা চলছে হাকিমনের মনে। সাকিন কালিয়াচক গ্রাম, জেলা মালদা। হাকিমনের বর সুলেমান আর ছেলে সুভান গুলমার্গের আপেল বাগানে কাজ করেন। হঠাৎ তাঁদের আর কোনও খোঁজখবর নেই। ডাকপিওনের ঝুলিতে কোনও চিঠি নেই হাকিমনের জন্য। যাযাবর-এর ‘ঝিলম নদীর তীরে’ ইদের চাঁদ ঢেকে গেছে কার্ফুর কালো মেঘে!
এই কাশ্মীরের জন্যই দুই চোখ ভরা কয়েক পশলা বৃষ্টি নিয়ে, জানালার গরাদ ধরে পথপানে চেয়ে আছে সাত বছরের রুক্সানা, ঠিকানা বারামুল্লা। দিন নেই, রাত নেই, তার ছোট্ট হাতের মুঠিতে একটা ফোন ধরে রেখেছে সে। ফোন বাজলেই সে বলবে, ‘বাবা, তুমি কোথায়’! রুক্সানার বাবা আহমেদ বসে আছেন কলকাতায়, তাঁর নিউ মার্কেটের দোকানে। তাঁর আর কাশ্মীর যাওয়া হবে কি না, কে জানে! একটা অজানা ভয় পেয়ে বসেছে আহমেদকে। কাশ্মীরের সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে যাচ্ছে লোকের চোখের ভয় মিশ্রিত চাউনি আর আর্ত কণ্ঠস্বর।
এ কেমন কাশ্মীর! কোথাও টেলিফোনের রিনঝিন নেই। ‘আপনি যেখানে ফোন করেছেন, সেই কাশ্মীরটাই এখন পরিষেবার বাইরে। অনুগ্রহ করে কয়েকদিন বাদে ফোন করুন’! কাশ্মীরের ডাকঘরগুলো এখন যেন মর্গ! কত মায়ের চিঠি, কত প্রেমের চিঠি এখন পোস্টবক্সে থমকে থাকা ‘ডেড লেটার’! অন্তরজাল ছিঁড়ে গিয়েছে। কাশ্মীরের সব কম্পিউটার এখন ‘হ্যাংড টু ডেথ’! যেন ‘Y2K’-এর পুনর্জন্ম হয়েছে! বাজার ব্যাঙ্ক বন্ধ। সব জনপদ জনমানবহীন। কাশ্মীরে প্রবেশ প্রস্থান নিষিদ্ধ।
তা অচানক কেন এমন হল কাশ্মীরের! রাজা জানেন ‘গোপন কম্মটি’! প্রজারা জানে না। কাশ্মীর জানিল না কী বা অপরাধ তাঁর, বিচার হইয়া গেল। রাজা ভাবছেন, বারে বা, কাশ্মীর নিয়ে কিছু করতে হলে সেটা কাশ্মীরিদের জানাতেই হবে, তাদের মত নিয়েই করতে হবে, তার কী মানে আছে! স্বাধীন দেশে প্রজারা যেমন স্বাধীন, রাজাও তেমনি স্বাধীন! কাজেই রাজা মনের সুখে যা খুশি করতেই পারেন। তাছাড়া আহামরি তো কিছু করা হয়নি কাশ্মীরে। শুধু একটা ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়া হয়েছে, একটা রাজ্যকে ভেঙে দু’টো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হয়েছে, আর ওই ভূখণ্ডে খানিক সেনা লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আর এ সবের বিনিময়ে, আদতে দুই খণ্ড করে দেওয়া হলেও কাশ্মীর নাকি ‘অখণ্ড’ হয়েছে! এবং, কাশ্মীর ‘স্বাধীন’ হয়েছে! কেন, সে স্বাধীন ছিল না! না, ছিল না, কাশ্মীর পরাধীন ছিল স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক ভারতের পবিত্র সংবিধানের অধীনে। কোনও আপত্তি আছে! কি জানি বাবা, যে দেশের স্বাধীনতা এক ‘বাহাত্তুরে বুড়ো’, সে দেশের ‘জনগনমন অধিনায়ক’ কাশ্মীরের কপালে কী লটকে দিলেন কে জানে! আমাদের প্রাচ্যের সেই ‘একুশে কন্যা’ মালালা ইউসুফজাই শুধু একবারটি বলেছে, ‘খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে কাশ্মীরের জন্য, বিশেষ করে সেখানের মহিলা আর শিশুদের জন্য’। অমনি তাঁর দিকে রে রে করে তেড়ে গেছে রাজার স্বেচ্ছাসেবকরা, ছোট মুখে কেমন বড় কথা দেখো! বলি, কাশ্মীর কি তোমার ‘বাপের বাড়ি’, যে তার লাগি নাকিকান্না কাঁদছো! মালালার পক্ষে ওদেরকে বোঝানো অসম্ভব যে, যে দেশে মেয়েরা কাঁদে, সেথায় আর যাই থাকুক, শান্তি থাকে না। কাশ্মীরেও নেই। কাশ্মীর এখন ‘এক বিন্দু নয়নের জল, কালের কপোলতলে’!
এই স্বাধীনতা চেয়েছিল কাশ্মীর? এই অখণ্ডতা চেয়েছিল সে? মোটেই না। কিন্তু কোনও প্রশ্ন করা যাবে না। প্রশ্ন করা যাবে না যে, দেশের আরও ১১টা রাজ্যেও তো ৩৭০ ছিল, তাহলে কাশ্মীর কেন শুধু ‘নন্দ ঘোষ’! প্রশ্ন করা যাবে না যে, দেশের আরও কত রাজ্যে তো জঙ্গিপনা আছে। তারা রইল যার যার মতো সন্ত্রাস আর আতঙ্ক নিয়ে, শুধু কাশ্মীর হয়ে গেল ‘কেন্দ্রশাসিত’! কেন? প্রশ্ন করা যাবে না যে, দেশের এত রাজ্যে তো কত শত ‘শাস্তিযোগ্য’ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাহলে শুধু কাশ্মীরের দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে কেন রাতারাতি আটক করা হল? কাশ্মীর নিয়ে মালালার দুশ্চিন্তা যদি ‘নাকিকান্না’ হয়, তাহলে কাশ্মীর নিয়ে কেন্দ্রের বেলেল্লাপনা কি গণতন্ত্রে ‘নাক গলানো’ নয়? প্রশ্ন করা যাবে না। কারণ, প্রশ্নহীন আনুগত্যের এই অপসংস্কৃতির একটা নিষ্ঠুর নেতিবাচক নাম আছে, ফ্যাসিবাদ।
সংগঠিত স্বৈরতন্ত্রের এই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় ‘রাজা যত বলে পারিষদ দলে বলে তার দশ গুণ’! তারা বলবে, দেখো, এক ঝটকায় কাশ্মীর কেমন শান্তটি হয়ে গেছে! শান্তই বটে! হ্রদচারী নৌকোবাড়িগুলো কেমন খাঁ খাঁ করছে। বুলেটের ভয়ে অর্কিডের ডালে ডালে পাখিরা আর বসছে না। নীল আকাশে ভাসছে না সাদা মেঘ, যেন সেখানে থমকে আছে ১৪৪ ধারা। পশমের আদর পেতে মিনাবাজারের শালের দোকানে হামলে পড়ছে না পর্যটকের দল। গুলমার্গের গোলাপ বাগিচায় ফুলের গন্ধ নেই, সেখানে বাতাসে ভাসছে বারুদের আঁশটে ঘ্রাণ। পহেলগাঁওয়ের নয়নাভিরাম সরোবরের পাম্পোশে (পদ্মফুল) চোখের জলবিন্দু হয়ে টলমল করছে পাহাড়িয়া বারিশ! জাতীয় সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় গাড়ি থেকে নেমে কচিকাঁচারা আর অনন্তনাগের বনতলে মনের আনন্দে আপেল কুড়োচ্ছে না। সেলুলয়েডের ক্যামেরার সামনে দুধসাদা বরফের ঢালে আর ফুটে উঠছে না স্বর্গকাননের সেই ‘কাশ্মীর কি কলি’।
এই ‘শান্তি’ চেয়েছিল কাশ্মীর? আলবাৎ না। কাশ্মীরের ইতিহাস আসলে এক রূপকথা। একের পর এক হ্রদের জল শুকিয়ে গিয়ে বিকশিত হয়েছিল কাশ্মীর উপত্যকা। কাশ্মীরি ইতিহাসবিদ কলহন ‘রাজতরঙ্গিনী’-তে লিখেছেন, সংস্কৃতে ‘কাশ্মীর’ শব্দের অর্থ হল ‘শুকিয়ে যাওয়া জল’! কী আশ্চর্য মিল! আজকের ‘কাশ্মীর’ মানেও তো হাকিমন আর রুক্সানার ‘শুকিয়ে যাওয়া চোখের জল’!