বিদ্যার্থীরা শুভ ফল লাভ করবে। মাঝে মাঝে হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় ক্ষতি হতে পারে। নতুন ... বিশদ
স্বামীজি ভরতবর্ষে ফিরে আসার পর নিবেদিতাকে অনেকগুলি চিঠি দিয়েছিলেন— উদ্দেশ্য পত্র বিনিময়ের মধ্য দিয়ে নিবেদিতাকে প্রস্তুত করা।
১৮৯৮ সালের ২৮ জানুয়ারি মার্গারেট ভারতের মাটিতে পা রাখলেন। ওই বছরের ২৫ মার্চ স্বামীজি মার্গারেটকে ব্রহ্মচর্য ব্রতে দীক্ষা দিলেন। তাঁর নাম দিলেন ‘নিবেদিতা’। ওই দিন স্বামীজি নিবেদিতাকে বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যৎ ভারতসন্তানদের কাছে তুমি একাধারে জননী, সেবিকা ও বন্ধু হয়ে ওঠ।’ তাই নিবেদিতার একমাত্র উদ্দেশ্য হল ভারতবর্ষের সেবা করা। ভারতের আধ্যাত্মিকতার আদর্শ জগৎকে চিরকাল কল্যাণের পথ দেখাবে। তাই তাঁর ভারতসেবা আসলে ছিল সমগ্র মানবজাতির সেবা।
রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নানাবিধ মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি উপলব্ধি করলেন যে, ভারতবর্ষে নারীশিক্ষার প্রচলন অত্যন্ত প্রয়োজন। পরাধীন ভারতবর্ষের সামাজিক কুসংস্কারগুলিকে মুক্ত করতে হলে ঘরে ঘরে নারীশিক্ষার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। সেই সঙ্গে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে হবে। সে সময় বহু বিপ্লবী যেমন অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষ, বিপিন পাল, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত (বিবেকানন্দের ছোট ভাই) নিবেদিতার কাছে আসতেন স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যাপারে নানা আলোচনা করতে। তিনি বিভিন্নভাবে তাঁদের সাহায্য করতেন। ১৯০২ সালের অক্টোবর মাসে নিবেদিতা বক্তৃতা দিতে বরোদা গিয়েছিলেন। তাঁকে স্টেশনে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছিলেন শ্রীঅরবিন্দ। শ্রীঅরবিন্দ ইতিমধ্যে নিবেদিতার লেখা ‘কালী দি মাদার’ বইটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। শ্রীঅরবিন্দ তখন সবেমাত্র বিপ্লবীদের নিয়ে গুপ্ত সমিতি গঠন করেছেন। শ্রীঅরবিন্দের কাছ থেকে গুপ্ত সমিতির সম্পর্কে সব কিছু জেনে নিবেদিতা বরোদার মহারাজার সঙ্গে দেখা করে গুপ্ত সমিতিকে সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করলেন। পরবর্তীকালে দেখা যায় যে, শ্রীঅরবিন্দের হাতে গুপ্ত সমিতির যে দলটি ছিল, নিবেদিতা হাতে-কলমে সে দলটিকে পরিচালনা করেছিলেন।
১৯০৫ সালে বাংলাদেশে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনের সূচনা হয় তা পরে ব্যাপকভাবে স্বদেশিয়ানা এবং বিদেশি বয়কট আন্দোলনে পরিণত হয়। নিবেদিতা এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন। ওই বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে লর্ড কার্জন তাঁর বক্তৃতাকালে প্রাচ্য দেশবাসীর সত্যতা সম্বন্ধে কটাক্ষ করে বলেন, ‘প্রাচ্য অপেক্ষা প্রতীচ্যের লোকদের নিকটে সত্য বিশেষ আদৃত।’ সভায় উপস্থিত বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি লর্ড কার্জনের এই উক্তিতে অপমানবোধ করলেন, কিন্তু কেউই তার প্রতিবাদ করলেন না। নিবেদিতা এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। নিবেদিতা ক্রোধে, অপমানে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন।
অমৃতবাজার পত্রিকার কার্যালয় ছিল বাগবাজারে, সেখানে নিবেদিতা থাকতেন। লর্ড কার্জনের বক্তৃতার আপত্তিকর অংশ ও তাঁর লেখা বইয়ের মিথ্যা বিবৃতির অংশ পাশাপাশি রেখে একটি প্রতিবাদপত্র ছাপার জন্য দিলেন। পরের দিন অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রতিবাদপত্রটি ছাপা হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি পুনরায় প্রতিবাদপত্রটি স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। লর্ড কার্জনের বিরুদ্ধে দেশবাসীর মনে যে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল তার কিছুটা প্রশমিত হল।
১৯০৭ সালে যুগান্তরের মামলায় বিপ্লবী প্রবন্ধ লেখার জন্য ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে গ্রেপ্তার করে। ভূপেন্দ্রনাথের পক্ষে নিবেদিতা জামিনদার হয়েছিলেন। ইতিমধ্যে ব্রিটিশ গোয়েন্দা বাহিনী নিবেদিতাকে সন্দেহের চোখে দেখতে লাগল। এই সময়ে জাতীয় নেতাদের পরামর্শে নিবেদিতা গ্রেপ্তার এড়াতে ভারতবর্ষ থেকে লন্ডনে পাড়ি দেন। আয়ারল্যান্ড ও আমেরিকা ঘুরে তিনি ১৯০৯ সালে ‘মিসেস মার্গট’ ছদ্মনামে জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে পুনরায় ভারতে ফিরে আসেন। নিবেদিতার অনুপস্থিতিতে বিপ্লবী আন্দোলন কিছুটা স্থিমিত হয়েছিল।
মাত্র এক দশকের মধ্যে তিনি যে জীবন দর্শন দেখিয়ে গিয়েছেন তা দেশবাসী শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করে।