কর্মে অগ্রগতি ও নতুন কাজের বরাত প্রাপ্তি। আইটি কর্মীদের শুভ। মানসিক চঞ্চলতার জন্য বিদ্যাচর্চায় বাধা। ... বিশদ
তুর্কি সেনাদের হাত ধরে সেই পশ্চিম ইউরোপ পেরিয়ে ‘জাহাঙ্গিরা’ প্রবেশ করেছিল ভারতভূমিতে। নাম-জিলাপি। ইতিহাস বলে জিলাপি প্রথম তৈরি করে পশ্চিম ইউরোপের খ্রিষ্টানরা। বিভিন্ন উৎসবে জিলাপি তৈরি করতো তাঁরা। কিন্তু প্রশ্ন হল ভারতে যা জিলাপি তার আদি নাম কী? অনেকেই দাবি করেন, ফারসি শব্দ ‘জলবিয়া’ থেকে জিলাপি শব্দটা এসেছে। আবার কেউ কেউ বলেন, আরবি শব্দ ‘জুলেবিয়া’ হল জিলাপির আদি নাম। সে যেই নামেই ডাকা হোক না কেন? মুঘলদের হাতে পড়ে প্যাঁচবিশিষ্ট সেই মিষ্টি হয়ে গেল ‘জালেবি’।
তবে পৃথিবীর বুকে জিলাপির অস্তিত্ব এর অনেক আগে থেকে ছিল বলে মনে করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের খাদ্য বিষয়ক গবেষক ক্লডিয়া রডেনের দাবি, ত্রয়োদশ শতাব্দীর পূর্বেই মিশরের ইহুদিরা হানুক্কাহ পালনের জন্য তৈরি করত ‘জালাবিয়া’ নামের এক সুস্বাদু মিষ্টি তৈরি করত। যা জিলাপিরই প্রাচীন রূপ।
নাম নিয়ে যতই বির্তক থাকুক না কেন, জিলাপির জন্মস্থান যে পশ্চিম এশিয়ায়, এ নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। উত্তর- দক্ষিণ, পূর্ব-সম্ভবত মধ্যযুগে ফারসিভাষী তুর্কিরা ভারত আক্রমণ করার পরই কোনও একটা সময়ে জিলাপি চলে আসে এ অঞ্চলে।
নামের বাহারেও বিচিত্র এর আবেদন— জালেবি, জিলবি, জিলিপি, জিলেপি, জেলাপি, জেলাপির পাক, ইমরতি, জাহাঙ্গিরা ইত্যাদি বহু নামে ডাকা হয় এই মিষ্টিকে। আর ভারতীয় রসুই বরাবরই ছিল সব খাবারের আশ্রয়। বিভিন্ন সময়ে ভারতীয়দের খাদ্যাভ্যাসে ফারসি, আরব ও মধ্য এশীয়, পর্তুগিজ খাবারের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ভারতীয়দের রসনায় জিলাপির স্থান আজ পাকাপোক্ত। সে হোলি কিংবা বাংলা নববর্ষ, বিয়ে কিংবা স্বাধীনতা দিবস সব অনুষ্ঠানেই জিলাপি বহাল তবিয়তেই হাজির। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম ভারতভূমির সব দিকেই জনপ্রিয় এই মিষ্টি।
তবে পশ্চিম এশিয়ায় জিলাপির সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের জিলাপির কিছু পার্থক্য রয়েছে। পশ্চিম এশিয়ার জালাবিয়াতে ময়দা, দুধ, দই দিয়ে একটু অন্যভাবে ফেটানো হতো। তার সঙ্গে দেওয়া হতো মধু ও গোলাপজলের সিরাপ। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে এসেই প্রথম জিলাপি হয়ে উঠেছে মুচমুচে, রঙিন এবং আঠাল। তবে মুঘল বাদশাদের রসনা তৃপ্তির জন্য যে জিলাপি পরিবেশিত হতো, তাতে গোলাপজল দেওয়ার চল ছিল। শুধু মুঘল নয়, নবাব মহলেও যাতায়াত ছিল জিলাপির। তাদের পারিবারিক অনুষ্ঠানে খাওয়া হতো এই মিষ্টি।
এ তো গেল জিলাপির রাজ্যপাটের গল্প। কিন্তু এ দেশে রাজ্যপাট শুরু হল কবে থেকে? এ রহস্যে থেকে কিছুটা ধোঁয়াশা কাটিয়েছেন, ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ পরশুরাম কৃষ্ণ গোড়। ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত ‘দ্য নিউ ইন্ডিয়ান অ্যান্টিকুয়ার’ জার্নালে তিনি এ বিষয়ে কিছু তথ্য দিয়েছেন। সেখানে গোড়ে বলেছেন, ‘১৬০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘গুণ্যগুণবোধিনী’ পুঁথিতে জিলাপির উল্লেখ রয়েছে। পয়ার ছন্দে লেখা সেই পুঁথিতে জিলাপি বানানোর জন্য কী কী লাগে আর কীভাবে বানাতে হয়, দুয়েরই বর্ণনা আছে’।
১৪৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে জৈন সাধু জিনসূর রচিত ‘প্রিয়ংকর-রূপকথা’ গ্রন্থে ধনী বণিকদের নিয়ে আয়োজিত একটি নৈশভোজের বর্ণনায় জিলাপির উল্লেখ ছিল। সেই সময় ভারতে জিলাপি পরিচিত ছিল ‘কুণ্ডলিকা’ বা ‘জলবল্লিকা’ নামে। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে রানী দীপাবাঈ-এর সভাকবি রঘুনাথ দক্ষিণ ভারতের খাবার নিয়ে ‘ভোজন কুতূহল’ নামক রন্ধন বিষয়ক এখটি গ্রন্থ রচনা করেন, সেখানেও তিনি জিলাপি তৈরির পদ্ধতি উল্লেখ করেন। সুতরাং নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এই উপমহাদেশে জিলাপির বয়স ৫০০ বছরের কম নয়। অর্থাত্ দেশে প্যাঁচালো মিষ্টি জিলাপি বয়সের হিসেবে প্রবীণই বলা চলে।
জিলাপি শুধু খাবার নয়, এখন বাঙালির প্রবাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। কূটবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মনকে যেমন এখানে জিলাপির প্যাঁচের সঙ্গে তুলনা করা হয়। শুধু কী তাই, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তাঁর অভিধানে জিলাপিরর সঙ্গে নারীর মোহনীয় খোঁপার তুলনা করেছেন।
জিলাপি রূপ, জন্ম, নাম নিয়ে যতই বিতর্ক হোক না কেন, নিত্যনতুন মিষ্টান্ন বা ডেজার্টের রাজত্বেও , জিলাপির আবেদন কমেনি। কারণ এখনও মেলায় গেলে কিংবা রাস্তার পাশের মিষ্টির দোকানে গরম গরম মচমচে জিলাপি দেখলে আমাদের জিভে জল আসে। তাই এই মাগ্নিগণ্ডার বাজারে আজও পাতলা চিনির রসে ডোবানো জিলাপি হয়ে উঠতে পারে দোল কিংবা স্বাধীনতা দিবসের সকালের মন ভালো করা মিষ্টি।