স্বাস্থ্য বেশ ভালোই থাকবে। আর্থিক দিকটিও ভালো। সঞ্চয় খুব ভালো না হলেও উপার্জন ভালো হবে। ... বিশদ
শত্রুর সঙ্গে লড়াই করতে গেলে জোরালো প্রতিরোধ শক্তি তো গড়ে তুলতেই হবে। নানা ধরনের ভাইরাস আর ব্যাকটিরিয়া আমাদের অসুস্থতার মূল কারণ। এই মুহূর্তে করোনাভাইরাসের আক্রমণে সারা বিশ্ব বিপর্যস্ত। লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুতে আমরা ভীত, লক্ষ লক্ষ মানুষের অসুস্থতা দেখে আমরা অত্যন্ত শঙ্কিত। বুকের মধ্যে সদাই দুরু দুরু, এই বুঝি কোভিড ১৯ আমাকে বা আমার কাছের মানুষকে আক্রমণ করল। কিন্তু শুধু ভয় পেলে তো চলবে না। লড়াই করে বাঁচতে হবে আমাদের। লড়াইয়ের প্রস্তুতি শুরু হোক রান্নাঘর থেকে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় আমাদের প্রতিদিনের স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস। আর এই খাবারদাবার তৈরি হয় ও মজুত থাকে রান্নাঘরে। কী ধরনের খাবার আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, কীভাবে রান্না করলে খাদ্যগুণ নষ্ট হয় না, কী উপায়ে পরিষ্কার করলে করোনাভাইরাসের মতো জীবাণুর হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়-এইসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন ডায়েটিশিয়ান অরূপা সেনগুপ্ত।
করোনাভাইরাস রুখতে চাই স্ট্রং ইমিউনিটি
স্ট্রং ইমিউনিটি ব্যাপারটা কী একটু বুঝিয়ে বলি আপনাদের। ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, সালফার, সিলেনিয়াম ও জিঙ্ক হল স্ট্রং আন্টিঅক্সিডেন্ট। এই আন্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবারই স্ট্রং ইমিউনিটি তৈরি করে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা নেয়। এখন দেখতে হবে এইসব ইমিউন বুস্টার নিউট্রিয়েন্টস কোন কোন খাদ্যে পাওয়া যায়।
ভিটামিন এ পাওয়া যায় ক্যারটিনয়েডস গ্রুপের সবরকম ফল ও সব্জিতে। আরও সহজ করে বললে লাল হলুদ কমলা রঙের যেসব সব্জি ফল পাওয়া যায় তা ভিটামিন এ-তে ভরপুর। যেমন, গাজর, টমেটো, কুমড়ো, পাকা পেঁপে, পাকা আম, তরমুজ ইত্যাদি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এদের জুড়ি নেই।
ভিটামিন সি পাওয়া যায় সব রকম সাইট্রাস ফ্রুটসে। যেমন, পাতিলেবু, কমলালেবু, মুসম্বিলেবু, পেয়ারা, বাতাবিলেবু, আমলকি ইত্যাদি। এছাড়াও সব ধরনের শাক, কাঁচা লঙ্কায় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি আছে।
ভিটামিন ই পাওয়া যায় ডিমের কুসুম, সামুদ্রিক মাছ, অঙ্কুরিত ছোলা, বাদাম, ডাল এইসব স্প্রাউটেড খাবারে।
সালফার আমাদের রোজের খাবার থেকে আমরা পেয়ে যাই। ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকলি, পিয়াজ, রসুন, মুলো ইত্যাদিতে যেমন সালফার আছে তেমনি মাছ মাংসতেও পর্যাপ্ত পরিমাণে সালফার আছে। সালফার ছাড়া প্রোটিন তৈরি হয় না। আমিষ নিরামিষ দু’রকম খাবার থেকেই আমরা প্রয়োজনীয় সালফার পাই ।
জিঙ্ক আছে সব ধরনের মাছে, চিংড়িতে, সবরকম বাদামে।
সেলেনিয়াম আমাদের শরীরে খুব অল্প পরিমাণে হলেও প্রয়োজন হয়। প্রাণীজ ও উদ্ভিজ্জ প্রোটিন থেকে আমাদের সেই প্রয়োজন মিটে যায়।
আসলে সুষম আহার অর্থাৎ ব্যালেন্সড ডায়েট যদি আমরা মেনে চলি তাহলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এমনিই তৈরি হয় । কিন্তু আমরা তো সেগুলোকে মোটেই মেনে চলি না। কেউ মাছ মাংস ডিম বেশি খাই কেউ আবার নিরমিষাশী। ফলে ইমিউনিটির সমস্যা থেকেই যায়। এই মুহূর্তে করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচতে স্ট্রং ইমিউনিটি ব্যালেন্সড ডায়েট অনুসরণ করতেই হবে।
প্রোটিন এই যুদ্ধে ঢাল
প্রোটিন আমাদের শরীরকে মজবুত করে। অল্পবয়সে প্রোটিন যেমন বাড়বৃদ্ধিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে, তেমনি প্রাপ্তবয়সে এটি শরীরকে মেনটেন করে। একটা বয়েসের পর তো শরীরে ক্ষয় হতেই থাকে, ক্ষয় পূরণের কাজ করে প্রোটিন। ঠিক মেশিন রিপেয়ারের মতো। তাই প্রোটিনের ঘাটতি হলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবেই। এইসময় প্রোটিনই আমাদের লড়াইয়ের ঢাল। তাই প্রোটিন খাবার বেশি করে খেতে হবে। প্রোটিনের ফার্স্ট ক্লাস সোর্স হল প্রাণীজ প্রোটিন- মাছ, মাংস, ডিম। যাঁরা নিরমিষাশী তাঁরা এখন পর্যাপ্ত পরিমাণে ডাল, রাজমা, সয়াবিন, দুধ খাবেন। দুধ যাঁদের হজম হয় না তাঁরা ছানা, টক দই, সয়া মিল্ক, সয়া চাঙ্ক খাবেন। এই সংক্রমণের সময়ে প্রোটিনকে অবহেলা করা উচিত নয়।
প্রোটিন ঢাল হলে পাতিলেবু তলোয়ার
করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়তে হলে শুধু ঢাল হলেই তো হবে না তলোয়ার ও চাই। পতিলেবু সেই তলোয়ার। আগেই বলেছি ভিটামিন সি আমাদের ইমিউন সিস্টেমে বড় ভুমিকা পালন করে। পাতিলেবু ভিটামিন সি-র খুব ভালো সোর্স। তাই পাতিলেবুকে রোজের খাদ্যাভ্যাসে আনতে হবে। রোজ সকালে খালি পেটে একটা পাতি লেবুর রস খাওয়া অভ্যাসে আনুন। সাধারণ ঠান্ডা জলে মিশিয়ে খেতে পারেন, অল্প নুন চিনি মিশিয়ে লেবুর শরবত বানিয়ে খেতে পারেন, ডাল বা ঝোল জাতীয় খাবারের সঙ্গে মেখেও খেতে পারেন। অনেকে মনে করেন পাতিলেবু খেলে অ্যাসিড হয়। এই ধারনা ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে ভিটামিন সি শরীরে জমিয়ে রাখা যায় না বা তৈরিও হয় না। তাই একদিন না খেলে সেই দিনের চাহিদা পূরণ হবে না। ডেফিসিয়েন্সি থেকেই যাবে। এই সময় ভিটামিন সি ডেফিসিয়েন্সি খুব ক্ষতিকর।
হলুদ আমাদের রক্ষাকবচ
আমরা ভারতীয়রা অনেকটা ভাগ্যবান। কারণ আমাদের প্রতিদিনের রান্নায় আমরা হলুদ ব্যবহার করি। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে হলুদ সব ধরনের ভাইরাল ইনফেকশন থেকে আমাদের অনেকটা বাঁচায়। আসলে যে কোনও ভাইরাল ইনফেকশন হলে ইনফ্লেমেশন হয়। হলুদে কারকিউমিন বলে একটা উপাদান রয়েছে যার আন্টি ইনফ্লেমেটরি কার্য ক্ষমতা খুব বেশি। এই করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রতিরোধে হলুদকে হাতিয়ার করুন। কাঁচা হলুদ বাজারে পেলে তা অনেকটা কিনে রাখুন। বাড়ির সবাই আধ ইঞ্চি পরিমাণে কাঁচা হলুদ থেঁতো করে খাবেন। এছাড়া আমাদের রান্নায় হলুদের ব্যবহার তো আছেই। অবাঙালিরা দুধ হলদি খান, এটাও ভালো ফল দেবে। পাশ্চাত্য দেশের কোনও রান্নায় হলুদ ব্যবহারের চল নেই। তাই ওরা এখন রক্ষাকবচ হিসেবে কারকিউমিন কনসেনট্রট বা ড্রপ ওষুধের মতো খাচ্ছে।
খাদ্যগুণ যেন নষ্ট না হয়
আমরা খুব তেল ঘি মশলা দিয়ে ডুবো তেলে ভেজে কষে রান্না করি। এতে বিশেষ করে শাক সব্জির গুণ নষ্ট হয়ে যায়। এখন মহামারীর সঙ্গে লড়াই করার দিন। কাজেই সব খাবারের পুষ্টি গুণ অটুট রেখে রান্না করতে হবে। প্রেসার কুকারে বা কোনও ঢাকা দেওয়া পাত্রতে অল্প আঁচে রান্না করুন। ডুবো তেলে না ভেজে অল্প তেলে নন স্টিক প্যানে ঢাকা দিয়ে তৈরি করুন পছন্দসই রেসিপি। আধ সেদ্ধ খাবার এখন খাবেন না। ডিম মাছ মাংস ভালো করে সেদ্ধ করবেন।
পরিচ্ছন্নতাই আমাদের বর্ম
বাজার থেকে আনার পর শাক সব্জি বড় পাত্রে জল নিয়ে তাতে কিছুটা নুন দিয়ে ভিজিয়ে রাখবেন এক ঘণ্টা। মাছ মাংসও তাই করবেন। মাছ মাংস ধোয়ার পর নুন হলুদ দিয়ে ম্যারিনেট করে রাখবেন। তারপর রান্না করবেন। হাত সবসময় ভালো করে ধুয়ে নেবেন। পরিবেশনের সময়ে খাওয়ার থালা বাসন ভালো করে ধোবেন। রান্নাঘরের পরিচ্ছন্নতাই আমাদের বর্ম -একথা মনে রাখতে হবে।