বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
বারো হাতের আদরে পেরিয়ে যায় দিন, মাস, বছর। এ প্রেম যাঁর জীবনে একবার এসেছে, আমৃত্যু তাঁর সঙ্গী থাকবে বারো হাতের রহস্য। ঋতুর সঙ্গে মানানসই ফ্যাব্রিক বেছে কিনতে পছন্দ করেন আধুনিকারা। তবে গ্রীষ্মপ্রধান দেশে তেমন মরশুমি সাজের সুযোগ হাতে গোনা কয়েকটা দিনের জন্য। তাই শাড়ির কালেকশনে সুতির দাপট বেশি। নানা প্রদেশের নানা ধরনের সুতির শাড়ি কলেজ পড়ুয়া থেকে অভিজ্ঞ গিন্নির সাজঘর দখল করে। সেই তালিকায় গত কয়েক বছর ধরে আলাদা করে নজরে পড়ছে পনডুরু খাদি। অন্ধ্রপ্রদেশের এই শাড়ির ইতিহাসে কৌলীন্যের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু দীর্ঘ সময় সেসব স্তরের ক্রেতার কাছে ততটা জনপ্রিয় ছিল না। আবার তার দিন ফিরেছে। পনডুরুর প্রেমে মজেছেন শাড়িপ্রেমীরা।
হালকা সবুজ, সাদা, পাউডার পিঙ্ক, আসমানি নীল, ধূসর, রাস্ট, ল্যাভেন্ডার, লেমন ইয়েলোর মতো প্যাস্টেল শেডে মূলত বোনা হয় পনডুরু খাদি। তবে লাল, কালো, খয়েরি, চকোলেটের মতো গাঢ় রংও পাবেন। মহাত্মা গান্ধী চরকা কাটা এই খাদির বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, স্বাধীনতা সংগ্রামী চৌধুরী সত্যনারায়ণ প্রথম পনডুরু খাদির তৈরি একটি ধুতি গান্ধীজীকে উপহার দেন। সে উপহার মহাত্মার এতটাই ভালো লেগেছিল যে পরে তিনি পুত্র দেবদাস গান্ধীকে অন্ধ্রের পনডুরু গ্রামে পাঠিয়েছিলেন। কীভাবে এই ফ্যাব্রিক তৈরি হয়, তার খোঁজে ওই গ্রামে গিয়েছিলেন দেবদাস। বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের এই নির্দিষ্ট ফ্যাব্রিকের প্রতি ভালোবাসার আরও উদাহরণ রয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর স্টাইল স্টেটমেন্ট থেকে সাজের খুঁটিনাটি শেখেন বহু বঙ্গললনা। ইন্দিরার অঙ্গেও পনডুরু খাদি উঠেছে বহুবার।
এর জন্ম কোথায়? ইতিহাস বলছে, উত্তর অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীকাকুলাম জেলার পনডুরু নামের এক গ্রামে তৈরি হয় পনডুরু শাড়ি। গত ছ’বছর ধরে ওই গ্রামের তাঁতিদের কাছ থেকে বিভিন্ন সূত্র মারফত শাড়ি এনে কলকাতায় ব্যবসা করছেন পারমিতা ঘোষ। তাঁর ঐত্রিকা’স উইমেন অ্যাটায়ার-এ আসল পনডুরু খাদি পাওয়া যায় বলে দাবি করলেন পারমিতা। জানালেন, আটটি ভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হয় পনডুরু খাদি শাড়ি। পারমিতার কথায়, ‘দু’রকম তুলো পাওয়া যায়। লাল কাপাস, লাল তুলো। আর পাহাড়ি কাপাস বা সাদা তুলো। লাল কাপাস থেকে আমরা ৪৫-৬৫ কাউন্ট সুতো বের করতে পারি। আর পাহাড়ি কাপাস থেকে ৭১-১২৫ কাউন্ট বেরিয়ে যায়। গোদাবরী নদীর পাঁচ মিটার গভীরে থাকে ভিলানগু নামের একটা মাছ। এর চোয়ালের অংশটা দাঁতের মতো বা চিরুনির মতো দেখতে। ওই মাছ ধরে তার চোয়ালটা দিয়ে তুলো পরিষ্কার করা হয়। এরপর তুলোর বীজ বের করার জন্য তাঁতিরা কাঠের লাঠি ব্যবহার করেন। তুলো পরিষ্কার করারও কয়েকটা প্রক্রিয়া আছে। আরও কয়েক ধাপ পেরিয়ে মাকুতে ভরার জন্য গুন্ডি তৈরি করা হয়। পনডুরু হ্যান্ড স্পান।’
অন্ধ্রপ্রদেশের এই পনডুরু গ্রামটি খাদি বস্ত্র উৎপাদনের জন্যই পরিচিত। এই ফ্যাব্রিকে শাড়ির পাশাপাশি শার্ট, ধুতিও বোনা হয়। ওই গ্রামের প্রায় ২৫০ পরিবারের আর্থিক সংস্থান হয় পনডুরু খাদি বুনে। বুনন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত পরিবারের পুরুষ-মহিলা সকলেই। যে কোনও যুগেই অথেনটিক পোশাক রুচি এবং আভিজাত্যের পরিচয় বহন করে। কিন্তু হাতে তৈরি আসল জিনিসের দাম সকলের নাগালে থাকে না। ব্যক্তিশ্রমের দাম মেশিনের তুলনায় বেশি হওয়াই তো স্বাভাবিক। তবে অভিজ্ঞতা থেকে পারমিতা দেখেছেন, লকডাউনের পরে এই শাড়ির বিক্রি বেড়েছে। কারণ? তাঁর কথায়, ‘সত্যি বলতে প্রথমে খুব একটা সাড়া পাইনি। আমার ধারণা লকডাউনের আগে পর্যন্ত কম মানুষ জানতেন। লকডাউনের সময় থেকে অনলাইন কেনাবেচা বেড়ে যাওয়ার পর একসঙ্গে অনেক মানুষের কাছে পৌঁছনো সম্ভব হয়েছে। এই ফ্যাব্রিক সম্বন্ধে আগের তুলনায় মানুষ বেশি জানতে পেরেছেন। এর ইতিহাস জেনে এটা পছন্দ করতে শুরু করেছেন।’
পারমিতা জানালেন, গড়ে পাঁচ, সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা বাজেট থাকলে এই ধরনের শাড়ি কেনা সম্ভব। তবে এর মধ্যে জামদানি কাজ চাইলে তার দাম পড়বে দশ হাজার টাকার কাছাকাছি। ‘আসলে পনডুরু সাধারণত তিন রকমের হয়। এক ধরনের শাড়িতে জমি এবং পাড় দুটোই সুতির। আবার জমি সুতির, পাড় সিল্কেরও হয়। আর একটা পাওয়া যায় জামদানি। এগুলো শিফন, জর্জেটের মতো গায়ের সঙ্গে লেগে থাকা ফ্যাব্রিক হয়তো নয়। কিন্তু স্টার্চ না দিলে এই শাড়ি খুব সফট হবে’, বললেন তিনি।
প্রাথমিকভাবে এই শাড়ি ড্রাই ওয়াশ করানোর পরামর্শ দিলেন পারমিতা। দ্বিতীয়বার থেকে বাড়িতে হালকা ডিটারজেন্ট ব্যবহার করে ধোওয়া যেতে পারে। তবে তাতে লন্ড্রি ফিনিশ পাবেন না। কড়া রোদে নয়, ছায়ায় রেখে শুকিয়ে নিতে পারেন এই শাড়ি।
হাতে বোনা জিনিসের কদর করতে পারেন সঠিক সমঝদাররা। এই ধরনের শাড়ি আসলে বংশ পরম্পরায় পরবর্তী প্রজন্মকে দিয়ে যাওয়ার মতো সম্পদ। খাঁটি জিনিস পরার অভ্যেস তৈরিও এক ধরনের যাপন। সেই ছাঁচে নিজেকে গড়তে চাইলে সংগ্রহে রাখতে পারেন নিজের দেশের এক তাঁত শিল্পীর হাতে বোনা খাঁটি এই শাড়ি। শ্রম, দক্ষতা, শিল্পের মিলমিশে বারো হাতে র আদর আপনাকে ভালোবাসার ওম দেবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের পথে।
স্টাইলিং: মাধব সরকার মেকআপ: সজল দেবনাথ ছবি: অভি নস্কর