বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
সারি সারি শাড়ি। এক একটা শাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে এক একটা গল্প। কোনওটা প্রথম শাড়ি। কোনওটা হারিয়ে যাওয়া কোনও প্রিয়জনের দেওয়া উপহার। কোনওটা আবার নিজের উপার্জনে কেনা। আলমারি খুললে যেন ঝাঁপিয়ে পড়বে মাতৃভূমির আনাচ-কানাচ। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের প্রাদেশিক নকশিতে সাজানো সে সামিয়ানা। এমন স্বপ্নের শরিক হতে চাইলে তালিকায় রাখতেই হবে করওয়াটি কিনার বিদর্ভ তসর। তসরের নানা রকমফেরের ভিড়ে যে একেবারে স্বতন্ত্র।
শিকড়ের খোঁজ
বিদর্ভ হল মহারাষ্ট্রের একটি অঞ্চল। সেখানে যে তসর বোনা হয় তার পাড়ে থাকে করওয়াটি কিনার কারুকাজ। ছিমছাম কাজেই রয়েছে বনেদিয়ানা। ফ্যাব্রিক হিসেবে সিল্ক এবং তসরের পার্থক্য সম্পর্কে ধারণা থাকলে তবেই আপনি আসল শাড়ি দেখে চিনতে পারবেন। পরমা বন্দ্যোপাধ্যায় গায়িকা, উপস্থাপিকা হিসেবে পরিচিত। তবে বেশ কয়েক বছর ধরেই নানারকম ফ্যাব্রিক নিয়ে কাজ করছেন। শিল্পের প্রতি ভালোবাসা থেকে শুরু করেছেন ‘কলাকৃতি’। সেখানে রয়েছে করওয়াটি কিনার বিদর্ভ তসর। তসর এবং সিল্কের পার্থক্য বুঝিয়ে পরমা জানালেন, তসর হল ওয়াইল্ড সিল্ক। মালবেরি গাছের পাতা খেয়ে গুটিপোকা যেটা বোনে সেটা সিল্ক। অর্থাৎ এক ধরনের পাতা খেয়ে গুটিটা বোনে। আর গোটা জঙ্গলে গুটিপোকারা নানারকম গাছের পাতা খেয়ে যে গুটি বোনে তা হল তসর। সেটার টেক্সচার এবং রং বিভিন্ন রকমের হয়। সাধারণ তসর থানে ব্রাউন হালকা এবং গাঢ় রঙের যে ভিন্নতা দেখা যায় সেটা মূলত তসরের সৌন্দর্য। সেটা ওয়াইল্ড সিল্ক হওয়ার কারণেই। তাঁর কথায়, ‘যেখানকার প্রাকৃতিক খাদ্যাভ্যাস যেমন সেখানকার তসরের গুটির রং, টেক্সচারও সেই জায়গার মতোই। সেই হিসেবেই ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী আর্দ্রতা, পরিবেশের জন্য আলাদা হয়ে যায়। ভাগলপুরী তসর কেন পশ্চিমবঙ্গের গাছি তসরের থেকে আলাদা? ওটা কি তসর নয়? ওটাও খাঁটি তসর। কিন্তু ওর টেক্সচার একটু মোটা। কারণ যে ভৌগোলিক তথা প্রাকৃতিক পরিবেশে ওটা হয় বা যে জঙ্গলের যে গাছ খেয়ে গুটিপোকা থেকে তসর বেরয়, সেটা আমাদের থেকে আলাদা।’
বিদর্ভ তসরের উৎস তাহলে কোথায়? ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন টেকনোলজি কলকাতার লেকচারার তথা ফ্যাশন ডিজাইনার শৌভিক বসু গত ২২ বছরের বেশি সময় ধরে পড়াচ্ছেন। তিনি বললেন, ‘প্রাকৃতিকভাবে বড় হওয়া বন্য সিল্ক ওয়ার্ম থেকে তৈরি হয় এই তসর। এটা আলাদা করে চাষ করা হয় না। সে কারণে প্রাকৃতিক রংটাই থাকে। কোনও সিন্থেটিক পরিবেশ লাগে না। ফলে এর বিশুদ্ধতা আলাদা। রং অনেকটা লাইমিশ ইয়ালো। আপাতদৃষ্টিতে অফ হোয়াইট বলে মনে হয়। একটু রাফ মেটিরিয়াল। তবে সারা বছর পরা যাবে।’
পাড়ের কেরামতি
এই শাড়ির মূল বৈশিষ্ট্য করওয়াটি কিনার পাড়ে। করওয়াট কাটিও বলে একে। মারাঠি ভাষায় করওয়াট শব্দের অর্থ করাত। বর্ডারের যে ধরন লক্ষ্য করা যায় তা অনেকটা করাতের দাঁতের মতো। আবার করওয়াট শব্দের মানে আঁকাবাঁকা বা ঢেউখেলানোও। হিন্দিতেও এ শব্দের প্রচলন রয়েছে। কিনারের অর্থ ধার। অর্থাৎ আঁকাবাঁকা ধার। বর্ডারে বিভিন্ন ধরনের টেম্পল, রুদ্রাক্ষ মোটিফ দেখা যায়। নকশার বৈচিত্র নিয়ে পরমা বললেন, ‘এই শাড়ির পাড়ের নকশা ভীষণ ট্র্যাডিশনাল। চার-পাঁচ রকমের মধ্যেই ঘোরাফেরা করে। পাড়ের সরু দাঁত দেখলে বুঝতে পারবেন, দাঁতটা বোনার মধ্যে একটা শৈলী আছে। সেজন্য দাঁত ছাড়া বিদর্ভ শাড়ি আর দাঁতওয়ালা বিদর্ভ শাড়ির মধ্যে দামের অনেক তফাত হয়ে যায়।’ শৌভিক বললেন, ‘ইক্কত ফিল রয়েছে বর্ডারে। সম্বলপুরী টাচও রয়েছে।’
হ্যান্ডলুম ভার্সেস পাওয়ারলুম
পাড়ের দাঁত পাওয়ারলুমে নাকি হ্যান্ডলুমে বোনা, তা ক্রেতা বুঝবেন কীভাবে? পরমা বললেন, ‘হ্যান্ডলুম আর পাওয়ারলুমের মধ্যে পার্থক্য করা যায় সূক্ষ্মতা দেখে। সূক্ষ্মতা মানে এই নয়, একটা ছোট জায়গার মধ্যে অনেক ডিজাইন। সেটা পাওয়ারলুমে অনেক সময়ই হয়। কিন্তু গোটা গোটা কাজ হবে অথচ সূক্ষ্ম হবে। আবার একটা ছোট জায়গায় সেটা পাওয়াও যাবে। গোটা গোটা মানে জ্যাবরা নয়। সেলাইয়ের দিক থেকে দেখলে একটু ওঠা ওঠা কাজ হবে। পাওয়ারলুমের কাজে সব ইস্ত্রির মতো চ্যাপ্টা হয়ে গায়ের সঙ্গে লেগে থাকে। শাড়ির উল্টো দিকটা দেখলে বোঝা যায় হ্যান্ডলুম নাকি পাওয়ারলুম। হাতে বোনা শাড়িতে ছোট্ট ফুলের ডিজাইন হলেও কাজটা শাড়ির থেকে উপরে উঠে থাকবে। ছাপার মতো ইস্ত্রি হয়ে যাবে না। দাঁত পাওয়ারলুমেও হয়। রানিংয়েও হয়। রানিংয়ের দাঁত দেখলে বোঝা যায়। মূল শাড়ির জমি আর দাঁতের মধ্যে সাদা সুতোর লাইন।’ রানিং মানেই কি পাওয়ারলুম? পরমার উত্তর, ‘না, তা সবসময় নয়। পাওয়ারলুমে এই দাঁত বোনা যাবে না।’
বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য
এই শাড়ি জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (জিআই) ট্যাগ প্রাপ্ত। প্রথমে তা ছিল না। স্মৃতির ঝাঁপি উপুড় করে পরমা বললেন, ‘এটার এখন নাম বিদর্ভ তসর। আমার মা এবং তাঁর সমসাময়িকরা যখন পরতেন, তখন এটাকে কোষা সিল্ক বলা হতো। তখনও বিদর্ভ তসরের জিআই ট্যাগ পড়েনি।’ এক একটি শাড়ি বুনতে প্রায় ৮-১২ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। বিদর্ভ তসরে কলমকারি সহ বিভিন্ন প্রিন্টও দেখা যায়। পরমা দিলেন ভিন্ন খোঁজ। ‘কোষা সিল্কে জালা পাল্লু হয়। পাড়, আঁচলের হয়। আবার গায়ে বুটিওয়ালাও হয়’, বললেন তিনি। মহারাষ্ট্রের বিয়ের অনুষ্ঠানে পৈঠানি পরার চল রয়েছে, ঠিক যেমন বাংলায় বেনারসি। তবে শুভ অনুষ্ঠানে করওয়াটি কিনার বিদর্ভ তসর বেছে নেন স্থানীয়রা। শাড়ির যত্নে ড্রাই ওয়াশেরই পরামর্শ দেন ডিজাইনাররা। পরমা বললেন, ‘বাড়িতে জল দিয়ে ধুতে পারেন। খুব বেশি ডিটারজেন্ট ব্যবহার করবেন না। প্রথম ওয়াশে তো করবেনই না। কারণ পাড়ে অনেক রং থাকে। সেগুলো ব্লিড করতে পারে।’ শাড়ি মেয়েদের আবেগের আর এক নাম। শাড়ির সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকলে করওয়াটি কিনার বিদর্ভ তসর জায়গা করে নেবেই আপনার আলমারিতে।