বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
গোড়ার কথা
ডায়েট করার সুবাদে ফ্ল্যাক্স সিড (flax seed) তো শুনছেন আজকাল খুব। পুষ্টিদায়ী যে বীজ ডায়েট চার্টের উপরের দিকে থাকে, সে বীজের গাছ থেকে তৈরি ফ্যাব্রিকও কিছু কম জনপ্রিয় নয়। ফ্ল্যাক্স গাছের ভিতরকার ছাল থেকে পাওয়া যায় সেলুলোজ ফাইবার। তা থেকে তৈরি হয় যে ফ্যাব্রিকটি, তা চিনে নিতে অতি বড় বস্ত্রবিশেষজ্ঞ হবার দরকার নেই। হ্যাঁ, লিনেনের কথাই বলছি। লাতিন নাম ‘লিনাম আসিটাটিসিমাম’— যা থেকে এসেছে লিনেন শব্দটি।
লিনেন কিন্তু কটনের মতোই প্রাকৃতিক ফাইবার, কিন্তু এর চাষ করা এবং তা থেকে একে ফ্যাব্রিকে পরিণত করার প্রক্রিয়াটি বেশ সময়সাপেক্ষ। কারণ ফ্ল্যাক্স ফাইবার বোনা খুব সহজ কাজ নয়। গাছ থেকে ওই ফাইবার বের করে নেওয়ার পরে এগুলোকে নরম হওয়ার জন্য দীর্ঘ সময় স্টোর করে রাখতে হয়। একসময় তোয়ালে, টেবলক্লথ, ন্যাপকিন, বেডশিট বানানোর সঙ্গে সমার্থক ছিল লিনেন। যে কারণে আজও এসব জিনিসকে ‘লিনেনস’ বলে ডাকার চল রয়েছে। যদিও এখন আর সবসময় এসব জিনিস লিনেন থেকে তৈরি হয় না।
খ্রিস্টের জন্মের সাত হাজার বছর আগে ফ্ল্যাক্স গাছ পশ্চিম এশিয়ার যে যে অংশে চাষ হতো, তা ‘উর্বর চন্দ্রকলা’ (fertile crescent) অঞ্চলের মধ্যে পড়ত। লেভান্ত, প্রাচীন মেসোপটেমিয়া এবং প্রাচীন মিশর ছিল এই অঞ্চলের মধ্যে। জানা যাচ্ছে, প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার ব্যাবিলনিয়াতেই প্রথম ফ্ল্যাক্স গাছের সুতো বোনা শুরু করেন স্থানীয় বাসিন্দারা, তাঁদের হাতে বেড়ে ওঠে লিনেনের ব্যবসাও। আবার প্রাচীন মিশরেও লিনেনের ব্যবহার কিছু কম ছিল না। বিভিন্ন মমি তার প্রমাণ দেয়। মমি মুড়ে রাখা হতো যে কাপড়ে, তাতেও লিনেন। ফারাওদের সমাধি থেকেও অসংখ্য লিনেনের তৈরি পোশাক, টিউনিক এবং গৃহসামগ্রী পাওয়া গিয়েছে।
প্রাচীন মিশরের পর থেকে পশ্চিমী দুনিয়ায় পরের শতাব্দীগুলোয় পোশাকের মাধ্যম হিসেবে লিনেন ছিল বেশ জনপ্রিয়। সবরকম আবহাওয়ায় ও ঋতুতে পরা যায় বলে এই ফ্যাব্রিক ইউরোপের সব শ্রেণির মানুষের কাছে সমাদর পেয়েছে। কালে কালে সেরা মানের লিনেন উৎপাদনে উঠে আসে আয়ারল্যান্ড, ইতালি এবং বেলজিয়ামের নাম। লিনেনের দৌড় ছিল মার্কিন উপনিবেশগুলোতেও। ক্রমে ক্রমে ১৯ শতকের শেষ দিকে এসে দেখা গেল উচ্চবিত্ত শ্রেণির পুরুষ উষ্ণ আবহাওয়ায় পরার জন্য উপযুক্ত হালকা রঙের লিনেন স্যুটের দিকে ঝুঁকছেন। দক্ষিণ আমেরিকার অথবা ক্যারিবিয়ান এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের গরমে দেখা গেল মহিলারাও ধীরে ধীরে লিনেনের ড্রেস পছন্দ করছেন।
আধুনিক সময়
এযুগে লিনেনকে নানাভাবে পুনরাবিষ্কার করা হচ্ছে বলা চলে। স্যুট শার্ট আর ড্রেসের সীমা ছাড়িয়ে এ বঙ্গে থুড়ি ভারতে এসেছে লিনেনের বারো হাত! লিনেনের এখন সমাদর আরও বেড়েছে। প্রচুর নামী বিদেশি ব্র্যান্ড লিনেনের জনপ্রিয়তা দেখে বাজারে নিয়ে এসেছে নানাবিধ পোশাক। পিছিয়ে নেই এদেশীয় ব্র্যান্ডও। ভারতীয় মহিলাদের পছন্দের পোশাক শাড়িতেও লেগেছে লা জবাব লিনেন পরশ। ভারতে কোচিতে সবচেয়ে বেশি লিনেন তৈরি হয়। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের জন্যও রপ্তানিও হয় সেখান থেকে।
সুতি লিনেন ভেদ
তা বলে কটনের সঙ্গে লিনেনকে গুলিয়ে ফেলবেন না। দু’টি ফ্যাব্রিকই বহুদিন টেকে, নরম আর আরামদায়ক এবং প্রাকৃতিক ফাইবার থেকে তৈরি। তাই দু’টিই পরিবেশবান্ধব। কিন্তু দু’টির মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত, টেক্সচারের ধরনের জন্য কটনের থেকে বেশি সময় টেকে লিনেন। কারণ লিনেনের ফ্যাব্রিক একটু খসখসে। একই কারণে কটনের যে কোনও জিনিস যেমন প্রথম থেকেই নরম, লিনেন বেশ কয়েকবার ধোয়ার পর নরম হয়। বছরের যে কোনও সময়ে পরা যায় বলে লিনেনের শাড়ি বাজার মাত করেছে। আরামদায়ক এবং ঘাম শুষে নেওয়ার মতো ক্ষমতাও রাখে তা। এ শাড়ি পরলে গায়ে বাতাস লাগবে, বলা যায় এমনটাই। তাপ ঠিকরে বেরিয়ে যাবে শরীর ছেড়ে। তাই গরমে লিনেন শাড়ির চাহিদা তুঙ্গে উঠেছে গত কয়েক বছরে।
তবে সব জিনিসের সুবিধা অসুবিধা থাকে। লিনেনের অসুবিধা এর কুঁচকে যাওয়ার প্রবণতায়। যেখানে বসুন, যেভাবে বসুন ফ্যাব্রিকে তার ছাপ রয়ে যাবে। আপনি যত যত্নে ইস্ত্রি করে লিনেন পরুন না কেন, ভাঁজ পড়ে বড় তাড়াতাড়ি। ওটুকু যদি আপনার কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হয়, তাহলে লিনেনের আরামকেই আপনি এগিয়ে রাখবেন একশো গুণ।
ডিজাইনারদের মত
এ শহরে লিনেন ফ্যাব্রিক নিয়ে কাজ করছেন এমন কয়েকজন ডিজাইনারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। জানতে চেয়েছিলাম লিনেন শাড়ি কীভাবে এতটা জনপ্রিয় হল? ‘ঘুড়ি বাই দেবযানী’-র দেবযানী বসু রায়চৌধুরী বললেন, ‘একটা সময় লিনেন শুধু পুরুষদের পোশাকেই ভাবা হতো, এটা ঠিক। লিনেনের শার্ট প্যান্ট বা স্যুট হতো বা এখনও হয়। শাড়ি হিসেবে লিনেনের জনপ্রিয়তা বেড়েছে পাঁচ-ছ’বছর আগে থেকে। আমার মনে হয় এর পিছনে তিনটি কারণ। প্রথমত, ভারতীয় আবহাওয়ায় লিনেন ভীষণ আরামদায়ক মেটিরিয়াল। গরমকালে ঠান্ডা অনুভূতি জোগায়। আবার শীতে পরলেও কিছুটা উষ্ণ ভাব থাকে। দ্বিতীয়ত, পিওর লিনেন মেনটেন করা ভীষণ সহজ। হাতে কেচে নেওয়া যায় এবং অনেক ক্ষেত্রে ইস্ত্রি না করলেও চলে, যদি ধোয়ার পরে ঠিকভাবে সেটা মেলতে পারা যায়। তৃতীয়ত, লিনেনের একটা নিজস্ব জেল্লা আছে। পিওর লিনেনের শাড়িতে একটা সুন্দর ‘ফল’ আসে, সেটা অনেকেরই ভালো লাগে। গরমের বিয়েবাড়িতে সবসময় যে সিল্ক পরে যেতে হবে তা নয়, একটা সুন্দর লিনেন শাড়িও রয়্যাল লুক দেয়। আমি ডিজাইনার হিসেবে অনেক দিন ধরেই কাজ করছি। প্রিন্ট-এ বেশি করেছি। লিনেনের মধ্যে আমার করা কলকাতা প্রিন্টের শাড়ি খুব জনপ্রিয়। এছাড়া লিনেনে হ্যান্ড এমব্রয়ডারিও করিয়েছি। এটা তো কিছুটা ভারী ফ্যাব্রিক তাই হাতের কাজটা ভালো বসতে পারে। কাজের সময় কোনও ফেঁসে যাওয়ার ভয় থাকে না। এমব্রয়ডারিতে ভীষণ গর্জিয়াস একটা লুক আসে। লিনেনের মান যদি ভালো হয়, তাহলে কোনও কাজেই অসুবিধা নেই। মান নিয়ে বারবার বলছি কারণ আজকাল বাজারে নিম্ন মানের মিক্সড কোয়ালিটির লিনেন দেদার বিকোচ্ছে। যে কোনও জিনিস জনপ্রিয়তা পেলেই অবশ্য এটা হয়। তার ডুপ্লিকেটে বাজার ছেয়ে যায়। কিন্তু যারা অরিজিনাল লিনেন বিক্রি করেন, সেখান থেকেই ফ্যাব্রিক কিনে কাজ করালে মান নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না।’
মুম্বই থেকে ‘ডিজাইনড বাই সুদেষ্ণা’-র তরফে সুদেষ্ণা ভট্টাচার্য একটা গল্প বললেন, ‘আমার বাবা একবার মিশর বেড়াতে গিয়েছিলেন। তখনই প্রথম লিনেন শব্দটা শুনেছিলাম। মিশরে লিনেনের জামাকাপড় খুব বিখ্যাত। মিশরীয় কটন যেটা, সেটা বরাবরই খবরে থাকে। বাবা যখন গেলেন, বলেছিলাম লিনেনের কিছু এনো। বাবা আনলেন। সেই থেকে লিনেন প্রীতি। ২০১০ সাল নাগাদ বাবার জন্য লিনেন শার্ট কিনতে শুরু করেছিলাম। তারপর থেকে বাবা অন্য ফ্যাব্রিকের শার্ট পরতেই চাইতেন না। এর বোধহয় পাঁচ-সাত বছর পরে প্রথম দেখলাম লিনেন শাড়ি। এখনকার তুলনায় বেশ দাম ছিল। মোনোক্রোমাটিক কালারে তখন লিনেন শাড়িগুলো আসত। ডার্ক ব্লু শাড়িতে রেড পাড় বা রানি কালারের শাড়িতে লাইট গ্রিন পাড় এইরকম সব কম্বিনেশন। ২০১৫ সালের জন্মদিনে লিনেন শাড়ি নিজে পরলাম। গরমে এত ভালো এবং আরামদায়ক, আর সুন্দর হাওয়া খেলে, সেটা মনে হয় সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট এই শাড়ির। তারপর লিনেন-এর শাড়ি, ড্রেস বানানো শুরু হল। এখন তো অনেক শেডস, প্রিন্ট সবই হয়। লিনেনে ব্লক প্রিন্ট নিয়ে কাজ করেছি আমরা। নিউ নর্মাল সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাস্ক পরা মানুষের মুখ আমরা প্রিন্টে এনেছি। তা ছাড়া স্বর্ণচাপা ব্লক প্রিন্ট আছে। লিনেনের বেনারসি বা চওড়া জড়ি পাড় শাড়ি, যেগুলো গরমকালের অনুষ্ঠানবাড়িতে পরা যায়, তেমন শাড়িও করি। লিনেন জামদানিও ভীষণ জনপ্রিয়। গত দু’তিন বছরে ফ্যাশন দুনিয়ায় যেন লিনেন জামদানিরই দাপট।’
এ শহরের ডিজাইনার সঙ্গীতা মাজি (আঙ্কোনা ব্র্যান্ড) বলছেন, ‘লিনেন বিশ্বের অন্যতম পুরনো টেক্সটাইল। টেকসই আর স্কিন-ফ্রেন্ডলি। শক্ত সুতোর এই ফ্যাব্রিক আমি পাগলের মতো ভালোবাসি। এত হালকা অথচ কী অভিজাত! আমাদের কলকাতার গরমে লিনেনের সত্যি তুলনা নেই। প্রাকৃতিক এই ফাইবার অন্য সুতোর সঙ্গে মিশিয়ে আলাদা ধরনের টেক্সচারও তৈরি করা যায়। তাতে ব্লক প্রিন্ট, স্ক্রিন প্রিন্ট বা অন্য নানা কাজ করা যায়। আমার কাছে এটা মনে হয় যেন সুতোর খেলা।’ তাহলে ভরসা করে নিয়েই দেখুন লিনেন!