পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
যোগাসনের জন্য কাউকে কোথাও যেতে হবে না। ঘরের কোণে একটা ছ’ফুট বাই চার ফুট জায়গা খুঁজে পেলেই হল। একটা ম্যাট থাকলে ভালো হয়। সেটাও যদি না থাকে, একটা কম্বল দু’ভাঁজ করে রেখে তার উপরে তোয়ালে পেতে অনায়াসে যোগাসন করা যায়। এর জন্য আলাদা করে কোনও যন্ত্রপাতি কিনতে হচ্ছে না। কয়েক হাজার টাকা খরচ করে জিমে যাওয়ার দরকার পড়বে না। জিমে পৌঁছতেও সাইকেল, গাড়ি বা বাইকে যেতে হবে। সেটার জন্য অনেকটা সময় চলে যাবে। এগুলোর কোনওটাই যোগাসনের ক্ষেত্রে প্রয়োজন পড়ছে না। পাঁচ হাজার বছরের পুরনো এই ঐতিহ্য নিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী চর্চা-গবেষণা হয়েছে। আমরা জানি শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে যোগাসন। শিরদাঁড়ার সমস্যা কমানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে যোগাভ্যাস। আজকাল টানা বসে কাজ করা, শোয়া বা আধশোয়া হয়ে সময় কাটানোর যে ধরন, তার থেকে মাত্র ২৫-২৬ বছর বয়সেও অনেকের দেখেছি ‘লো ব্যাক পেইন’ শুরু হয়ে গিয়েছে। আগে এই ধরনের ব্যথা হত ষাটোর্ধ্বদের। শিরদাঁড়া বা শিরদাঁড়াকে সাহায্য করে যে সব পেশি (যাকে ‘স্পাইনাল কলাম’বলা হয়), সেটার ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আমরা কিছুই করছি না। আমার মনে হয়, শিরদাঁড়া ঠিকঠাক রাখার জন্য পৃথিবীতে যোগাসনের চেয়ে আর ভালো কিছু হয় না। তা ছাড়া, শরীরের ভেতরের অন্য সব অঙ্গ এবং গ্ল্যান্ডের জন্যও যোগব্যায়ামের তুলনা হয় না। প্রত্যেকের শরীর অনুযায়ী, ঠিকমতো চার্ট করে যোগাসন করতে পারলে ইমিউনিটি অনেকটাই বাড়ানো সম্ভব। এগুলো কমবেশি সবাই জানেন। অনেক জার্নাল আছে এই নিয়ে। তা ছাড়া, এটা ভারতীয়দের ঐতিহ্যের মধ্যেই পড়ে। সেই ঐতিহ্যকে অন্তত জানা উচিত। পৃথিবীর কত প্রান্ত থেকে ভারতবর্ষে মানুষ আসেন যোগাসন শেখার জন্য। তাঁরা নিজের দেশে ফিরে সেটার প্রচার করছেন। তাই আমাদের তো এইটুকু জানা অত্যন্ত জরুরি এবং বাঞ্ছনীয়।
আমি ব্যক্তিগতভাবে আগে অনেক বেশি যোগাসন করতাম। পরের দিকে অন্য এক্সারসাইজ সেরে কিছুটা করতাম। কিন্তু ফেলুদা-র চরিত্রে অভিনয় করতে যাওয়ার পর থেকে এ ব্যাপারে আবার মন দিয়েছি। ফেলুদা-র জন্য তৈরি হতে গিয়ে যোগাসনটাই বেশি করতাম। সেটা রোলটার মধ্যে ঢোকার জন্য তো বটেই। ফেলুদার নির্যাস বুঝতে গেলে দেখা যাবে, যোগাসনটা বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে সত্যজিৎ রায়ের লেখায়। তাই এ ক্ষেত্রে যোগাসন আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নতুন করে শুরু করার পরে বুঝলাম, কী অমূল্য রত্ন হেলায় হারাচ্ছি আমরা। অথচ কত কম খরচে কতটা বেশি উপকার পাওয়া যায়
এর থেকে।
যোগাসনের সুফল পেতে অনেক সময় লাগবে ভেবে অনেকে এ পথে আসেন না। ঘটনা হল, কোনও এক্সারসাইজেই ফাস্ট-স্লো বলে কিছু হয় না। তিন মাসে রোগা হব, এটা ভাবলেই সব হয়ে যায় না। রোগা হওয়ার প্রাথমিক শর্ত, শরীরে কতটা ক্যালোরি যাচ্ছে, সেটা খেয়াল রাখা। দুম করে জিমে গিয়ে প্রচুর ঘাম ঝরালাম এবং তাতে চটজলদি রোগা হয়ে গেলাম- এটা হয়, তবে তাতে শরীরের মারাত্মক ক্ষতিও হয়। তাড়াতাড়ি রোগা হতে গিয়ে, বিশেষ করে যাঁরা সাপ্লিমেন্টস নিয়ে রোগা হন, শরীরের ভেতরের গোটা সিস্টেমকে কী ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছেন, তাঁরা নিজেরাও জানেন না। এর জন্য পরবর্তীকালে খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু সে কথা আর কে ভাবে? তারকাদের দেখে তিন মাসে বিশেষ চেহারা বানাব, এমন অনেকেই ভাবে। বিশেষ করে বম্বের নায়ক-নায়িকাদের দেখে এটা হয়। ওই হিরো-হিরোইনরা কোটি কোটি টাকা পান। তাঁদের অভিনয় শেষ হয়ে গেলে হয় সুইজারল্যান্ডে বা সিঙ্গাপুরে ভালো ক্লিনিকে তাঁরা পরের চিকিৎসাটাও করিয়ে নেন। পুজোর মুখে দেখতে ভালো লাগবে বলে আগস্ট মাসের শুরু থেকে দু’ঘণ্টা জিম আর খাওয়া কমিয়ে রোগা হতে শুরু করলাম। তার জন্য তো আমরা কোটি কেন, কয়েকশো টাকাও
পাব না। চিকিৎসাও হবে না। আত্মপ্রসাদ লাভের জন্য নিজের এতটা ক্ষতি
কেন করব?
যোগাসন ধীরে ধীরে করতে হয়। ধাইধপাধপ মিউজিক চলবে না। অনেকে পাওয়ার যোগা, হট যোগা এ সব করেন। এগুলো সব ভেরিয়েশন, মার্কেটিং। পতঞ্জলির যোগসূত্র বা বিকেএস আয়েঙ্গার যেগুলো বলে গিয়েছেন, অথবা আমাদের এখানে বিষ্ণুচরণ ঘোষ মহাশয় যোগাসনের যে পদ্ধতি শিখিয়ে গিয়েছেন, সেটাই মানতে হবে। এটা একটা প্রক্রিয়া। শ্বাস নেওয়া, সঠিক ভাবে বসা, তার সঙ্গে মনঃসংযোগ। ভারতীয়দের কাছে এটাই ভাবনায় ছিল যে শুধু পেশির এক্সারসাইজ হলে চলবে না। পাশাপাশি ভেতরের সব অঙ্গ, শ্বাসযন্ত্র এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মস্তিষ্ক- এই চারটের মেলবন্ধন যোগাসনেই হয়। মোবাইলে কথা বলতে বলতে ট্রেডমিল করা যায়, কিন্তু যোগাসন করা যাবে না। মনঃসংযোগ এখানে খুব দরকারি। আর যোগাসনের সঙ্গে সঙ্গে দৈনিক আধ ঘণ্টা গতিতে হাঁটা অনেক ভালো কাজ দেয়।
সোশ্যাল মিডিয়ায় সেলেবদের শরীর-চর্চার এক-দু’মিনিটের ছোটখাট ভিডিও দেখে সেটা হঠাৎ একদিন করতে যাওয়া মূর্খামি। আমাদের মতো সেলিব্রিটিদের মধ্যে অনেকে আছেন, যাঁরা শো-অফ করেন। আমিও সে দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ি হয়তো কখনও। কিন্তু ওটা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে তখন-তখনই করতে যাওয়া একেবারে উচিত নয়। মনে রাখতে হবে, আমরা একটা লম্বা সময় ধরে শরীরচর্চা করে এসেছি বলেই ওগুলো করতে পারছি। আজ টাইগার শ্রফের মতো শূন্যে ডিগবাজি খাওয়া পাড়ার পচাদা যদি এক ঝটকায় করতে যায়, হাড়গোড় ভেঙে নির্ঘাত হাসপাতালে ভর্তি হবে! টাইগার শ্রফ তো তিন বছর বয়স থেকে ট্রেনিং করছে। সেটাও তো জানতে হবে।
এর আগে অনেকে মিলে বসে যোগাসন করার ছবি আমরা দেখেছি। সেটা করোনা পূর্ববর্তী যুগ। এখন সব আলাদা। মাস্ক সর্বক্ষণের সঙ্গী হলেও মাস্ক পরে এক্সারসাইজ নৈব নৈব চ। মাস্ক পরে শ্বাস নিতে একটু হলেও অসুবিধা হয়। তাই ওই অবস্থায় ক্লান্তির মাত্রা বেড়ে গেলে খুব মুশকিল। মাস্ক পড়ে শুধু এক্সারসাইজ নয়, দৌড়োদৌড়ি, তাড়াহুড়ো করা- কোনওটাই উচিত নয়। অনেকক্ষণ টানা হাঁটলেও কষ্ট হবে। তাই রাস্তায় ভিড়ের কাছাকাছি না গিয়ে বাড়ির কম্পাউন্ডের মধ্যেই হাঁটাহাঁটি সীমাবদ্ধ রাখলে ভালো। এখন একটা বিশেষ সময়। এটা তো চলবে। আমাদের সেটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। মাস্ক পরে এক্সারসাইজ করার চেয়ে না করা ভালো। আসনের সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে ফ্রি হ্যান্ড করলেও চলবে। এখন জিমগুলো আস্তে আস্তে খুলছে। সব রকম সতর্কতা নিয়েই। নিজেও সাবধান থাকুন। জিমে গেলে মাস্ক ছাড়া ঘাম ঝরাতে হবে। ২০০০ বর্গফুটের মধ্যে জিম হলে খুব বেশি হলে ২০ জনের ঢোকা উচিত। বড় জিমগুলোই সেটা মানতে পারবে। একজনের সঙ্গে অন্যের ছ’ফুট দূরত্ব থাকতে হবে। ফুলস্লিভ টি শার্ট আর ফুল ট্র্যাকপ্যান্ট পরা দরকার। সঙ্গে রাখুন কাপড়ের গ্লাভস। যাতে ঘাম না ছেটে। পা তো ঢাকাই থাকবে বিশেষ জুতোয়। ট্রেনারদের অবশ্যই গ্লাভস, মাস্ক, ফেস শিল্ড ব্যবহার করতে হবে।
অনুলিখন:অন্বেষা দত্ত