বিদ্যার্থীদের উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে মধ্যম ফল আশা করা যায়, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। ব্যবসাতে যুক্ত ... বিশদ
আজ লিখতে বসে মনে পড়ে যাচ্ছে আমার কিশোরীবেলার পঁচিশে বৈশাখের দিনগুলো। ভোর হতে না হতেই আমার প্রিয় কাকিমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়তাম জোড়াসাঁকোর পথে। চিৎপুরের ট্রামে সেদিন ভোর থেকেই ভিড়। সবাই সাজগোজ করে যোগ দিতে চলেছেন প্রাণের ঠাকুরের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। জোড়াসাঁকোর প্রাঙ্গণ প্যাণ্ডেলে ঢাকা। মাটিতে বসে অনুষ্ঠান দেখার আয়োজন। নামী দামি শিল্পীরা সবাই আসতেন। গান , আবৃত্তি, শ্রুতি নাটক- সুর তাল ছন্দে কেমন যেন ঘোর লেগে যেত। এক পাতার ট্যাবলয়েড,লিটিল ম্যাগাজিন ঘুরে ঘুরে বিক্রি করত দাদা দিদিরা। অনেককে দেখেছি হাতে লিখেও কাগজ তৈরি করতে। দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে কখন যে বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে যেত বুঝতেই পারতাম না। শেষে কাকিমা প্রায় জোর করে বাড়ি নিয়ে যেতেন। কলেজ জীবনেও প্রতিবার গিয়েছি জোড়াসাঁকোয়, রবীন্দ্রসদনে। বড় বড় শিল্পীদের পরিবেশনায় মুগ্ধ হয়েছি। পরবর্তীতে নিয়ম করে যাওয়া হয়ে ওঠেনি ঠিকই কিন্তু পঁচিশে বৈশাখ আসার দিন দুয়েক আগে থেকেই মনটা আকুল হয়েছে। ঠিক যেমনটা হয় প্রিয়জনের জন্মদিন এলে। তিনি যে শুধু কবিগুরু নন , তিনি যে আমাদের আত্মার আত্মীয়, আমাদের প্রাণের ঠাকুর, আমাদের সুখ দুঃখের সাথী। এবার করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে বিশ্বের কোথাও কোনও অনুষ্টান করা যাচ্ছে না। লক্ডাউন চলছে সর্বত্র । তাই বলে কি আমরা জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করব না? নিশ্চই করব। করছিও। গতকাল থেকেই সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে বিরাজ করছেন শুধু তিনি। পুরো কবিপক্ষ চলবে নানা অনুষ্ঠান। এমন অনুষ্ঠানের শরিক হয়ে কেমন লাগছে শিল্পীদের? কে কী করলেন এবার? কয়েকজন প্রথিতযশা শিল্পীর মনের কথা কাজের কথা জানাই আপনাদের।
সাধক ওগো প্রেমিক ওগো পাগল ওগো...
স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত
পাগলের মতো ভালোবাসি তাঁকে। শুধু এই বিশেষ দিনটিতেই নয়, প্রতিটা দিন প্রতিটা ক্ষণ বিপদে বিষাদে আনন্দে প্রতিবাদে তিনিই আমার সখা, তিনিই আমার অভিভাবক। এবার অন্যান্য বছরের মতো অনুষ্ঠান হচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু আধুনিক মাধ্যম তো রয়েছে। আমি রোজ সকালে নিজের পুজোর ঘরে বসে তাঁর একটা করে গান করে ইউ টিউবে পোস্ট করি। গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো আর কি! তাঁর গান নিয়ে অনেক কাজ করেছি সারা জীবন ধরে। এখনও করে চলেছি । রবীন্দ্রনাথ ১৯০টি গানে সুর দিয়ে যাননি । ফলে সেগুলো অগীত থেকে গিয়েছিল । আমি ১৫০টি গানে কবির দেখানো পথেই সুর দিয়েছি। প্রতিটা গান আমি আমার শ্রদ্ধেয় অগ্রজদের শুনিয়েছি। বিশেষ করে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় খুব কড়া শিক্ষক ছিলেন। আমার গুরু মায়া সেন, পূরবী মুখোপাধ্যায় সকলকে শুনিয়েছিলাম সেই গান। বিশ্বভারতীর সুপ্রিয় ঠাকুর লিখিতভাবে আমার এই কাজকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বাকি ৪০টি গানও সুর করেছি । ভেবেছি এ প্রজন্মের যে শিল্পীরা ভালো গাইছেন তাদের দিয়ে গাওয়াব। কবির অনেক গানের সঙ্গে আমি রামায়ণের মিল খুজে পেয়েছি। সেই গান দিয়ে রামায়ণ তৈরি করেছি। গীতার দর্শনের সঙ্গে কবির অনেক সঙ্গীত মিলেমিশে এক হয়ে যায়। সেই গান দিয়ে তৈরি করেছি ‘গীতা বিতান’। কবির কাছে প্রার্থনা তিনি যেন আমাকে শক্তি দেন দেহে মনে । আরও অনেক কাজ যেন আমি করতে পারি।
আমি ভয় করব না ভয় করব না
অলোক রায় চৌধুরী
শহর থেকে শহরতলি ঘুরে চ্যানেল থেকে চ্যানেল দৌড়ে গলদঘর্ম হয়ে এবার আর রবি ঠাকুরের পুজো করতে হলো না আমাকে। সে এক অন্য উন্মাদনা। এবার ঘরে বসেই গান গেয়ে তার ভিডিও ও অডিও পাঠাতে হচ্ছে। এও পুজো। তবে নিয়মটা ভিন্ন। এর পরপরই বিদেশে অনেক অনুষ্ঠান থাকে। এবারও ছিল। সব বাতিল। এ তো ভবিতব্য। কিন্তু থেমে থাকলে তো চলবে না। দেশে বিদেশে ছড়িযে আছে আমার ছাত্রছাত্রী। তাদের এগারোজনকে নিয়ে তৈরি করেছি ‘ মরার আগে মরব না’। গতকাল থেকে আমার ওয়েব পেজে আর ইউ টিউবে শোনা যাচ্ছে এই গান। প্যারিস লন্ডন সান ফ্রানসিস্কো থেকে আমার ছাত্রছাত্রীরা গানটি গেয়ে পাঠিয়েছে। গেয়েছে এখনকার ছাত্রছাত্রীরাও। এবার এইভাবেই করলাম কবি পুজো।
তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী
শ্রাবণী সেন
মনটা একেবারেই ভালো নেই। তিরিশ বছর ধরে কবিগুরুর জন্মদিনে গান গেয়েছি অনেক অনেক অনুষ্ঠানে। শুধু তো দিনটাতেই নয়, পুরো পক্ষ জুড়েই থাকে কতো অনুষ্ঠান। আমাদের প্রাণের মানুষের জন্মদিন পালন হয় বিশ্ব ভরে। এবার মহামারি কেড়ে নিয়েছে এই আনন্দ উত্সব আমাদের জীবন থেকে। তবে পুরোটা কেড়ে নিতে পারেনি। আধুনিক নানা মাধ্যম সহযোগিতা করেছে আমাদের। ঘরে বসে গান গেয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি আমরা। আমার কাছে প্রায় কুড়িটা সংস্থা থেকে গান চেয়েছিল। দিয়েছি। তবে আলাদা আলাদা করে কুড়ি বার বাড়িতে নিজের ঘরে বসে গান ভিডিও রেকর্ড করাটা খুব বিরক্তিকর। সামনে আমার প্রিয় শ্রোতারা নেই , চারিদিকে উত্সবের আবহ নেই , শ্রোতাদের আবেগ অনুভূতির প্রকাশ নেই - একা একা ঘরে বসে জন্মদিন উদযাপন করতে খুব কষ্ট হচ্ছে । পরের বছর নিশ্চই এই আঁধার দূর হবে । আলোয় আলোয় কবিকে বরণ করব সবাই মিলে ।
কে বসিলে আজি হৃদয়াসনে
মনোজ মুরলী নায়ার
কবি তো কখনও হতাশাকে প্রশ্রয় দেননি। যত দুঃখ যত মৃত্যু যত অবজ্ঞা যত বঞ্চনা এসেছে জীবনে, তা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে নিয়েছেন নিজেই। আমাদেরও সঙ্কটকালে নিজেদের প্রত্যয় হারালে চলবে না। কবির সাহিত্য , কবির গান , কবির বাণীকে সঙ্গী করে আমরা জয়ী হব- কবিপক্ষে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার। আমার ' ডাকঘর' ফেসবুক পেজ থেকে রোজ রাত নটায় থাকছে রবীন্দ্রনাথের গান ও চিন্তন নিয়ে অনুষ্ঠান। রেডিও ফর্মে। এখানে অনেক এই প্রজন্মের শিল্পীর গান থাকছে । পুরো কবিপক্ষ চলবে আমাদের এই শ্রদ্ধাঞ্জলি।
ওগো দুখ জাগানিয়া
ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়
এবার ব্যতিক্রমী রবীন্দ্র জন্মদিন উদযাপন করছি আমরা সবাই মিলে। সারা বিশ্ব যেন এক সুত্রে বাঁধা পড়েছে এবার। সবাই গৃহবন্দি। নিজের ঘরে বসে অনেকগুলো কবিতা আবৃত্তি করলাম। ভিডিও করে পাঠালাম নানান উদ্যোক্তার কাছে যাঁরা চেয়েছিলেন। সবই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা গান নিয়ে সারাজীবন ধরে অনেক অন্যরকম কাজ করছি। আমার প্রিয় নাটক ' রক্তকরবী ' একেবারে অন্য ফর্মে মঞ্চস্থ করেছিলাম। দর্শকের কাছে খুব কদর পেয়েছিল। আমার ব্রততী পরম্পরা থেকেও এবার মে মাস জুড়ে রবীন্দ্র জন্মোত্সব চলবে। ফেসবুক পেজে দেখা যাবে। আমার সঙ্গে আমার ছাত্রছাত্রীরাও অংশ নেবে এই অনুষ্ঠানে।
চারিদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারী
ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়
আমার মনে হয যে কোনও সৃজনশীল মানুষ গৃহবন্দি অবস্থাতেও ঠিক মুক্তির পথ খুঁজে নেন। আর এই মুক্তির পথ ধরেই আসে নতুন সৃষ্টি। কবিগুরুর এই দর্শন এই লক্ডাউনের সময়ে উদ্বুদ্ধ করেছে আমাকে। পরবর্তী প্রজন্মকে কিছু দিয়ে যেতে চাই । তাই এই সময়ে বাংলার কবি অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, নজরুল , দ্বিজেন্দ্রলালের অনেক অপ্রকাশিত গান নিযে কাজ করছি । রবীন্দ্রনাথের অনেক গান আবার নতুন করে সাধনা করছি । অনলাইন গানের ক্লাস শুরু করেছি । দেশে বিদেশে এবার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে রবীন্দ্র জয়ন্তী উপলক্ষে অনুষ্ঠান হচ্ছে । অনেকগুলো অনুষ্ঠানে বাড়ি থেকে গান গেয়ে পাঠিয়েছি । বন্দি অবস্থাতেও থেমে থাকা চলবে না । চরৈবেতি হোক আমাদের মন্ত্র।
এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে
সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
আমার জীবন মরণ আমার হাসি কান্না আমার হর্ষ বিষাদ ঘিরে শুধু তুমি শুধু তুমি শুধু তুমি -তুমি আমার জীবন দেবতা আমার রবীন্দ্রনাথ। কবিপক্ষে তোমাকে দিলাম তোমারি ' ভারতবর্ষ ' কবিতাটি। আমার অন লাইন বাচিক শিল্প ক্লাসে বিশ্বের প্রায় সব দেশের মানুষ আছেন। তাঁদের থেকে তেত্রিশ জনকে বেছে নিয়েছি এই কবিতা আবৃত্তির জন্য। অনুষ্ঠানের সূচনা করেছেন অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। ভিডিও ডিজাইন করেছেন অর্ক চৌধুরী। এস পি সি ক্রাফটের পেজে কাল প্রকাশ পেয়েছে এটি। এছাড়াও আমি আর জয়তী চক্রবর্তী একটি বিশেষ নিবেদন করব। ১০মে ইউ টিউবে দেখা যাবে।