বিদ্যার্থীদের কোনও বৃত্তিমূলক পরীক্ষায় ভালো ফল করবে। বিবাহ প্রার্থীদের এখন ভালো সময়। ভাই ও বোনদের ... বিশদ
খেতে বসে ছোট্ট নবনীতা খানিক আশাভঙ্গের বেদনায় বলে উঠেছিলেন, ‘এ আবার কী রকম নেমন্তন্ন খাওয়া? এ তো ভাত খাওয়া! পোলাও কই?’
মা-বাবা দু’জনেই মেয়ের কাণ্ড দেখে লজ্জায় বিব্রত, বিপন্ন। অদূরে ইজিচেয়ারে বসেছিলেন নবনীতার ‘কবিদাদু’। ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটির মুখে আধো উচ্চারণে ও-কথা শুনে বকা দেওয়া তো দূরের কথা, বরং সমর্থন করে বলেছিলেন, ‘সত্যিই তো, পোলাও কই?’
সামনেই ছিলেন কবির ‘মামণি’, পুত্রবধূ প্রতিমা। মামণি ‘বাবামশায়’-এর হাতের ইশারায় কাছে আসেন। কবি কানে কানে তাঁকে কী যেন বলেছিলেন! পুত্রবধূ একমুহূর্ত দেরি না করে দৌড় দিয়েছিলেন রান্নাঘরে। নবনীতার লেখায় আছে, ‘একটু পরেই কেবল আমার একলার জন্যে ভুরভুরে গন্ধে ভরা রঙিন পোলাও এল। আমিও খুব আনন্দ করে নেমন্তন্ন খেয়ে নিলুম।’
সেদিন রবীন্দ্রনাথ প্রতিমা দেবীর কানে কানে বলেছিলেন ’ইন্সট্যান্ট পোলাও রান্নার রেসিপি’। চটজলদি পোলাও বানানোর সেই রাবীন্দ্রিক-রেসিপি কী ছিল, তা রাধারানি দেবীরও কানে গিয়েছিল। রেসিপি-রহস্য পরবর্তীকালে তিনি জানিয়েছিলেন কন্যা নবনীতাকে। নবনীতা দেবসেন তাঁর স্মৃতিচর্চায় জানিয়েছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছেলের বউ শ্রীমতী প্রতিমা দেবীকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন কানে কানে। …..কমলালেবুর গোটা কয়েক কোয়ার পাতলা খোসাটি ছাড়িয়ে নিয়ে তার ভিতরের ছোট্টো ছোট্টো কমলা নরম কোষগুলি এক মুঠো ভাতের সঙ্গে মেখে তাতে ভালো ঘি, নুন, চিনি আর বাদাম, কিসমিস মিশিয়ে বেড়ে দাও। প্রতিমা দেবী তাই দিয়েছিলেন। আমি পরে আমার মেয়েদের করে দিয়ে দেখেছি সত্যি সত্যি পোলাওয়ের মতোই লাগে।’
পোলাও গরিবগুর্বো পেলে আহ্লাদে আটখানা হয়েই খাবে! অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে কবিকণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল, ‘আমি তোমাদেরই লোক’। বড়োলোকি-খাবার বানানোর রেসিপি যেমন জানতেন তিনি, তেমনই জানতেন গরিবজনের ‘সুলভ-খাদ্য’ সুস্বাদু করে তোলার রেসিপি ।
ছাতু সহজে পেট ভরানোর ক্ষেত্রে শুধু উত্তম নয়, অতুলনীয়ও বটে ! ভরপেটে ছাতু-গোলা বা ছাতু-মাখা খেয়ে কত মানুষই তো দিনযাপন করে! রবীন্দ্রনাথ ছাতু-মাখার যে কায়দাকানুন জানিয়েছিলেন, তা কতখানি গরিবগুর্বো সাধারণজনের আয়ত্তাধীন, সে-প্রশ্ন অবশ্য রয়েই যায়। গরিবের খাবারের এক রাজসিক-সংস্করণ রবীন্দ্রনাথের হস্ত-নৈপুণ্যে সম্ভব হয়েছিল, সে আখ্যান আমাদের জানিয়েছেন মৈত্রেয়ী দেবী। কবির পাহাড়বাসের এক মনোরম স্মৃতিকথা রচনা করেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ মৈত্রেয়ীকে বলেছিলেন, ‘আচ্ছা, তোমরা ছাতু খাও না কেন? ছাতু জিনিসটি ভালো, আর তেমন করে মাখতে পারলে অতি উপাদেয় ব্যাপার হয়। এক সময়ে ভালো ছাতু মাখিয়ে বলে আমার নাম ছিল …..।’
‘ভালো ছাতু মাখিয়ে’ হিসেবে পরিবারজীবনে নামডাক হয়েছিল। ‘মেজদা’ সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন কবির হাতে মাখা ছাতুর পরম গুণগ্রাহী। সে কথা জানার পর রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে মংপু-পাহাড়ে মৈত্রেয়ী-গৃহে শুরু হয়েছিল ছাতু মাখানোর প্রস্তুতি।
বিশ্বখ্যাত রবীন্দ্রনাথ ছাতু মেখে খাওয়াতে সম্মত, এ-সংবাদ সত্যিই তো বিস্ময়ের উদ্রেক করে! মৈত্রেয়ীর কাছে যা ছিল কষ্টকল্পিত, তা নিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ-পোষণ, তৎপরতা, এসব ভাবতেও পারেননি তিনি।
রবীন্দ্রনাথ মৈত্রেয়ী দেবীকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। স্নেহকাতর কবি তাঁর ডাকে চারবার ছুটে গিয়েছিলেন মংপুতে। দার্শনিক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের কন্যা মৈত্রেয়ীর সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. মনোমোহন সেনের। মনোমোহন কর্মসূত্রে সপরিবারে থাকতেন মংপুতে। যুক্ত ছিলেন ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক তৈরির কর্মকাণ্ডে।
কবি ছাতু মেখে খাওয়াবেন, এ তো আর চাট্টিখানি কথা নয়! তখুনি শুরু হয়েছিল ছাতুর খোঁজাখুঁজি। সিনকোনা থেকে কুইনিন তৈরির কাজে যুক্ত মনোমোহন সেন ও তাঁর স্ত্রী মৈত্রেয়ী দেবী সমস্ত প্রভাব খাটিয়ে, বিস্তর খোঁজাখুঁজি করেও শেষপর্যন্ত মংপুতে যবের ছাতু জোগাড় করতে পারেননি। শেষে যবের বদলে মুড়ির ছাতু। সে ছাতু যে বাড়িতেই তৈরি হয়েছিল, তা বলাই বাহুল্য। মৈত্রেয়ী লিখেছেন, ‘মারমালেড এল, গোল্ডেন সিরাপ এল, আদার রস, দুধ, কলা, মাখন প্রভৃতি যেখানে যা আছে সব ছাতুর উপর পড়তে লাগল, আর মাখা চলল আধঘণ্টা ধরে।’
কবির ছাতু-মাখা সবার অবশ্য ভালো লাগেনি। তা বুঝতে পেরে রবীন্দ্রনাথ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুরে বলেছিলেন, ‘তোমাদের ছাতুর দোষ গো ছাতুর দোষ, তা না হলে ভালো না হয়েই যায় না! মেজদার টেবিলে সবাই তো উৎসুক হয়ে থাকতেন ….।’ পরে অবশ্য ‘যব ভাজিয়ে যাঁতায় গুঁড়ো’ করে আবার ওইভাবেই রবীন্দ্রনাথ ছাতু মেখেছিলেন।
পোলাওয়ের রেসিপি বলে দেওয়া বা অভিনব পদ্ধতিতে নিজের হাতে সুস্বাদু ছাতু-মাখা শুধু নয়, বিশ্ববন্দিত কবি এক সময়ে রান্নাঘরে গিয়ে রন্ধন-পটিয়সী স্ত্রীর পাশে মোড়া নিয়ে বসতেন। মৃণালিনী দেবীর রন্ধনকুশলতার জুড়ি ছিল না। তাঁর হাতের দইয়ের মালপো খেয়ে অভিভূত হয়েছিলেন নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ। কত কী তিনি বানাতেন রবীন্দ্রনাথের জন্য। কবির ভোজনরসিকতাকে স্বীকৃতি দিয়ে বানাতেন রকমারি মিষ্টিও। পত্নী-বিয়োগের পর একদিন ঘরে তৈরি মিষ্টি প্লেটে দিতেই কবি বলে উঠেছিলেন, ‘ঘরের মিষ্টি আর আমার দরকার নেই।’ বলাই বাহুল্য, স্ত্রীর মিষ্টি তৈরির কথা ভেবে সে-মুহূর্তে কবি বেদনাকাতর হয়ে পড়েছিলেন।
মৃণালিনী দেবীর দইয়ের মালপো শুধু নয়, চিঁড়ের পুলি ও পাকা আমের মিঠাইয়ের সুখ্যাতি ছিল। এমনকি শিঙাড়া-নিমকি-কচুরিও বানাতেন চমৎকার।
অভিধানকার হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন আশ্রম-শিক্ষক। দৈনন্দিন নানা ঘটনার সাক্ষী। তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, রন্ধনদক্ষ স্ত্রীকে ‘সুদক্ষ’ করে তোলার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের চেষ্টার ত্রটি ছিল না। হরিচরণ লিখেছেন, ‘…মোড়ায় বসিয়া তিনি নূতন রকমের রান্নার ফরমাশ করিতেন, মাল-মশলা দিয়া নূতন প্রণালীতে পত্নীকে রান্না শিখাইয়া শখ মিটাইতেন …।’
শখ মেটানোতেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। রসিকতাও করছেন কবি। বলছেন, ‘দেখলে, তোমাদেরই কাজ, তোমাদের কেমন এই একটা শিখিয়ে দিলুম।’ কবির কথায় তাঁর রন্ধনকুশলতা নিয়ে অহমিকা গোপন থাকেনি। অনায়াসে কবিপত্নী পরিবেশটিকে সহজ করে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘তোমাদের সঙ্গে পারবে কে ! জিতেই আছো সকলে।’
যে হাতে কলমই মানায়, সে হাতে রবীন্দ্রনাথ সানন্দে হাতা-খুন্তিও তুলে নিতেন। লেখার ক্ষেত্রে স্তব্ধ হয়ে কখনও থমকে দাঁড়াননি। নতুন, নতুনতর পথ অন্বেষণ করেছেন। চলেছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। কবির রন্ধনচর্চাও ছিল পরীক্ষা-নিরীক্ষাময়। নিজের মতো করে অভিনব ব্যঞ্জন উদ্ভাবন করেছেন। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘পত্নীর ন্যায় কবিরও নূতন নূতন খাদ্য আবিষ্কারের শখ ছিল নিতান্ত কম না।’
এই শখ আকস্মিক নয়, অনেক দিনের। রবীন্দ্রনাথ রন্ধনপ্রণালী লিখে রাখতেন একটি খাতায়, সে খাতা জমা থাকতো মৃণালিনী দেবীর কাছে। মৃণালিনী দেবীর কাছেৃ রক্ষিত খাতাটির আর খোঁজ মেলেনি। রবীন্দ্রনাথ শুধু জানতেন, খাতা হারানোর কথা। না, রবীন্দ্র-গবেষকরা কেউই পরবর্তীকালে সেই হারানো খাতার সন্ধান পাননি।
রবীন্দ্রনাথ জীবনের বেলা শেষে, মংপু বাসকালে ফিরে গিয়েছেন সুদূর অতীতে। মনে পড়েছে, এক সময় রান্নাতেও তিনি কুশলতার পরিচয় দিয়েছিলেন। দিনগুলি তখন নানা রঙের, আনন্দময়। সেই আনন্দস্মৃতিতে ডুব দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ফিরে পেয়েছিলেন হারানো অতীত। আচ্ছন্ন হয়েছেন স্মৃতিকাতরতায়। মনে পড়েছে মৃণালিনীর কথা, বউঠান জ্ঞানদানন্দিনীর কথা। রবীন্দ্রনাথ স্বহস্তে কত কিছু তৈরি করেছেন সেসময়। রান্না করে আনন্দ, খাইয়ে বরং বেশি আনন্দ। মৈত্রেয়ী দেবীর কাছে সেই আনন্দস্মৃতি উগড়ে দিয়ে কৌতুকচ্ছলে সাবধানবাণীও শুনিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। মৈত্রেয়ীকে বলেছেন, ‘তোমার অতিথিদের যদি একবার এ সবের স্বাদ দেখাও তাহলে আর তারা নড়তে চাইবে না।’
এমন লোভনীয় কী সেই ব্যঞ্জন! মাছের কচুরি ও জ্যামের প্যারাকী তাঁর হাতে কত সুস্বাদু হয়ে উঠতো সে কথা মৈত্রেয়ী দেবীকে জানাতে গিয়ে জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর প্রসঙ্গও এসেছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দিয়েও রকমারি ব্যঞ্জন প্রস্তুত করাতেন। মৈত্রেয়ীকে বলেওছিলেন, ‘আমি যখন মেজদার ওখানে ছিলুম তখন বৌঠাকরুনকে দিয়ে নানা রকম experiment করিয়েছি। ’
আসলে রান্নাকে ঘিরে রবীন্দ্রনাথের মনে এক ভিন্নতর ‘প্যাশন’ ছিল। তাই রান্না নিয়ে বিভিন্ন সময় রকমারি ‘এক্সপেরিমেণ্ট’ করেছেন। নিজে করেছেন, বউ ও বউঠানকে দিয়ে করিয়েছেন।
মজা করে গজা খাওয়ার স্মৃতি অনেকের মনেই জেগে আছে। মানকচুর জিলিপি বানানোর কথা কারও জানা আছে? হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ মানকচুর জিলিপিও বানাতে পারতেন। পুত্র রথীন্দ্রনাথের লেখায় আছে সে সাক্ষ্য। তিনি লিখেছেন, ‘একদিন বাবা যখন মাকে মানকচুর জিলিপি করতে বললেন, মা হেসে খুব আপত্তি করলেন, কিন্তু তৈরি করে দেখেন এটাও উৎরে গেল। সাধারণ জিলিপির চেয়ে খেতে আরও ভালো হল। বাবার এই রকম নিত্য নূতন ফরমাশ চলত, মা-ও উৎসাহের সঙ্গে সেই মতো করতে চেষ্টা করতেন।’
শুধু জিলিপি নয়, তৈরি হতো রকমারি মিষ্টি। তৈরি হতো রবীন্দ্রনাথের রেসিপি মেনে। সে সব মিষ্টির নামকরণও করে দিতেন কবি। কবিপুত্রই জানিয়েছেন, ‘বাবার ফরমাশ মতো নানা রকম নতুন ধরণের মিষ্টি মাকে প্রায়ই তৈরি করতে হতো। সাধারণ গজার একটি নতুন সংস্করণ একবার তৈরি হল, তার নাম দেওয়া হল ‘পরিবন্ধ’। এটা খেতে ভালো, দেখতেও ভালো। তখনকার দিনে অনেক বাড়িতেই এটার বেশ চলন হয়ে গিয়েছিল।’
মৃণালিনীর সঙ্গে কবির সম্পর্ক-শীতলতা নিয়ে মনগড়া গল্পের শেষ নেই । মৃণালিনী দেবীর জীবনদীপ যেদিন নিভে যায়, সেদিন শোকমূহ্যমান কবি সারা রাত ছাদে পায়চারি করেছিলেন। এরপর আমিষ ত্যাগ করে কবি নিরামিষভোজী হয়ে উঠেছিলেন। অনেকদিন পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ আর মাছ-মাংস ছুঁতেন না। রান্নাঘর ঘিরে কবির যে আগ্রহ, তা ফিকে হয়ে যায়। নতুন, নতুনতর ব্যঞ্জন-প্রস্তুতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় প্রায় ছেদ পড়ে।