কর্মপ্রার্থীদের ধৈর্য্য ধরতে হবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। নিকটস্থানীয় কারও প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। পুরোনো কোনও বন্ধুর ... বিশদ
এক সময় গয়নাই ছিল মেয়েদের একমাত্র স্ত্রীধন। সম্পদে, বিপদে, আপদে এই গয়নাই ছিল মেয়েদের বড় সহায়। তাছাড়া সচ্ছল ধনী পরিবারে তো বটেই, গৃহস্থ সংসারেও গয়না ছাড়া মেয়েদের ভাবাই যেত না। বারো মাস মেয়েদের গায়ে আটপৌরে গয়না ছিল চুড়ি, বালা, গলার হার, কানের দুল। তার সঙ্গে অবস্থা অনুসারে পোশাকি গয়নার সম্ভার। পুজো, বিয়ে, বউভাত বা অন্যান্য উপলক্ষে নিমন্ত্রণ যাবার জন্য ভারী সোনার গয়না আর জড়োয়া গয়না, হীরে, মুক্তো, চুনি, পান্না, নীলা, প্রবাল— দামি পাথর খচিত গয়না। জড়োয়া গয়না ছিল আভিজাত্য, বনেদিয়ানার প্রতীক। যে পরিবারের বিত্ত সম্পত্তি বেশি, সে পরিবারের মেয়ে-বউদের থাকত গা ভরা, বাক্স ভরা গয়না। পরিবারের অর্থ কৌলীন্য ঠিকরে পড়ত জড়োয়া গয়নার দামি পাথরের দ্যুতিতে।
দ্বারকানাথ ঠাকুরের পরিবারে সৌভাগ্য লক্ষ্মী হয়ে এসেছিলেন বড় পুত্রবধূ সারদা। দেবেন্দ্রেনাথের বিয়ের পর দ্বারকানাথের আর্থিক ও সামাজিক প্রতিপত্তির সীমা ছিল না। তাই তিনি খুশি হয়ে পুত্রবধূকে কিনে দিয়েছিলেন লক্ষ টাকা দামের জড়োয়া খেলনা। যাঁর জড়োয়া খেলনাই ছিল এত দামের তাঁর জড়োয়া গয়না ছিল কেমন, তা সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু তাঁর গয়নার কথা কেউ লেখেননি। কেবল এক পুত্রবধূ প্রফুল্লময়ী লিখেছেন, সারদার একটি জড়োয়া নথের কথা। বিয়ের পর বাপের বাড়ি যাবার সময় প্রফুল্লময়ীকে নিজের গয়না পরিয়ে সাজিয়ে দিচ্ছিলেন সারদা। একটি ভারী চুনি, মুক্তোর নথ পরানোর সময় পুত্রবধূর লাগছে দেখে বিরত হন। প্রফুল্লময়ী লিখেছেন, নথের চুনি, মুক্তোর দাম ছিল দু’হাজার। (ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়)।
দ্বারকানাথের পরিবারে একটি পারিবারিক মূল্যবান গয়না ছিল— ‘হিরের কণ্ঠি’, যেটা পরে বাড়ির ছেলেবাবুরা ‘রাজপুত্র সেজে’ বিয়ে করতে যেতেন। একথা জানিয়েছেন দেবেন্দ্রনাথের মেজ ছেলে সত্যেন্দ্রনাথের মেয়ে ইন্দিরা। আর দেবেন্দ্রনাথের সেজ ছেলে হেমেন্দ্রনাথ নিজেই লিখে গিয়েছেন, তিনি— ‘হিরের কণ্ঠি, মুক্তোর মালা ও জড়োয়া আংটি পরে’ বিয়ে করতে গিয়েছিলেন।
সেই হিরের কণ্ঠিটি দেবেন্দ্রনাথ উপহার দিয়েছিলেন তাঁর মেজ পুত্রবধূ জ্ঞানদানন্দিনীকে। কারণ তাঁর স্ত্রী সারদা ছোট মেয়েদের বিয়েতে জ্ঞানদানন্দিনীর গয়না দিয়ে দিয়েছিলেন। ইন্দিরা লিখেছেন, সেই হিরের কণ্ঠি— ‘মাটো মাটো ঘষা সোনার ফুলপাতার মধ্যে এক একটি হিরে বসানো’ ছিল। সেটিকে সেকালের বিখ্যাত মণিকার— ‘হ্যামিলটনের বাড়ি থেকে বিলিতি ফ্যাশনের মালা ও দু’খানি চূড় করানো হয়েছিল।’ নিজের জড়োয়া গয়নার প্রসঙ্গে ইন্দিরা লিখেছেন অনেক কথা।
পিতৃবন্ধু তারকনাথ পালিত ইন্দিরাকে জন্মদিন ইত্যাদি নানা উপলক্ষে অনেক সুন্দর দামি উপহার দিতেন। ‘হিরে ও নীলার ব্রেসলেট’। ‘হিরে বসানো ঘড়ি’ প্রভৃতি। বিয়ের সময় ইন্দিরাকে অন্যান্য গয়নার সঙ্গে বাবা-মা একটি জড়োয়ার ব্রোচ উপহার দিয়েছিলেন ‘প্ল্যাটিনামের ওপর হিরে বসানো ফুল পাতা নকশার ব্রোচ। তার বড় ফুলটা কাঁপত।’ নাটোরের মহারাজা ইন্দিরার বিয়েতে উপহার দেন দুটো জড়োয়ার ব্রেসলেট, দুটো দু’রকমের। আর ভাবী স্বামী প্রমথনাথ চৌধুরি যে সব উপহার দেন তার মধ্যে ছিল— ‘নীলাতে মুক্তোতে গাঁথা বেশ সুন্দর একটি চিক।’
বিদুষী দৌহিত্রী সরলাকে তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতি জানিয়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর উপহার দিয়েছিলেন, ‘চুনি ও হিরের নেকলেস ও ব্রেসলেট’। দেবেন্দ্রনাথের কথামতো— তাঁর প্রিয় কবি হাফেজের কবিতায় সুর বসিয়ে গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন সরলা। তাই এই পুরস্কার।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, তার সুন্দরী ঠাকুরমা যোগমায়ার অনেক গয়না ছিল তাঁর মা সৌদামিনীর কাছে। উত্তরাধিকার সূত্রে অবনীন্দ্রনাথও পেয়েছিলেন তাঁর ঠাকুমার জড়োয়া সিঁথি। হিরে মুক্তো দেওয়া কানঝাপটা ইত্যাদি। একটি সুন্দর জড়োয়া ব্রোচ নিজের নকশা করে স্ত্রী সুহাসিনীকে গড়িয়ে দিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। তাঁর কাছে ছিল একটি মোহর। মোহরের একদিকে ছিল জাহাঙ্গির অন্য দিকে নূরজাহানের ছবি। একটি বড় পান্না কিনেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। তিনি জানিয়েছেন, ‘এই মোহর আর পান্না দিয়ে একটি ব্রোচ করালুম আমাদের বিশ্বস্ত জহুরীকে দিয়ে। সেই পান্নাটির চারধারে ছোট ছোট মুক্তো আর মোহরটি ঝুলছে পান্নাটির নীচে।’
গগনেন্দ্রনাথের বড় মেয়ে সুনন্দিনীর বিয়ের হিরের গয়না তৈরি করানো হয়েছিল নামকরা মণিকার ‘কুক অ্যান্ড কেলভি’র দোকান থেকে। আবার এই হিরের গয়নার হিরে আসল না পোখরাজ— এই নিয়ে আত্মীয় মেয়ে মহলে খুব তর্ক হয় ও একশো টাকা বাজি ধরা হয়। গয়নার হিরে যাচাই করার জন্য উক্ত মণিকারের দোকানেই পাঠানো হয়। তখন দোকান থেকে জানানো হয় গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। সুনন্দিনীর শ্বশুর এ কথা জানতে পেরে বাড়ির মেয়েদের খুবই বকাবকি করেন। গগনেন্দ্রনাথের বড় ছেলে গেহেন্দ্রর বিয়ে খুব ঘটা করে হয়েছিল। বউ আনার সময় গগনেন্দ্র জননী সৌদামিনী বার করে দিয়েছিলেন তাঁর নিজের ‘মুক্তো সাতলহর, হিরের কণ্ঠা, হিরের কান’ ইত্যাদি সেকালের ভারী গয়না— বউকে সাজিয়ে আনার জন্য।
সুগায়িকা সাহানা তাঁর মামা চিত্তরঞ্জন দাশকে তাঁর লেখা একটি গানে সুর বসিয়ে মামাকে শুনিয়ে খুশি করেছিলেন। চিত্তরঞ্জন তাঁর ভাগ্নিকে হিরের নেকলেস কিনে দেবেন বলেছিলেন। মামাবাবুর সঙ্গে মণিকার সতরাম দাস ধলমল-এর দোকানে গিয়ে হিরের নেকলেস কেনেননি সাহানা। মামাতো বোন মোনার সঙ্গে রেষারেষি করে কিনেছিলেন বড় বড় মুক্তো ঝোলানো মুক্তোর নেকলেস। হিরের একটি আংটিও কিনে দেন মামাবাবু চিত্তরঞ্জন। তবে মৃদু বকুনি খান মামীমা বাসন্তীদেবীর কাছে। ‘মামা দিতে গেলেন হিরের নেকলেস আর মেয়ে আমার মনের আনন্দে মুক্তোর একটা নেকলেস নিয়ে এল। তুই কি রে?’
আর এক সেকালিনী সীমন্তিনী কৈলাসবাসিনীর (ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কিশোরী চাঁদ মিত্রর স্ত্রী) গয়নার তালিকা— একালিনীর কাছে রূপকথার মতো মনে হয়। প্রচুর সোনার গয়নার সঙ্গে অনেক জড়োয়া গয়নাও ছিল তাঁর। ‘জড়োয়া চিক, ন’র মুকুতা, দো-এর মুকুতা, মুকুতার কন্টি... কানে মুকুতার গোচা ও কান। শাশুড়ি সাদে (সাধে) দেন হিরের পৈঁচা, পিতাঠাকুর দেন হিরের কান ও কানবালা।’
লেখিকা জ্যোতির্ময়ীদেবী ও তাঁর দিদির বিয়ে হয় একই সঙ্গে। অনেক সোনার গয়না যৌতুক দেওয়া হয়েছিল তাঁদের। আর ছিল জড়োয়ার— ‘মুক্তো মীনার সরস্বতী হার— জড়োয়া নেকলেস ইত্যাদি।
গবেষক ও শিক্ষাব্রতী ভারতী রায় লিখেছেন, তাঁর প্র-মাতামহী শৈলবালার জড়োয়া গয়নার কথা। রুবি পান্নাখচিত নেকলেস, জড়োয়া কানবালা? বিয়ের যৌতুক ছিল। ভারতী রায়ের মায়ের বিয়েতে অর্থাৎ নাতনিকে শৈলবালা দিয়েছিলেন ‘রুবির জড়োয়া নেকলেস, রুবি বসানো ময়ূর ডিজাইনের ঝোলানো দুল, রুবির খামি যুক্ত— মুক্তার দস্তানা।’
লীলা মজুমদার জানিয়েছেন তাঁর মায়ের কথা। ‘অনাথা মেয়েকে স্বামী ছাড়া কে আর গয়না দেবে? তাঁর বাবা প্রমদারঞ্জন নিজে নকশা করে স্ত্রীকে গড়িয়ে দিয়েছিলেন— ‘হিরে মুক্তোর নেকলেস, কানের জন্য হিরের ফুল, একটা হিরের আংটি।’
বিজয়া রায়ের লেখায় জানা যায়, তাঁর শাশুড়িমা সুপ্রভা তাঁর বিয়ের সময় বিজয়ার হাতে তুলে দিয়েছিলেন নিজের গয়নার বাক্স। অনেক সোনার গয়নার সঙ্গে সে বাক্সে ছিল ‘রুবি, মুক্তোর নেকলেস। ... ম্যাচ করা রুবি, মুক্তো, চুড়ি ও ব্রেসলেট, একজোড়া অপূর্ব সুন্দর হিরের দুল।’
শিল্পী মুকুল দে’কে গুরু অবনীন্দ্রনাথের স্ত্রী সুহাসিনী বলেছিলেন, তাঁর স্ত্রী বীণাকে উৎসব বাড়িতে পরার জন্য জড়োয়া গয়না কিনে দিতে। বীণাকে মুকুল জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘জড়োয়া গয়না কাকে বলে?’ বীণা হেসে বলেছিলেন, ‘আর্টিস্ট, তাও জান না? ছবির মেয়েদের গায়ে তো অনেক জড়োয়া পরাও। লাল, নীল, সবুজ, সাদা— কত কি! হিরে, মুক্তো, চুনি, পান্না বসানো গয়নাকে জড়োয়া বলে।’ সুহাসিনীর কথামতো— ‘সাধ্যমতো দামের মধ্যে একজোড়া চুনি, মুক্তো বসানো চুড়ি, আর জয়পুরি মিনার কাজ করা লকেট ও ফুল দেওয়া ছোট্ট ছোট্ট মুক্তোর বসানো তিন লহর মুক্তোর নেকলেস কিনেছিলেন বীণা। সাতরাম দাস মণিকারের কাছ থেকে। কানের জন্য তিনি বিয়েতে পাওয়া উপহার— ‘পান্না পোখরাজের ইয়ারিং’। জড়োয়া আংটির প্রসঙ্গ বাঙালির জীবন ও সাহিত্য অনেকখানি জায়গা জুড়ে আছে। অবনীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, তাঁর বাবার আংটি ছিল ‘বনস্পতি’ হিরে বসানো। প্রমথনাথ বসু— তাঁর ভাবী স্ত্রী রমেশচন্দ্র দত্তর বড় মেয়ে কমলার আঙুলে পরিয়ে দিয়েছিলেন হিরের আংটি— যাতে সবাই বুঝতে পারেন তাঁদের কথা। ধনী চূড়ামণি দত্তর মেয়ে আঙুলে এমন এক দামি পাথরের আংটি পরে এসেছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বী পরিবারের উৎসব বাড়িতে— যার আভায় সেই উৎসব বাড়ির শামিয়ানার রং বদলে গিয়েছিল!
গয়না নিয়ে কত বিস্ময়, কত চমক, কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি! লীলা মজুমদার তাঁর পিসতুতো দিদি হেমেন্দ্রমোহন বসুর মেয়ে মালতীদির একটি ব্রুচ ছিল। তাতে মস্ত একটা মুক্তোর ভেতর আলো জ্বলত। ব্রুচের তলায় ছোট্ট ব্যাটারি। ব্রুচ লাগালেই আলো জ্বলত। এর চাইতে বড় মানুষি আমরা ভাবতে পারতাম না।’
যদুলাল মল্লিকের স্ত্রী সরস্বতীর অনেক গয়নার মধ্যে একটি জড়োয়া নথ ছিল। ১৮৯৩ সালেই সেই নথটির দাম ছিল পঁচিশ হাজার। মায়ের এই নথটির মালিকানা দাবি করে তাঁর ছেলেরা আদালতের শরণ নিয়েছিলেন।