যে কোনও ব্যবসায় অগ্রগতি আশা করা যায়। মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের কর্মের প্রয়োগ পদ্ধতি নিয়ে সমস্যা হতে ... বিশদ
বড়মায়ের ঘরের বারান্দার গ্রিলে ঝুলছে লোহার চেনে লাগানো মস্ত একটা তালা। দিন কয়েক আগেই এই ঘরের দখল নিয়েছেন বিজেপির বনগাঁর প্রার্থী শান্তনু ঠাকুর। আগে ঘরটি ছিল তাঁর রাজনৈতিক এবং পারিবারিক প্রতিদ্বন্দ্বী মমতাবালা ঠাকুরের দখলে। নির্বাচনের আগে বিতর্ক এড়িয়ে চলাই প্রথা। পাছে ক্ষুণ্ণ হয় ভাবমূর্তি। কিন্তু শান্তনু ঠাকুর সে সবের ধার ধারেন না। তিনি খুব ভালো করেই জানেন, ঘি তুলতে আঙুল বাঁকাতে হয়। সেটা দাদার জন্য বিধানসভার টিকিট বা কেন্দ্রের মন্ত্রিত্বই হোক, অথবা পারিবারিক ঘর।
ঠাকুরবাড়িকে রাজনীতিমুক্ত করার হুঙ্কার দিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন শান্তনুবাবু। এখন সেই ঠাকুরবাড়িতে দু’জন বিজেপির জনপ্রতিনিধি, একজন তৃণমূলের। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, বনগাঁ, রানাঘাট, কৃষ্ণনগর লোকসভা আসনের ভাগ্য নির্ধারিত হয় মতুয়া ভোটে। ঠাকুরবাড়িকে ঘিরেই আবর্তিত হয় এই এলাকার রাজনীতি। সেই ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে কোনও জনপ্রতিনিধির, এমনকী তাঁদের হয়ে কথা বলার মতো কারও দেখা মিলল না। অগত্যা ভোটের ‘হাওয়া’ বোঝার জন্য চায়ের দোকানই ভরসা।
ঠাকুরবাড়ির গেটেই দুলাল হালদারের চায়ের দোকান। দোকানের সামনে বেঞ্চে বসেছিলেন কয়েকজন। সবচেয়ে যিনি প্রবীণ তাঁর নাম চিত্তরঞ্জন মণ্ডল। বয়স ৮৮। ভোটের খবর জানতে চাওয়ায় এক যুবক চোখের ইশারায় চিত্তরঞ্জনবাবুকে দেখালেন। এই বয়সেও সকাল, বিকেল লাঠিতে ভর দিয়ে তাঁর মন্দিরে আসা চাই-ই চাই। চিত্তরঞ্জনবাবু একসময় বড় মা বীণাপাণিদেবীর কাছের মানুষ ছিলেন। ঠাকুরবাড়ির আদর্শ, ধর্মীয় আবেগ, ঘরোয়া রাজনীতি, পরিবর্তন, সবই দেখেছেন খুব কাছ থেকে।
মতুয়া ভোট কোন দিকে, এই প্রশ্ন শুনে চিত্তরঞ্জনবাবু প্রায় কেঁদে ফেললেন। বললেন, মতুয়ারাও ভোটব্যাঙ্ক হয়ে গেল! হায় রে রাজনীতি! অথচ বড়মা কী বলত জানেন? মানবসেবাই মতুয়াদের ধর্ম। নামে ও প্রেমে যে মাতোয়ারা সেই হল মতুয়া। কেউ এলেই মা বলত, আগে খাইয়ে দে। নাতিপুতি কেউ যেন অভুক্ত না থাকে। মানবসেবাই ছিল মায়ের লক্ষ্য। আর এখন? দখলদারি চলছে। এখন নাম আছে, কিন্তু প্রেম কোথায়? এসব একদম ভালো লাগে না। মন খারাপ হয়ে যায়। জানি না, এর শেষ কোথায়?
এরই মধ্যে কেউ প্রাইভেট কার নিয়ে, কেউ বাইকে চেপে মন্দিরে আসছেন। হরিচাঁদ, গুরুচাঁদ ঠাকুরের মন্দিরে প্রণাম করে কিছুক্ষণ কাটিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। বাইক নিয়ে মন্দির চত্বরে এলেন এক যুবক। লম্বা চুল, কপালে তিলক। হরিচাঁদ ঠাকুরের ভক্ত। বাড়ি রানাঘাটের চাকদহে। নাম কিশোর। রানাঘাটে প্রচুর মতুয়ার বাস। মতুয়া ভোট এবার কোনদিকে যাবে? যুবক হেসে বলেন, ‘আমরা ধর্ম নিয়ে থাকি, রাজনীতির চর্চা তেমন করি না। তবে, এবার যা অবস্থা তাতে ভোট কোনও একদিকে যাবে না। লোকজনের মুখে ভাগাভাগির কথা।’
ঠাকুরবাড়ির নিজেদের ভাগাভাগি নাকি
মতুয়া ভোটের বিভাজন, সেটা কিশোর স্পষ্ট করলেন না। এই ভাগাভাগিতে জুড়ে গিয়েছে সুমিতা
পোদ্দারের নাম। সুমিতা শুধু মতুয়া পরিবারের
সন্তানই নন, ঠাকুরবাড়ির উন্নয়নে তাঁর দাদু নির্মল পোদ্দারের ভূমিকা এখনও মানুষ মনে রেখেছে। সেই সুমিতাদেবীই এবার সরাসরি শান্তনু ঠাকুরকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসেছেন।
সুমিতাদেবীর কথায়, আমরা ঠাকুরবাড়ির উন্নতি চাই, হরিচাঁদ ঠাকুরের বংশধরদের নয়। হরিচাঁদ ঠাকুর, গুরুচাঁদ ঠাকুর গরিব মতুয়াদের উন্নতির জন্য কাজ করে গিয়েছেন। তাই তাঁরা আমাদের কাছে ভগবান। কিন্তু যাঁরা ঠাকুরবাড়িকে রাজনীতিমুক্ত করার ডাক দিয়েছিলেন, তাঁরা কী করছেন? মন্দিরের সামান্য উন্নতিও করেননি। নিজেদের উন্নতি করছেন। বারাকপুরে বিপুল টাকা দিয়ে নিজের আর স্ত্রীর নামে ফ্ল্যাট কিনেছেন। আমরা এই উন্নতি চাই না। আমরা মতুয়ারা ঠাকুরবাড়ির প্রকৃত উন্নতি চাই।
হরিচাঁদ, গুরুচাঁদের উত্তরাধিকারী হিসেবে মতুয়া সমাজের অনেকেই তাঁকে ‘ঠাকুর’ মানেন। এফিডেভিটেও শান্তনুবাবু জানিয়েছেন, তিনি ধর্মগুরু। আয়ের উৎস প্রণামী। এহেন শান্তনুবাবু ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে বারাকপুরে ৩১১১ বর্গফুটের একটি বিশাল ফ্ল্যাট কিনেছেন। সঙ্গে দু’টি গ্যারেজ। যার দাম ১কোটি ৯ লক্ষ ৩৩ হাজার টাকা। বিষয়টি সামনে আসায় মতুয়াদের মধ্যে শুরু হয়েছে জোর চর্চা। শান্তনুবাবুর বিরোধীরাও প্রণামীর টাকা মন্দিরের উন্নতিতে খরচ না করে ব্যক্তিগত ফ্ল্যাট কিনেছেন বলে প্রচার চালাচ্ছেন।
বাম রাজনীতি থেকে উঠে আসা দেবদাস মণ্ডল এখন বনগাঁ বিজেপির জেলা সভাপতি। সিপিএম করার সুবাদে রাজনীতির মারপ্যাঁচ ভালোই বোঝেন। তাঁর শরীরে প্রাচুর্যের ছাপ স্পষ্ট। শান্তনুবাবুকে নিয়ে দলের নেতা কর্মীদের একাংশের মধ্যে চাপা ক্ষোভ থাকলেও দেবদাসবাবু শোনালেন অন্যকথা। তাঁর দাবি, নরেন্দ্র মোদির তো আছেই, শান্তনু ঠাকুরের ‘ফেসভ্যালু’ও কম নয়। শুধু বনগাঁ নয়, বারাসাত, রানাঘাট, কৃষ্ণনগর সহ বেশকিছু আসনে তাঁর জন্যই বিজেপি অনেকটা সুবিধা পাবে। হরিচাঁদ ঠাকুরের উত্তরসূরি হওয়ায় মতুয়ারা তাঁকে ‘দেবতা’ মানেন। যেখানে উনি প্রচার করতে যাচ্ছেন সেখানেই মতুয়ারা তাঁকে আরতি করে বরণ করছেন। ভক্তিভরে প্রণামী দিচ্ছেন। মতুয়াদের আবেগের কাছে বিরোধীদের সমস্ত অপপ্রচার ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাবে।
এবারের ভোটে শান্তনু ঠাকুরের জন্য বিজেপির যদি কেউ একশোভাগ উজাড় করে দিয়ে কাজ করেন তিনি অবশ্যই দেবদাস মণ্ডল। কিন্তু তাঁর দলের অনেক নেতা তেমন আন্তরিক নন। দলের চাপে মাঠে নামলেও মন আছে ভবিষ্যৎ রাজনীতির অঙ্কে। অঙ্ক না বলে ধন্দও বলা যায়। কী সেই ধন্দ? বিজেপি ঠাকুরবাড়িকে ব্যবহার করে দলের বিস্তার ঘটাচ্ছে, নাকি শান্তনু ঠাকুর দলকে কাজে লাগিয়ে নিজের প্রভাব বাড়িয়ে নিচ্ছেন!
আবেগের বাইরে গিয়ে বিজেপিতে যাঁরা মাথা খাটিয়ে রাজনীতি করেন তাঁরা বলছেন, একটা সময় শান্তনু ঠাকুরের বিজেপিকে প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে দিল্লি নেতৃত্বের আচরণে মনে হচ্ছে, শান্তনু ঠাকুরকেই দলের বেশি প্রয়োজন। তাঁর কোনও দাবিকে দল অস্বীকার করতে পারছে না। ফলে তিনি যাঁকে চাইছেন, যা চাইছেন, সেটাই হচ্ছে। তাতে দলের সংগঠন দানা বাঁধছে না। কারণ সবাই বুঝে গিয়েছেন, পঞ্চায়েত থেকে বিধায়কের টিকিট, সব ব্যাপারেই শেষকথা বলবেন শান্তনু ঠাকুর। আগামী দিনে তা আরও বাড়বে। বনগাঁয় বিজেপি জিতলেও তা গেরুয়া শিবিরের জয় হবে না, জিতবেন শান্তনু ঠাকুর। আর আশপাশে হেরে শুধু বনগাঁয় জিতলে তো কথাই নেই। শান্তনু ঠাকুর চলে যাবেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। দল হিসেবে বিজেপির এটাই সবচেয়ে ভয়ের ও চিন্তার।
বিজেপিকে ঠাকুরবাড়ির প্রভাব থেকে বের করে আনার লড়াইটা শুরু হয়েছে একুশেই। গাইঘাটা কেন্দ্রে চিকিৎসক সজল বিশ্বাসকে প্রার্থী হিসেবে চেয়েছিলেন স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্ব। কিন্তু শান্তনু ঠাকুরের চাপে তাঁর দাদা সুব্রত ঠাকুরকে বিজেপি টিকিট দিতে বাধ্য হয়েছিল। তখন থেকেই গাইঘাটা, বনগাঁর রাজনীতিকে ঠাকুরবাড়ির প্রভাবমুক্ত করার লড়াই শুরু।
সজলবাবু বলেন, আমাদের মতুয়াদের গুরু একজনই, হরিচাঁদ ঠাকুর। শান্তনুবাবু সহজসরল মানুষগুলোকে ধোঁকা দিয়ে ধর্মগুরু সাজতে চাইছেন। আমাদের লড়াইটা তার বিরুদ্ধে। আমরা জানি, একটা আঘাতে পাথর ভাঙা যায় না। কিন্তু অনবরত ঘা দিলে সেটা ভাঙবেই। আর ভাঙনের সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। নাগরিকত্বের ধোঁকা সেই ভাঙনকে আরও প্রকট করেছে।
হরিচাঁদ ঠাকুরের উত্তরসূরিদের প্রতি মতুয়াদের মোহভঙ্গ হবে কি না, সেটা সময়ের উপরে ছেড়ে দেওয়াই ভালো। তবে এলাকা ঘুরে মালুম হয়েছে, ‘ঠাকুর’ ভক্তি কিন্তু মাতৃদুগ্ধের মতো আর খাঁটি নেই।