আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় দিনটি শুভ। স্বামী/ পত্নী/ সন্তানের সঙ্গে আনন্দ উপভোগ। ... বিশদ
‘যোগ্যতা অনুযায়ী তুমি কিন্তু সেই স্বীকৃতি পেলে না। সমাজ ও জীবন থেকে তোমার যতটা পাওয়ার কথা, অতটা পেলে না। তোমাকে কেউ বুঝল না।’ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই ধরনের কথা শুনলে প্রত্যেক মানুষই খুব খুশি হয়। বঞ্চনার সাইকোলজি সর্বাগ্রে মানুষকে আচ্ছন্ন করে। সেই ফর্মুলা অনুযায়ী, মোদি ২০১৪ সাল থেকে ভারতবাসীকে বলে এসেছেন, অতীতের কোনও সরকার প্রকৃত
উন্নয়নের কাজ করেনি। মানুষের যা পাওয়া উচিত ছিল, সেটা পায়নি। আমরা দেশবাসীকে প্রকৃত
সম্মান দেব। সাধারণ মানুষের দেশের কাছে যেটা প্রাপ্তি সেটা পৌঁছে দেব। আগে কিছুই হয়নি।
এবার হবে। এই মনস্তত্ত্ব স্বাভাবিকভাবেই সিংহভাগ মানুষ পছন্দ করেছে।
মোদি আত্মবিশ্বাসী যে তিনি আর যাই হোক ভারতের বিরাট কোনও উন্নয়ন করতে পারবেন না। ন’ বছরে সাধারণ মানুষের তুলনায় মোদি নিজেও সেটা আরও বেশি করে বুঝে গিয়েছেন। তাই তিনি যেটা সবথেকে বেশি ভালো পারেন সেইসব দিকেই মনোনিবেশ করেছেন। দেশকে অঘোষিতভাবে হিন্দুরাষ্ট্র করে ফেলতে হবে। হিন্দুত্ব রাজনীতির হৃদয়সম্রাট হয়ে উঠতে হবে। নোট থেকে পার্লামেন্ট সব বদলে দিয়ে সর্বত্র নিজের ছাপ রেখে যেতে হবে। আর লাগাতার প্রচার করে যেতে হবে বিরাট উন্নতি হচ্ছে। ভারত পাল্টে যাচ্ছে। এই তো আর মাত্র কিছুদিন, তারপর ভারত বিশ্বগুরু হয়ে যাবে।
এবং সর্বোপরি ভারতের ইতিহাস পাল্টে দিতে হবে। ১৯৯০ সালের পর যাদের জন্ম তাদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান নেই। তাই যারা নতুন স্কুল কলেজে ঢুকছে তাদের যদি নতুন ইতিহাস পড়ানো শুরু করা যায়, তাহলে তারাই যখন বড় হবে তখন এই নতুন ইতিহাসকেই সত্য বলে ভাববে। পরবর্তী প্রজন্মকে সেই শিক্ষাই দেবে। একদিন হয়তো গডসে ও গান্ধীজির জীবনীও একই বইতে পড়ানো হবে। একই শ্রদ্ধার সঙ্গে।
নিজের ভক্ত ও সমর্থকদের মোদি সবথেকে ভালো চেনেন। একদল সমর্থক আছে যারা সরাসরি ধর্মের রাজনীতিকে সমর্থন করি বলতে লজ্জা লজ্জা পায়। তাই তারা ২০১৪ সাল থেকে বলে আমার কাছে বিজেপি কোনও ফ্যাক্টর নয়। আমি কিন্তু বিজেপির সমর্থক নই। আমার মোদির প্রতি একটা বিশ্বাস আছে। এই লোকটা কিছু একটা করতে পারবে। আর কেউ তো কিছুই করল না। এই লোকটির কথায় আশা জাগে। একটা কিছু হওয়া দরকার। ভারতের ইকনমি ঠিক হোক এটাই চাই। পাঁচ বছর কেটে যাওয়ার পর এই সমর্থককুল বলত, আরও কিছুদিন সময় দিতে হবে তো! এতকাল ধরে যা করে গেছে আগের সরকারগুলো, সেই জঞ্জাল সাফ করতেই তো পাঁচ বছর লাগবে। সেই সময় দেওয়া হল। এবার ১০ বছর হয়ে যাচ্ছে। এখন সেই সমর্থকরা বলে, অনেক পাল্টে গেছে দেশ। প্রচুর কাজ হচ্ছে। প্রশ্ন: মূল্যবৃদ্ধি? উত্তর: সে তো গোটা দুনিয়ায় হচ্ছে! প্রশ্ন: বেকারত্ব? উত্তর: আমেরিকা ব্রিটেনের অবস্থা তো ভারতের থেকেও খারাপ! প্রশ্ন: বিভাজন আর ঘৃণার রাজনীতি? উত্তর: দেশ চালাতে গেলে একটু শক্ত হাতে তো হাল ধরতেই হবে। আর কোনও একটি সম্প্রদায়ের প্রতি বেশি বেশি নরম মনোভাব তোষণ করা, ওটা ঠিক নয়। মোদিজি ব্যালান্স করতে জানেন। সুতরাং এই অংশটি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, ওসব উন্নয়ন অথবা কাজ কিংবা ভারতের অর্থনীতির বিরাট উন্নতি ঘটবে এসব ভেবে তাদের রাতের ঘুম হচ্ছিল না বলেই মোদিকে সমর্থন করেছেন, এরকম মোটেই নয়। তারা আসলে বিজেপির তো ভক্তই এবং শর্তহীনভাবে মোদির ভক্ত। আমরা উন্নয়নের পক্ষে বলে নিছক একটু স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করে। মিথ্যা ইতিহাস রচনা করা হচ্ছে, হোয়াটস অ্যাপ ইউনিভার্সিটির মাধ্যমে ফেক নিউজ ছড়ানো হয়, এসব নিয়ে উন্নয়নবাদী মোদিভক্তদের বিশেষ হেলদোল দেখা যায় না।
নতুন পার্লামেন্ট উদ্বোধনে কেন শুধুই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হিন্দু সাধু সন্ন্যাসীদের নিয়ে এসে হিন্দু ধর্মমতে যাগযজ্ঞ, পুজো করে মন্ত্র শ্লোক উচ্চারণের মাধ্যমে প্রায় নিজের রাজ্যাভিষেক করলেন মোদি, সেটা নিয়ে দেশজুড়ে বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছে। সমালোচনাও করা হচ্ছে। কিন্তু এটা ভেবে দেখা দরকার যে, মোদি আর কী করতে পারতেন? তিনি যদি হিন্দু মুসলিম পার্সি খ্রিস্টান বৌদ্ধ সকলকে
ডেকে সর্বধর্মসমন্বয়ের একটি ছবি উপহার দিতেন অথবা দেশের বেঁচে থাকা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের
নিয়ে এসে তাঁদের হাত দিয়ে উদ্বোধন করাতেন
কিংবা রাষ্ট্রপতি গোটা অধ্যায়ের মধ্যমণি, মোদি
নিছক একজন দর্শক— এরকম করতেন, সেটা কি তাঁর কাছে প্রত্যাশিত? এগুলো হলে আমরাই তো অবাক হতাম! আমরা তো জানি যে মোদি এরকম নয়। যা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাজ সেই নোটবাতিল ঘোষণা তিনি টানটান থ্রিলারের ভঙ্গিতে রাত ৮ টায় করেন। আবার পুরী হাওড়া বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের উদ্বোধনও তিনি করেন। সুতরাং সংসদ ভবন উদ্বোধন করার মতো হাই প্রোফাইল ইভেন্ট তিনি হাতছাড়া করবেন, এটা হয় নাকি? তাঁর ইমেজের সঙ্গে যা স্বাভাবিক সেটাই তিনি করেছেন।
সংসদের নতুন ভবনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মোদির নিজের এবং হিন্দুত্বের জয়জয়কার দেখে একটি বিষয়ে আশ্বস্ত হওয়া গিয়েছে। সেটি হল, মোদি নিজে বুঝে গিয়েছেন যে, আসলে তিনি সরকারের উন্নয়ন কার্য বলতে যা বোঝায় তার কিছুই করে উঠতে পারেননি। তাই এইসব হাই প্রোফাইল রাজামৌলির সিনেমার মতো (বাহুবলী অথবা আরআরআর) বর্ণময় সিনেম্যাটিক ইভেন্টের দরকার পড়ছে। যাতে মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। মানুষ বিস্মিত হয়। আলোচনা হয় সোনালি রাজদণ্ড নিয়ে।
নোটবাতিল করে মোদি বুঝতে পেরেছেন যে, তিনি অর্থনীতি বোঝেন না। অকস্মাৎ লকডাউন করে মোদি অবগত হয়েছেন যে, তিনি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অজ্ঞ। বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি আটকাতে না পেরে মোদির উপলব্ধি হয়েছে তিনি সরকার চালনায় ব্যর্থ। তিনি মাঝেমধ্যে ওরকম কিছু সিলেবাসের বাইরের কাজ করে হাততালি পাওয়ার চেষ্টা করলেও, সেটা যে তাঁর পথ নয়, সেকথা বুঝেছেন। সংসদ বদলের মতো একটি ঐতিহাসিক দিনে তিনি সবথেকে বিশেষজ্ঞ যে ব্যাপারে সেটিই পারফর্ম করছেন। ধর্ম ও নাটকীয় ইভেন্টের সংমিশ্রণে এক মেগা ওয়ান ম্যান শো!