সামাজিক কল্যাণকর্মে সামাজিক স্বীকৃতি আর সন্মান। গৃহ পরিবেশে চাপ। আর্থক প্রগতি বজায় থাকবে। ... বিশদ
নির্বাচন এলে শুরু হয় বিগত ভোটের চুলচেরা বিশ্লেষণ। খতিয়ে দেখা হয় সাফল্য ও ব্যর্থতার কারণ। তার উপরেই তৈরি হয় আগামীর রণকৌশল। রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট চলে আসায় ঘুরে ফিরে উঠছে ২০১৮ সালের কথা। চর্চায় জায়গা করে নিচ্ছে শাসক দলের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতার প্রসঙ্গ। তারজন্য উঠতে বসতে তৃণমূল নেতাদের পড়তে হচ্ছে সমালোচনার মুখে। ‘মুচলেকা’র স্টাইলে দিতে হচ্ছে স্বচ্ছ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি। লোকসভা নির্বাচন এগিয়ে আসছে। তাই উঠছে ২০১৯ সালের প্রসঙ্গ। চর্চা হচ্ছে পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলা, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সার্জিকাল স্ট্রাইক নিয়ে। আর তাতে ঘি ঢেলেছে জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিকের মন্তব্য। রাজস্থানের একটি অনুষ্ঠানে সত্যপাল দাবি করেছেন, গত লোকসভা নির্বাচনে মোটেই নরেন্দ্র মোদি সরকারের উন্নয়নের জয় হয়নি। সেবার ভোটে লড়া হয়েছিল পুলওয়ামা হামলায় নিহত জওয়ানদের মৃতদেহের উপর দাঁড়িয়ে। তদন্ত ঠিকঠাক হলে তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংকে ইস্তফা দিতে হতো। অনেক পদস্থ অফিসারকে জেলে যেতে হতো।
সত্যপাল মালিকের এমন বিস্ফোরক দাবির পরেও কেন্দ্রীয় সরকার ও বিজেপি নেতৃত্ব একেবারে স্পিকটি নট। হতে পারে বিজেপি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বলেই! তবে অনেকে বলছেন, ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ার ভয়ে সত্যপালকে ঘাঁটানোর সাহস পাচ্ছে না। নীরবতার কারণটা যাই হোক, সত্যপালের মতো দেশের কোটি কোটি মানুষও বিশ্বাস করেন, সার্জিকাল স্ট্রাইকই ২০১৯ সালে বিজেপিকে এনে দিয়েছিল বিপুল জয়।
উন্নয়ন আর পরিষেবা ভোটে জেতার মাপকাঠি হলে বিজেপি প্রতিটি পরীক্ষায় গাড্ডু খাবে। সেটা হিমাচল প্রদেশ ও কর্ণাটকের ভোটে খুব ভালো বোঝা গিয়েছে। বিজেপির ‘ডাবল ইঞ্জিন সরকার’ প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। তাই সেখানকার মানুষ তাদের সরিয়ে দিয়েছে। দিন যত যাচ্ছে বিজেপি শাসিত বেশিরভাগ রাজ্যেই গেরুয়া শিবির জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। ফলে লোকসভা ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপির অন্দরে আশঙ্কা বেড়েই চলেছে। কারণ ‘নেড়া’ বারবার বেলতলায় যেতে চাইছে না। তাই সরকার গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যা জোগাড়ে অবিজেপি রাজ্যগুলিই তাদের টার্গেট। সেখানে স্বপ্ন দেখিয়ে মানুষকে ধোঁকা দেওয়াটা অনেক সহজ।
সেই লক্ষ্য নিয়েই বিরোধীদের হাতে থাকা রাজ্যে কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কোনও না কোনও ইস্যুতে সিবিআই, ইডি বছরের পর বছর তদন্ত চালিয়েই যাচ্ছে। শেষ হওয়ার লক্ষণ নেই। মোদি বিরোধী জোট নিয়ে মাতামাতি করলেই লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে এজেন্সিকে। এটা এখন আর অভিযোগ নয়, প্রমাণিত সত্য।
তবে অনেকে বলছেন, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ‘আপনি আচরি ধর্ম অপরে শেখাও’ নীতি নিলে লাভ হতো বিজেপিরই। কর্ণাটক নির্বাচনের আগেই সরকারি কাজে ৪০ শতাংশ কাটমানি নেওয়ার অভিযোগ সামনে এসেছিল। এটাই ছিল বিরোধী সহ সাধারণ মানুষের প্রধান ইস্যু। তাই কেন্দ্রীয় এজেন্সির সব টিম বিরোধী রাজ্যে না পাঠিয়ে এক আধটা কর্ণাটকে পাঠালে বিজেপির লাভই হতো। দুর্নীতি ইস্যুতে তাদের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা মানুষও বিশ্বাস করত। তা শুধু কথার কথাই থেকে যেত না।
অবিজেপি রাজ্যগুলির মধ্যে মোদি-শাহ জুটির হিট লিস্টে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। একুশের নির্বাচনের পরাজয়ের জ্বালা নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। তাই ভোটের ফল বেরনোর পর থেকেই কেন্দ্রীয় টিম আর এজেন্সিকে লাগাতার পাঠানো হচ্ছে। তাতেও লাভ হচ্ছে না। তাই বদলানো শুরু হয়েছে দলীয় পর্যবেক্ষকদেরও। কৈলাস বিজয়বর্গীয়, সুনীল বনসল, মঙ্গল পাণ্ডে...। বিজেপি নেতৃত্ব বুঝেছে, বাংলার মাটি তাদের জন্য বেশ রুক্ষ। তাতে ‘বীজ’ ছড়ালেও ফসল ফলানো কঠিন। তাই এবার পর্যবেক্ষকও ‘ডাবল’। একজন পার্ট টাইমার, অন্যজন ফুলটাইমার। ‘কোচ’ হিসেবে এঁদের সকলেরই বেশ নামডাক আছে। কিন্তু বাংলায় এসে সবাই ফেল করছেন। কারণ কোচ রণকৌশল ঠিক করে দিলেও খেলতে হয় প্লেয়ারদেরই।
লোকসভার লড়াইটা বিজেপির জন্য দিনদিন কঠিন হয়ে পড়ছে। সেটা বুঝেই বুথ শক্তিশালী করার উদ্যোগ। পোশাকি নাম ‘বুথ সশক্তিকরণ’। কর্মসূচিটা গোটা দেশের জন্য। কিন্তু বাংলায় রয়েছে বিশেষ নজর। কারণ এখানে বুথ ভিত্তিক সংগঠন ছাড়া তৃণমূলের সঙ্গে এঁটে ওঠা অসম্ভব। লক্ষ্য, প্রতিটি বুথে ৩১জনের কমিটি তৈরি। রাজনৈতিক জমি শক্ত করার এটাই পদ্ধতি। করা তো দরকার। কিন্তু করবে কে? লোকই তো নেই। কিন্তু চেয়ার তো বাঁচাতে হবে। বুথ সশক্তিকরণ কর্মসূচি এগিয়ে চলেছে খাতায় কলমে। বাস্তবে সংগঠনের হাল কিন্তু খুবই করুণ।
রাজ্য বিজেপির কার্যনিবাহী বৈঠকে সেই কথাটাই বলেছেন দলের সর্বভারতীয় সহ সভাপতি দিলীপ ঘোষ। আর সেটা বলেছেন একেবারে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক সুনীল বনসালের সামনে। তাতেই চটেছে বঙ্গ বিজেপির ক্ষমতাসীন শিবির। কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না।
দিলীপবাবুর দাবি, সংগঠন হচ্ছে কাগজে কলমে। অঞ্চল কমিটি আছে। কিন্তু লোকজন নেই। মণ্ডল স্তরে সংগঠন নেই। দলের শাখা সংগঠনগুলিকে কাজে লাগানো হচ্ছে না। জেলার পদাধিকারীদের নিয়ে বৈঠক ডাকলে চার, পাঁচজনের বেশি উপস্থিত থাকেন না। এইসব কি দিলীপবাবুর মনগড়া অভিযোগ? বিরোধী গোষ্ঠীকে চাপে ফেলার কৌশল? নাকি বাংলায় কোলেপিঠে বড় করা বিজেপিকে বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা?
বাংলায় বিজেপি ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, তা জানার জন্য দু’টি ঘটনাই যথেষ্ট। ঘটনা-১: এবছর ৯ জানুয়ারি ডাকা হয়েছিল গড়বেতা-১ ব্লকের আমকোপা অঞ্চলে বিজেপির কর্মী সম্মেলন। দিলীপবাবু ছিলেন প্রধান বক্তা। ছিলেন আরও এক সাংসদ, কুনার হেমব্রম। একটা অঞ্চলের কর্মী সম্মেলনে দু’-দু’জন সাংসদ উপস্থিত। কিন্তু লোকজন একেবারে হাতেগোনা। প্রচণ্ড রেগে যান দিলীপবাবু। ক্ষোভ গোপন করেননি। কর্মীদের সামনেই জেলা নেতৃত্বকে করেছিলেন প্রশ্ন, আমাকে কি অপদস্থ করতে এখানে ডেকেছেন? লোকজন যখন নেই, মিটিংটা হলঘরে করলেই তো পারতেন।
ঘটনা-২: ঠিক তার দু’দিন পর মেদিনীপুর সদর ব্লকের ধেড়ুয়াতেও ঘটল একই ঘটনা। সেদিনও ছিল অঞ্চলের কর্মী সম্মেলন। কিন্তু লোক নেই। সভাস্থল ছাড়ার আগে স্থানীয় পার্টি নেতৃত্বকে তীব্র ভর্ৎসনা করেছিলেন মেদিনীপুরের সাংসদ। মেদিনীপুর পুরসভা নির্বাচনের সময়েও একই ঘটনা ঘটেছিল। এছাড়াও প্রায়ই তিনি বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছেন। কর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন। তাতে তিনি বুঝতে পারছেন, বিজেপিকে ঘিরে একুশের সেই উচ্ছ্বাস, উন্মাদনা আর নেই। তাই সুনীল বনসালের সামনে তিনি যা বলেছেন সেটা কোনও অভিযোগ বা বানানো গল্প নয়। সবটাই তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা।
এটাই বঙ্গ বিজেপির ‘গ্রাউন্ড জিরো’র প্রকৃত অবস্থা। বিধানসভা নির্বাচনে হারার পর থেকে বিজেপি প্রতিদিন একটু একটু করে ভাঙছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বাংলার জন্য টার্গেট ৩৫টি আসন। অনেকে বলছেন, বিজেপি শুকনো মাটিতেই বারবার হড়কে যাচ্ছে। দখল করা রাজ্যও ধরে রাখতে পারছে না। সেখানে বাংলায় তো বিজেপির মাটিই তৈরি হয়নি। যা হয়েছে সবটাই ‘হাওয়া’য়। তা সত্ত্বেও ৩৫আসনের টার্গেট? তাহলে কি সবটাই ফাঁকা আওয়াজ? নাকি অপেক্ষা করছে আবার কোনও বড় ধামাকা?