পরিবারে কারও ভবিষ্যৎ নিয়ে মানসিক চিন্তা বৃদ্ধি। আর্থিক অগ্রগতি হবে। যে কোনও কর্মে উন্নতি। ... বিশদ
মেয়েদের এই সর্বনাশের কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১০-১৪ বছর বয়সি ৩০ লাখের মতো মেয়েকে স্কুলেই পাঠানো হয় না। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য রিপোর্টে প্রকাশ, বাল্যবিবাহচিত্র সবচেয়ে করুণ বিহারে—আঠারোর নীচেই বিয়ে হয়েছে ৬৯ শতাংশ মেয়ের। সংখ্যাটি রাজস্থানের ক্ষেত্রে ৬০। বাংলার ছবিটাও তখন রীতিমতো মন-খারাপ-করা ছিল—অপ্রাপ্তবয়স্ক কন্যার বিবাহ হার ছিল ৫৪ শতাংশ। মহানগর কলকাতাতেও প্রতি সাতটি মেয়ের মধ্যে একটি সংসারের জোয়াল কাঁধে নিত আঠারোর গণ্ডি পেরনোর আগেই। এই লজ্জার মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গ ছিল সপ্তম স্থানে। ইউনিসেফের হিসেবে, পৃথিবীতে বালিকা-কিশোরী বধূর সংখ্যা ভারতেই সর্বাধিক।
তবে এই রিপোর্ট সামনে আসার আগেই, ২০০৮ সালে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছিলেন রেখা কালিন্দী। পুরুলিয়া জেলায় ঝালদা-২ ব্লকের বড়রোলা গ্রামের এক হতদরিদ্র বিড়িশ্রমিক পরিবারের সন্তান রেখা। ১২ বছর বয়সেই তাঁর বিয়ের ব্যবস্থা করেন নিরুপায় পিতামাতা। আত্মীয়স্বজনরাও তাঁকে বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে মরিয়া ছিলেন। কিন্তু নিজের এই সর্বনাশ মেনে নেননি রেখা—শিক্ষকদের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন শ্রমদপ্তরে। তাতে নিজের বিয়ে রুখতে সফলই হন তিনি। খবর রাষ্ট্র হতে দেরি হয়নি। রেখার সাফল্য উজ্জীবিত করে আরও অনেক অসহায়ক কন্যাকে। বিদ্রোহের সরণিতে অতিদ্রুত দেখা মেলে সুনীতা মাহাতো এবং আফসানা খাতুন নামে আরও দুই কন্যার। তাঁরাও পুরুলিয়া জেলার সাহসিনী—জয়পুর থানার চিটাহি গ্রামের সুনীতা এবং পুরুলিয়া শহরের আফসানা।
২০০৯ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক রেখাকে দেশের ‘রোল মডেল’ ঘোষণা করে। রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিল ওই তিনজনকেই ‘সমাজ পরিবর্তনের দূত’ আখ্যা দেন। তাঁদের সঙ্গে সরাসরি কথাও বলতে চান তিনি। ১৪ মে রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রতিভা পাতিলের সামনে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়। সঙ্গে ওঁদের বাবা-মায়েরাও ছিলেন। রাষ্ট্রপতির প্রশ্নের জবাবে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অফিসারদের সামনে, তাঁরা অভিযোগ করেন, বিপিএল হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের কার্ড নেই। বিড়ি বেঁধে, শোনপাপড়ি বানিয়ে কোনওক্রমে সংসার চলে। তাই মেয়েরা একটু বড় হতেই তাদের বিয়ে দেওয়াই উপায়। ২০১০ সালের ২১ জানুয়ারি। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তাঁর ভবনে আমন্ত্রণ জানিয়ে ওই তিন বিশিষ্ট বঙ্গতনয়ার হাতে তুলে দেন জাতীয় সাহসিকতা পুরস্কার। সাধারণতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতিকে স্যালুট জানাতেও আমন্ত্রিত হন তাঁরা। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রসঙ্ঘের শিশু অধিকার বিষয়ক এক ঘোষণাপত্রে রেখা কালিন্দীর নাম নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাইয়ের সঙ্গেই উচ্চারিত হয়।
রেখা, সুনীতা, আফসানার সাফল্য তাঁদের উত্তরসূরিদের কতটা প্রাণিত করেছে, তার প্রমাণ মেলে একের পর সাহসিনী-বিদ্রোহিণীর উত্থানের খবরে। জেলায় জেলায় বহু ছোট মেয়ে নিজ নিজ বিবাহ রুখে শিক্ষাঙ্গনে ফিরে গিয়েছেন। কেউ রুখেছেন থানায় ছুটে গিয়ে কিংবা বিডিওর সঙ্গে দেখা করে। কারও ক্ষেত্রে সহায় হয়েছেন তাঁদের সহপাঠী কিংবা শিক্ষকরা। মেয়েদের এই ‘অন্য স্বাধীনতার লড়াই’-তে অঞ্জলি বর্মন নামে একটি উজ্জ্বল নামও আমাদের সামনে আসে। সংবাদপত্রের পুরনো প্রতিবেদন অনুসারে, মালদহের গাজলের এই গৃহবধূ ২০১২ সালের জানুয়ারি অব্দি সাতজন নাবালিকার বিয়ে রুখে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন। গ্রামের মেয়েদের সামান্য বয়সেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এবং তারা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ছে। সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারাও যাচ্ছে কেউ কেউ। আর বেঁচে গেলে জীবনটাই নষ্ট হচ্ছে অপুষ্টির অভিশাপে। স্কুল-বয়সে দেখা ঘটনাগুলি অঞ্জলিকে ভীষণ কষ্ট দিত। তাই তিনি ঠিক করেছিলেন, অনুপযুক্ত বয়সে বিয়ে করবেন না এবং অন্য মেয়েদেরও বাঁচাবেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে তিনি জনমত গঠন করেন এবং পুলিস-প্রশাসনের সহায়তা নেন। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে সচেতনার পাঠ দিতে গ্রামের হাটে এবং স্কুলে স্কুলে নাটকও পরিবেশন করেন। অঞ্জলি মিডিয়াকে তখন জানিয়েছিলেন, এই অন্যায় যতদিন না বন্ধ হয় তাঁর প্রতিবাদ আন্দোলন চলবে।
কিন্তু এতসবের পরেও যে অনেকের শুভবুদ্ধির উদয় হয়নি, তারও প্রমাণ মেলে কিছু বাবা-মায়ের অবিবেচক ভূমিকায়। যেমন ২০১২ সালে পুরুলিয়ার আড়শার এক বাম নেতা তাঁর নবম শ্রেণির পড়ুয়া কন্যার নাম পাল্টে বিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করেন। খবর পেতেই বিয়ের সন্ধ্যাতেই ওই নেতার বাড়ি হানা দেন স্থানীয় বিডিও। তখন সেখানে সুর তুলেছে সানাই, চলছে ভূরিভোজ! বিডিও সেই বেআইনি বিয়ে রুখেই ক্ষান্ত হননি, কন্যার পিতার মুচেলকাও আদায় করেন—‘আমার মেয়ে সাবালক না-হওয়া পর্যন্ত বিয়ে দেব না।’ নাবালিকার বিয়ে রুখতে গিয়ে পুলিস আক্রান্ত হওয়ারও একাধিক ঘটনা সামনে এসেছে। এই প্রসঙ্গে রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়ের একটি মন্তব্য (২০১১ সালে ১০ সেপ্টেম্বর সংবাদপত্রে প্রকাশিত) ফের পড়ে দেখা যেতে পারে, ‘বাল্যবিবাহ ও কন্যাভ্রূণ হত্যা বন্ধ করার মতো পর্যবেক্ষক নেই। কী শাস্তি হবে, আইনে তা স্পষ্ট নয়। ফলে গ্রামেগঞ্জে মারাত্মক চিত্রটাই বহাল রয়েছে।’
তারপর কেটে গিয়েছে একদশকের বেশি। ২০১৩ সাল থেকে চলছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বপ্নের প্রকল্প কন্যাশ্রী। প্রথম ন’বছরে উপকৃত কন্যার সংখ্যা ৮০ লক্ষাধিক। ২০১৫ সাল থেকে চলছে সবুজসাথী প্রকল্প। তার মাধ্যমে পড়ুয়ারা এ পর্যন্ত সাইকেল পেয়েছে ১ কোটির বেশি। চালু আছে মিড ডে মিল। প্রতিবছর পালিত হয় কন্যাশ্রী দিবস। ফলিত অর্থনীতির প্রাথমিক পাঠ দিতে খোলা হয়েছে ‘কন্যাশ্রী ক্লাব’। প্রতিটি ক্লাবে সরবরাহ করা হয়েছে ‘কিশোরী কিট’। চালু হয়েছে স্বয়ংসিদ্ধা প্রকল্প। বিশেষ করে কন্যাশ্রী সারা দেশের সামনে প্রতিভাত হয়েছে একটি আদর্শ প্রকল্প হিসেবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই অনবদ্য উদ্যোগকে স্বীকৃতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘ। শুধুমাত্র বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পরই বিবাহে উৎসাহ দিতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে রূপশ্রী প্রকল্পও চালাচ্ছে নবান্ন। আর এই আবহেই সম্প্রতি সামনে এসেছে একটি বিপরীত চিত্র: শুধু বারুইপুর পুলিস জেলায় গত ন’মাসে ১১২টি বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে। সুন্দরবন এবং তৎসংলগ্ন ক্যানিং, জয়নগর, কুলতলি, মৈপীঠ, গোসাবা, বাসন্তী প্রভৃতি এলাকায় হয়েছে একের পর এক বাল্যবিবাহ অনুষ্ঠান।
এই অঞ্চলগুলি মহানগর থেকে আহামরি দূরে নয়। সেখানে হঠাৎ এই ভয়াবহ পরিস্থিতির কারণ কী? সমস্যাটি শুধু কি বারুইপুর পুলিস জেলার? করিমপুর, তেহট্ট, বনগাঁ, বসিরহাট, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, রায়গঞ্জ, বালুরঘাট প্রভৃতি প্রত্যন্ত অঞ্চলের খবরাখবর এখনই নেওয়া দরকার। এ কি আত্মতুষ্টির পরিণতি, নাকি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে প্রশাসন? অবাঞ্ছিত রাজনৈতিক ডামাডোল বৃদ্ধিই যদি প্রশাসনের ক্লান্তির অন্যতম কারণ হয়ে থাকে, সেটা নিঃসন্দেহে দুর্লক্ষণ। ভোটের রাজনীতির ঘোলাজলে এত বড় সমস্যা চাপা পড়ে গেলে তার মাশুল গোটা সমাজকে দীর্ঘমেয়াদে গুনতে হবে। এই ব্যর্থতার দায় শুধু শাসকের নয়, বিরোধীদেরও। সময় থাকতেই কাটিয়ে উঠতে হবে এই দুর্যোগ।