বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
তীব্র কটাক্ষটা তৎক্ষণাৎ বিখ্যাত হয়ে ওঠে। উইকিপিডিয়ার মতে, প্রবচনটা বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে চালু আছে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয়েছে ভারতের জাতীয় আয়ের উপর এনএসওর এস্টিমেট। তার উপর সরকারি কর্মকর্তাদের কারিকুরির কথা শুনেই ওই প্রবচনটার কথা আমার মনে পড়ে গেল। সংখ্যা মিথ্যা বলে না। সংখ্যা নিয়ে ব্যাখ্যাটা মিথ্যা হয়ে ওঠে। যেমনটা আমরা দেখেছি ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষের বাজেট পেশের পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে। মাননীয়া অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট ভাষণে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের জন্য জিডিপি বৃদ্ধির যে অনুমান জানিয়েছেন তা হল—৭ শতাংশ। তারপর থেকে, প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা সেই দাবিরই পুনরাবৃত্তি করেছেন। এটা মিলে গেলে তো ভালোই। কিন্তু ৭ শতাংশ, এই ভদ্রস্থ সংখ্যার পিছনে এই নির্মম সত্যটাও রয়েছে যে, ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের পূর্ববর্তী ত্রৈমাসিকগুলোতে বৃদ্ধির প্রবণতা ধারাবাহিকভাবেই নিম্নমুখী। এনএসওর এস্টিমেট অনুসারে, প্রথম তিনটে ত্রৈমাসিকে (ইয়ার-অন-ইয়ার) বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে এইরকম: ১৩.২ শতাংশ, ৬.৩ শতাংশ এবং ৪.৪ শতাংশ।
উৎপাদন বিষয়ে
আমার মতে, বৃদ্ধির হারের ‘ইয়ার-অন-ইয়ার’ ত্রৈমাসিক অনুমান কিংবা ক্রমিক ত্রৈমাসিক অনুমান—কোনওটাই অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা প্রতিফলিত করে না। দিনের শেষে, প্রতিটা ত্রৈমাসিকে আমাদের সমস্ত প্রচেষ্টার ফলটাই (আউটপুট) গুরুত্বপূর্ণ। গ্রস ভ্যালু অ্যাডেড (জিভিএ) এবং গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্টের (জিডিপি) পরিপ্রেক্ষিতে এনএসও ত্রৈমাসিক আউটপুটের মানের পরিমাপ নিয়েছে। নীচে টেবিল দেখুন:
মনে রাখবেন, এই ভ্যালু বা মানগুলি হল অ্যাবসোল্যুট ভ্যালু বা পরম মান। একবছর আগের ত্রৈমাসিক বা পূর্ববর্তী ত্রৈমাসিকের ভিত্তিতে হিসেব করা বৃদ্ধির হার নয়। যদি অর্থনীতি দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে, তাহলে একটি ত্রৈমাসিকে আউটপুটের মান আগের ত্রৈমাসিক বা পূর্ববর্তী ত্রৈমাসিকের আউটপুটের মূল্যের চেয়ে কম হওয়ার কোনও কারণ নেই। উদাহরণস্বরূপ—ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর সুস্থ স্বাভাবিক থাকলে কর্মসংস্থান চলতে থাকবে এবং চাহিদাও থাকবে ব্যাপক। এটাই নিয়ম। তাহলে কেন ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরের উৎপাদনের মূল্য কমতে থাকল—প্রথম ত্রৈমাসিকের ৬,৩৯,২৪৩ কোটি টাকা থেকে কমে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে হল ৬,২৯,৭৯৮ কোটি টাকা এবং তৃতীয় ত্রৈমাসিকে সেটা আরও নেমে গেল ৬,১৪,৯৮২ কোটি টাকায়?
আরও উল্লেখ করা যায় যে ‘বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং জল’ (এই কার্যকলাপগুলি সরাসরি ‘ম্যানুফ্যাকচারিং’-এর সঙ্গে যুক্ত)—এগুলির ‘আউটপুট’-এর মান ধারাবাহিক ত্রৈমাসিকে হ্রাস পেয়েছে।
সংখ্যা মিথ্যা বলে না
মোট দেশীয় পণ্যের প্রেক্ষিতে অর্থনীতির দিকে তাকালে এটাই স্পষ্ট হয় যে, সরকারের তরফে চূড়ান্ত ভোগব্যয়ের (গভর্নমেন্ট ফাইনাল কনজাম্পশন এক্সপেনডিচার) গতি বজায় থাকেনি। গত তিনটি ত্রৈমাসিকে গ্রস ফিক্সড ক্যাপিটাল ফরমেশনের (জিএফসিএফ) ক্ষেত্রে ওঠানামা পরিলক্ষিত হয়েছে। থমকে গিয়েছে রপ্তানি এবং আমদানি। শক্তিশালী বৃদ্ধির কোনও ইঙ্গিত নেই।
উদ্বেগজনক সংখ্যার আর একটা সেট হল ব্যক্তিগত চূড়ান্ত ভোগব্যয় (প্রাইভেট ফাইনাল কনজাম্পশন এক্সপেনডিচার)। খরচ সাধারণত, প্রতি ত্রৈমাসিকে প্রায় তিন লক্ষ কোটি টাকার হিসেবে—প্রথম থেকে দ্বিতীয়, দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় ত্রৈমাসিকে ভোগব্যয় বাড়তে থাকে। ২০২২-২৩ সালে ব্যক্তিগত খরচের বৃদ্ধি ঘটেছে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে মাত্র ১,২১,৯৫৯ কোটি টাকা এবং তৃতীয় ত্রৈমাসিকে ১,৬৮,০০৫ কোটি টাকা হয়েছে। এটা গয়ংগচ্ছ গোছের চাহিদার দিকেই ইঙ্গিত করে। আমার ধারণা, মুদ্রাস্ফীতি, ছাঁটাই এবং ছাঁটাইয়ের ভয়—ব্যক্তিগত খরচে লাগাম টানতে মানুষকে প্ররোচিত করেছে।
৩১ মার্চ, ২০২৩-এ যে চতুর্থ ত্রৈমাসিক শেষ হতে যাচ্ছে সেখানে জিডিপির বৃদ্ধি কেমন হবে তা অনুমান করা আর কঠিন নয়। ২০২২-২৩ সালের বার্ষিক বৃদ্ধির সেরা অনুমান যদি ৭ শতাংশ হয়, চতুর্থ ত্রৈমাসিকের জন্য ‘স্পেস’ থাকছে মাত্র ৪.১ এবং ৪.৪ শতাংশের মধ্যে।
বাস্তব যাচাই
অর্থনীতি ভয়াবহ বাধার মুখোমুখি হচ্ছে: মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি, কঠোর মানিটারি পলিসি, দেশীয় শিল্প সম্পর্কে রক্ষণশীলতার নীতি এবং উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে জ্বালানির চড়া দাম; ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ; নিষেধাজ্ঞার দরুন সাপ্লাই চেইনে বিঘ্ন ঘটা; অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে মুদ্রাস্ফীতি; ক্রমবর্ধমান সুদের হার ও ইএমআই; চাকরি খোয়ানো ও বেকারত্ব; এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। যতই লম্বা-চওড়া ভাষণই দেওয়া হোক না কেন তাতে এই নির্মম বাস্তবটাকে আড়াল করা যাবে না। সম্ভাবনার প্রশ্নে ২০২৩-২৪ সাল উজ্জ্বল নয়।
তবুও কোরাস চলছেই। এটাই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের (আরবিআই) মতো একটা প্রতিষ্ঠানও চিয়ারলিডারদের দলে যোগ দিয়েছে! রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ফেব্রুয়ারির বুলেটিন অনুসারে, ভারতীয় অর্থনীতি ‘সাম্প্রতিক সামগ্রিক অর্থনৈতিক অনুমান (ম্যাক্রোইকনমিক প্রজেকশনস অব কারেন্ট ভিনটেজ) এবং বাকি বিশ্বের থেকেও আলাদা হয়ে যাবে’—এই আলঙ্কারিক গদ্যের অর্থ যাই হোক না কেন। আরবিআই আরও মত প্রকাশ করেছে যে, ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষের বাজেট হল ‘ভারতের বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে পৃথক করার এবং বাড়ানোর হাতিয়ার’। আবার রিজার্ভ ব্যাঙ্কই তার আর্থিক নীতিকে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের (দ্য ফেড) থেকে আলাদা করতে অক্ষম!
বাজেটের উপর লেখা আমার পূর্ববর্তী তিনটি বিশেষ নিবন্ধ আপনি পড়ে থাকলে (বর্তমান—ফেব্রুয়ারি ৬, ১৩ এবং ২০/২০২৩), আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, সংস্থাটি সংখ্যাগুলোকে কেবল প্রসাধনী চটকে সাজাচ্ছে। সংখ্যা নিয়ে কারসাজিই করা হচ্ছে। তবু সেই সংখ্যাগুলো এখনও হতাশা জাগায়।