কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যে প্রচুর প্রার্থীর প্রয়োজন। কেবল গ্রাম পঞ্চায়েতের আসন সংখ্যা ৬২ হাজার ৪০৪টি। এছাড়া পঞ্চায়েত সমিতিতে ৯৪৯৮টি এবং জেলা পরিষদে ৯২৮টি আসন রয়েছে। বাস্তবটা হল, এই বিপুল সংখ্যক আসনে প্রার্থী জোগাড় করার জন্য যে সাংগঠনিক ক্ষমতা থাকা দরকার তার সিকিভাগ কোনও বিরোধী দলের নেই।
বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ৭৭টি আসনে জিতেছিল ঠিকই। কিন্তু সবটাই ছিল ‘হাওয়ার ভোট’। যে কোনও নির্বাচনেই তারা অধিকাংশ বুথে এজেন্ট দিতে পারে না। কারণ বিজেপির কোনও সংগঠন তৈরি করতে পারেনি। শাসক দলের নেগেটিভ ভোটই তাদের সম্বল। বিধানসভা ভোটের আগে নতুন প্রজন্মের একটা অংশ বিজেপির দিকে ঝুঁকলেও এখন আর তাদের দেখা যায় না। অন্যদিকে মুর্শিদাবাদ, মালদহ ছাড়া অন্য কোনও জেলায় কংগ্রেসের তেমন শক্তি নেই বললেই চলে। শুধু জাতীয় স্তরে নয়, রাজ্যেও নেতৃত্বের সঙ্কটে ভুগছে কংগ্রেস। অধীর চৌধুরী নিজের জেলায় কিছু কর্মসূচি নিলেও অন্য জেলায় কংগ্রেসকে খুঁজেই পাওয়া যায় না। ফলে সাগরদিঘি উপনির্বাচনে জিতলেও কংগ্রেসের পালে হাওয়া লাগার এখনই কোনও সম্ভাবনা নেই।
বিরোধী দলগুলির মধ্যে একমাত্র সিপিএমের কিছু এলাকায় সংগঠন আছে। কিন্তু একের পর এক নির্বাচনে হারতে থাকায় কমরেডদের অনেকেই হতাশায় নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছেন। সিপিএমের পুরনোরাই সম্বল। নতুন প্রজন্মের ভিড় ভীষণভাবে কমে গিয়েছে। লড়াইয়ের ময়দানে নেতৃত্বের দীর্ঘ অনুপস্থিতি এবং কেন্দ্রীয় এজেন্সির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকাটা এরাজ্যে বামেদের ভেন্টিলেশনে পাঠিয়ে দিয়েছে। সেখান থেকে বের করে আনার জন্য একটা উপনির্বাচনে জয়লাভ কিছুই নয়। সাগরদিঘির রেজাল্ট বড়জোর তাদের পঞ্চায়েত ভোটে কিছুটা অক্সিজেন জোগাতে পারে।
এবার পঞ্চায়েত ভোটে মহিলা সংরক্ষিত আসনে প্রার্থী দিতে বিরোধীদের হিমশিম খেতে হবে। রাজ্যের ৫০ শতাংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। সেই হিসেবে প্রতিটি দলকে প্রায় ৩৫ হাজার মহিলা প্রার্থী দিতে হবে। কিন্তু লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী এবং রূপশ্রী প্রকল্পের সৌজন্যে মহিলাদের একটা বড় অংশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভোট ব্যাঙ্কে’ পরিণত হয়েছে। তার উপর রাজ্যে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠী। সেই গোষ্ঠীর সদস্যরা সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ পাচ্ছেন। সেই সুবাদে গ্রামবাংলার বহু গৃহবধূ হেঁশেল সামলানোর পাশাপাশি সংসারে অর্থও জোগান দেন। তাই বঙ্গে ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকার প্রতিষ্ঠিত না হলেও স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সৌজন্যে এখন গ্রামের অধিকাংশ গরিব পরিবারই ‘ডাবল ইঞ্জিন’। সেই সব পরিবার থেকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রার্থী বের করা বিরোধীদের জন্য রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
মহিলা প্রার্থী ঠিক করার ক্ষেত্রে বিজেপির সঙ্কটটা আরও বেশি। বিশেষ করে সংখ্যালঘু প্রভাবিত এলাকায়। এমনিতেই সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিজেপির তেমন প্রভাব নেই। সেখানে সংখ্যালঘু মহিলা প্রার্থী খুঁজে পাওয়াটা তাদের কাছে গোদের উপর বিষফোড়া হয়ে দাঁড়াবে। সংখ্যালঘু এলাকায় অধিকাংশ মহিলা আসনে বিজেপি প্রার্থী দিতে পারবে না। সেখানে কংগ্রেস বা সিপিএম কাউকে দাঁড় করালে তিনিই হবেন ‘রামধনু জোটে’র প্রার্থী।
একইভাবে বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া এবং হিন্দিভাষী এলাকায় গেরুয়া শিবিরের প্রভাব আছে। বিশেষ করে মতুয়াদের মধ্যে। তাই সেই সব এলাকায় ‘সাংগঠনিক দুর্বলতা’র অজুহাত দেখিয়ে সিপিএম-কংগ্রেস জোট প্রার্থী দিতে চাইবে না। এই মুহূর্তে সিপিএম, কংগ্রেস বা বিজেপি নেতৃত্বের কাছে তারা কত আসন জিতল, সেটা বড় নয়। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল তৃণমূল কত আসনে হারল। তৃণমূলকে হারানোটাই ‘নৈতিক জয়’ বলে বিরোধী দলের নেতারা তাঁদের কর্মীদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন। এছাড়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মোকাবিলার কোনও রাস্তা তাঁদের সামনে নেই। সেকথা মাথায় রেখেই
বিরোধী দলের নেতারা কৌশলে জোটের সম্ভাবনাকে জিইয়ে রাখছেন।
দিলীপ ঘোষের বক্তব্য, ‘রাজ্য সরকার বিরোধীদের সঙ্গে যেভাবে দুর্ব্যবহার করছে, তার বিরুদ্ধে এক হওয়ার দরকার আছে। সেটা সাগরদিঘির উপনির্বাচনে মানুষ অনেকটা দেখিয়ে দিয়েছেন।’ সিপিএমের
রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য অনেকটা ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের। তাঁর কথায়, ‘বিজেপি বাঁচবে না। বাঁচার জন্য বিরোধীদের কাছে অক্সিজেন চাইছে। কারণ বিজেপি নিজে বিরোধী নয়। আগে নকল বিরোধিতা থেকে আসল বিরোধিতায় নামুক, তারপর দেখা যাবে।’
‘তারপর দেখা যাবে’ বলে সেলিম সাহেব কী বোঝাতে চেয়েছেন? তাহলে সাম্প্রদায়িকতাটা আসল ইস্যু নয়? বিজেপি তৃণমূলকে কষিয়ে টাইট দিতে পারছে না বলেই তারা ‘অচ্ছুৎ’। সেই কারণেই কি সিপিএম তাদের হাত ধরছে না! তার মানে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শায়েস্তা করার জন্য সিপিএম যে কোনও শক্তির হাত ধরতে পারে। বামেদের ট্র্যাক রেকর্ড অবশ্য সেকথাই বলছে। মমতাকে হারানোর আশায় ২০১৬ সালে একদা প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। আর একুশে হাত মিলিয়েছিল আইএসএফ এর মতো ‘সাম্প্রদায়িক শক্তি’র সঙ্গেও। কংগ্রেস ও আইএসএফের সঙ্গে জোট করার জন্য সিপিএম প্রায় চার দশকের বন্ধু শরিকদের ডানা ছাঁটতেও পিছপা হয়নি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সাগরদিঘিকে সামনে রেখে বঙ্গে যে বিরোধী জোটের আবহ তৈরি হয়েছে তার ভবিষ্যৎ কী? পঞ্চায়েত নির্বাচনে যে রাজ্যের বহু আসনে রামধনু জোট হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই জোট কিছুতেই লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত গড়াবে না। রাজ্যের ৪২টি আসনেই বিজেপি প্রার্থী দেবে। ফলে তৃণমূল কংগ্রেসকে হারানোর বাসনা যতই তীব্র হোক না কেন, লোকসভা ভোটে সিপিএম-কংগ্রেস জোটকে আলাদা প্রার্থী দিতেই হবে।
লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের এবং বামেদের মধ্যে আসন সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কারণ বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রটি আর আগের মতো অধীর চৌধুরীর জন্য মোটেই ‘সেফ সিট’ নয়। এই আসনে ফের যদি অধীরবাবু প্রার্থী হন তাহলে তিনি যে কোনও মূল্যে সিপিএমের সঙ্গে জোট করবেন। ডানপন্থী দলে সাংসদ, বিধায়ক না হলে তিনি
গুরুত্ব পান না। ফলে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি থাকলেও সাংসদ হওয়ার মরিয়া চেষ্টা তিনি চালাবেন। কিন্তু জোটের আসল খেলাটা জমবে ছাব্বিশের বিধানসভা নির্বাচনে।
ইতিহাস বলছে, অধীর চৌধুরী জোট বিরোধী। অন্তত মুর্শিদাবাদ জেলায় তো বটেই। তাঁর একটাই লক্ষ্য, মুর্শিদাবাদ জেলাকে ‘অধীর চৌধুরীর গড়’ বানানো। সেই কারণে রাজ্যজুড়ে কখনও তৃণমূলের, কখনও সিপিএমের সঙ্গে জোট হলেও অধীরবাবু মুর্শিদাবাদ জেলায় কংগ্রেস নেতৃত্বের সেই সমঝোতা মানেননি। তারজন্য তিনি কখনও কংগ্রেস হাইকমান্ডের জোটের নির্দেশকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন, কখনও ভেঙেছেন প্রদেশ কংগ্রেসের জোটের সিদ্ধান্ত। নিজের দাপট ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ‘গোঁজ প্রার্থী’ দাঁড় করিয়ে জোটের প্রার্থীকে হারিয়েছেন। এমনকী কংগ্রেসের হাত চিহ্নের অফিসিয়াল প্রার্থীর বিরুদ্ধে গোঁজ প্রার্থী দিয়ে তাঁকেই জিতিয়ে এনেছেন। এটাই অধীরবাবুর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার স্টাইল।
সাগরদিঘি উপনির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থীর জয়ে সিপিএম যতই উল্লসিত হোক না কেন, ছাব্বিশে ‘ঘাড়ধাক্কা’ খাওয়ার জন্য এখন থেকেই তৈরি থাকা ভালো। কারণ অধীর চৌধুরী কখনওই নিজের তৈরি করা জমি অন্যকে ছাড়েন না। তাই অনেকেই বলছেন, বঙ্গে ‘সাগরদিঘি মডেলে’র ভবিষ্যৎ ‘ভূতের ভবিষ্যতে’র চেয়েও করুণ।