বিদ্যালাভের পক্ষে দিনটি উত্তম। ব্যবসার উন্নতি, পেশায় সুনাম। উপার্জন বাড়বে। ... বিশদ
বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীকে ঘিরে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। বরং বলা ভালো, বিতর্ক সৃষ্টিতেই তিনি পটু। তাঁর আমলেই রবীন্দ্রনাথের মুক্ত শিক্ষাঙ্গণ আজ অনেকের চোখে ‘পাঁচিলঘেরা জেলখানা’। পৌষমেলা বাঙালির আবেগ। সেই মেলার দায়িত্বও বিশ্বভারতী ঘাড় থেকে নামিয়ে দিয়েছে। বসন্ত উৎসব পালনেও তীব্র অনীহা। এভাবেই আম বাঙালির আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা শান্তিনিকেতনকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা হচ্ছে। বিশ্বভারতীকে কেবল একটা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করে রাখাই তাঁর লক্ষ্য। তবে, সবকিছুই ম্লান হয়ে গিয়েছে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের উদ্দেশে করা উপাচার্যের মন্তব্যে ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নজিরবিহীন আক্রমণে।
‘পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কান দিয়ে দেখেন। কারণ তাঁকে তাঁর স্তাবকরা যা শোনান তাই বিশ্বাস করেন এবং টিপ্পনি করেন। মাননীয়াকে অনুরোধ করব যে কান দিয়ে না দেখে বুদ্ধি দিয়ে বিচার করুন। আজ আপনার মনোনীত মন্ত্রী ও উপাচার্য গারদের ভিতরে। কী করে হল? কারণ আপনি স্তাবকদের কথা শুনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেই বিধ্বস্ত। আপনার প্রিয় শিষ্য যাকে না হলে আপনি বীরভূম ভাবতে পারতেন না, তিনিও জেলে। কবে বেরুবেন কেউ জানে না। আগে সাবধান করলে আপনি দুর্নাম থেকে বাঁচতে পারতেন। অবশ্য আপনি যদি সত্যি অর্থে মানুষের মুখ্যমন্ত্রী হন, তাহলে এই কথাটা আপনার বোধগম্য হবে। আর, যদি স্তাবক পরিবৃত্ত হয়ে থাকতে ভালবাসেন, তাহলে সামনে আরও বিপদের সম্মুখীন হবেন।’ এটা কোনও বিজেপি মুখপাত্রের বিবৃতি নয়, বিশ্বভারতীর প্রেস বিজ্ঞপ্তি। রাজনীতিকের ভাষা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের মুখে শোভা পায় না। এই সহজ সত্যিটা বিশ্বভারতীর প্রধান হিসেবে বিদ্যুৎবাবুর বোঝা উচিত ছিল।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর ডিগ্রি নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনও অধিকার বা ধৃষ্টতা এই অর্বাচীনের নেই। কিন্তু তাঁর ‘প্রকৃত শিক্ষা’ নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা বোধহয় খুব একটা অন্যায় হবে না। সভ্যসমাজে জীবনচর্চার জন্য স্বাভাবিক ভদ্রতা ও সৌজন্যের ন্যূনতম কিছু শর্ত থাকে। বিশ্বভারতীর উপাচার্য হিসেবে বিদ্যুৎবাবু সেই সমস্ত শর্ত শুধু লঙ্ঘন করেননি, ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। বিশ্বভারতীর ৪৭৩ জন শিক্ষক, ১৫ হাজার ছাত্রছাত্রী তাঁর এই ‘শিক্ষা’য় শিক্ষিত হলে কবিগুরুর উদ্দেশ্য একেবারেই ব্যর্থ হবে। একথা বলতে দ্বিধাগ্রস্ত হওয়ার কোনও কারণ নেই।
তবে, একটা ব্যাপারে বিদ্যুৎবাবুকে ধন্যবাদ না দিয়ে উপায় নেই। ঘোমটার আড়ালটা খুলে দিয়েছেন। প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে বলা হয়েছে, ‘বিশ্বভারতী একমাত্র কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। আপনার আশীর্বাদ না থাকলে আমাদের সুবিধা কারণ আমরা প্রধানমন্ত্রীর মার্গদর্শনে চলতে অভ্যস্ত।’ প্রেস বিজ্ঞপ্তির নীচে রয়েছে জনসংযোগ আধিকারিকের সই। কিন্তু বিশ্বভারতীর প্রধান হিসেবে এর দায় বিদ্যুৎবাবুর উপরেই বর্তায়।
প্রেস বিজ্ঞপ্তির ভুল বানান ও বাক্য গঠনের অপটুতায় অনেকে এটা সত্যিই বিশ্বভারতীর কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞপ্তির পরতে পরতে শালীনতা অতিক্রমের উন্মাদতা
বুঝিয়ে দিয়েছে, এমন আচরণ তাঁর পক্ষেই সম্ভব। আর এব্যাপারে তিনি একমেবদ্বিতীয়ম। তাই অমর্ত্য সেনের নোবেল জয়ের জন্য যখন প্রতিটি ভারতীয় গর্ববোধ করেন, তখন তিনি সেই নোবেল নিয়েই
প্রশ্ন তোলেন! অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার
‘আসলে নোবেল পুরস্কার নয়’ বলে তিনি নিজে হাসির খোরাক হয়েছেন। বিদ্যুৎবাবু ভুলে যাবেন না, ইট ছুড়ে গাছ থেকে আম পাড়া যায়, কিন্তু হিমালয়ের চূড়া ছোঁয়া যায় না।
বিদ্যুৎবাবুই বিশ্বভারতীর শেষ কথা। তাঁর সিদ্ধান্তের জন্য প্রায়ই সঙ্কটে পড়েন ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকরা। তাঁর আমলেই উচ্চশিক্ষার জন্য কারও বিদেশযাত্রা বন্ধ হয়েছে, কারও আটকানো হয়েছে প্রজেক্ট। অনুমতি দেওয়ার বারবার অনুরোধেও কাজ হয়নি। আর প্রতিবাদ জানালেই লাগিয়ে দেওয়া হয় ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধী’ তকমা। তারপর নেমে আসে শাস্তির খাঁড়া। প্রতিকারের একটাই জায়গা, আদালত। তাই ছাত্রছাত্রী থেকে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী লাইন দিচ্ছেন আদালতে। আর তাঁর আমলে লাইনটা দিন দিন বেড়েই চলেছে। পড়াশোনার মান নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। তাঁর অভিভাবকত্বে এই কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। ন্যাক এবং এনআইআরএফ-এর সমীক্ষায় মিলেছে তারই প্রমাণ।
এহেন বিদ্যুৎবাবু একজন বিশ্ববন্দিত অর্থনীতিবিদকে ও মুখ্যমন্ত্রীকে এমন কদর্য আক্রমণ করায় কিছু প্রশ্ন উঠছে। উপাচার্য কি তাহলে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যৎ নির্মাণে নেমে পড়লেন? উপাচার্য হিসেবে তাঁর কার্যকালের মেয়াদ এবছরই শেষ হওয়ার কথা। আর সেই জন্যই কি দিল্লীশ্বরদের নজর কাড়ার মরিয়া চেষ্টা? আর সেই কাজে অমর্ত্য সেন এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই সবচেয়ে ভালো টার্গেট। দু’জনই বিজেপির বিভাজনের রাজনীতির ঘোর বিরোধী।
অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্যতম সরকারগুলোর মধ্যে একটি হল ভারতের মোদি সরকার।’ আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? একুশের নির্বাচনে তিনি মোদিজির নাকে ঝামা ঘষে দিয়েছিলেন। তাই এই দু’জনকে অপদস্থ করতে পারলে দিল্লির কর্তারা যে বেজায় খুশি হবেন, সেটা বিদ্যুৎবাবু বিলক্ষণ জানেন। আর দিল্লি খুশি হলেই জুটবে পুরস্কার। অনেকে বলছেন, বিদ্যুৎবাবু যেভাবে প্রধানমন্ত্রীর মার্গদর্শনে আস্থা রেখেছেন তাতে তাঁর ভারতরত্ন বা রাজ্যপালের পদ না জুটলেও এক্সটেনশন ঠেকায় কে?
অমর্ত্য সেন অর্থনীতিতে নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন ১৯৯৮ সালে। তারপরের বছরই তাঁকে ‘ভারতরত্ন’ সম্মানে ভূষিত করেছিল বিজেপি সরকার। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ি। আর সেই নোবেল নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিলেন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। এখনও কেন্দ্রে বিজেপি সরকার। একজন বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদকে কুৎসিত আক্রমণ করায় দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় বয়ে গেলেও কেন্দ্রীয় সরকার নীরব। কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। আর তাতেই বোঝা যাচ্ছে, অটলজির কাছ থেকে ‘রাজধর্ম পালনে’র সেই শিক্ষাটা মোদিজি নেননি।
জগদীপ ধনকার বাংলায় রাজ্যপাল হওয়ার পর থেকেই নজিরবিহীনভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সরকারকে আক্রমণ করেছিলেন। রাজ্যপাল রাজ্য সরকারের অভিভাবক। তা সত্ত্বেও সরকারকে রক্ষা না করে আক্রমণ করতেন। উদ্দেশ্য ছিল, বঙ্গ বিজেপিকে অক্সিজেন জোগানো। তাই হাজার সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি তাঁর অবস্থান বদলাননি। তাঁর বিরুদ্ধে দিল্লিতে নালিশ জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি। উল্টে আক্রমণ হয়েছিল আরও তীব্র। আর সেই ধারাবাহিতা বজায় রাখতে পারায় রাজ্যপাল থেকে হয়েছেন দেশের উপরাষ্ট্রপতি।
গত লোকসভা নির্বাচনে বঙ্গে কয়েকটি জায়গায় গেরুয়া ঝড় বয়ে গেলেও বীরভূম জেলার দু’টি আসনেই জয়ী হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। একুশের বিধানসভা ভোটে অনুব্রতর গড় ভাঙার জন্য বীরভূমে পোস্টিং দেওয়া হয়েছিল নন্দীগ্রাম খ্যাত নগেন্দ্রনাথ ত্রিপাঠীকে। কিন্তু তাতেও বিজেপি সুবিধে করতে পারেনি। একটি বাদে সব আসন জিতেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। সেই অনুব্রতকে গ্রেপ্তার করেছে সিবিআই। পাশাপাশি চলছে ইডির তদন্ত। কেন্দ্রের জোড়া এজেন্সির তদন্তের জেরে পঞ্চায়েতের আগে জেল থেকে বেরনোর সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তবুও স্বস্তিতে নেই বিজেপি। কারণ বীরভূমের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। আর প্রতিপক্ষ হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে
পাথরের চেয়েও কঠিন, সেটা বিজেপি খুব ভালো করেই জানে। সেই জন্যই কি কেন্দ্রীয় এজেন্সির পাশাপাশি নামিয়ে দেওয়া হল কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়কেও? তা না হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বের মুখে কেনই বা রাজনীতিকের ভাষা!
ধনকার অনেক চেষ্টা করেও বাংলাকে বিজেপির হাতে তুলে দিতে পারেননি। তবে, তাঁর চেষ্টার খামতি ছিল না। পরিশ্রমের মূল্যও পেয়েছেন। বিদ্যুৎবাবুও পারবেন না। তবে জানতে বড় ইচ্ছা হচ্ছে, কোন গাজরের লোভে তিনি বাঙালির গর্ব বিশ্বভারতীকে এতটা নীচে নামালেন।