বিদ্যালাভের পক্ষে দিনটি উত্তম। ব্যবসার উন্নতি, পেশায় সুনাম। উপার্জন বাড়বে। ... বিশদ
সামান্য আলো ফুটতেই ক্ষিতিমোহন বেরিয়ে এলেন স্টেশনের বাইরে। পথে হাঁটতে শুরু করলেন। এবং রাস্তায় হাঁটার সময় তিনি একটি অলৌকিক কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন। কেউ একজন গান গাইছে। ‘তুমি আপনি জাগাও মোরে’। আশ্রমে পৌঁছে ক্ষিতিমোহন জানতে পারেন রবীন্দ্রনাথ ভোর তিনটে নাগাদ ঘুম থেকে উঠে পড়েন। আর তারপর ধ্যানে বসেন পূর্বাস্য হয়ে। এরপর এই গান। ক্ষিতিমোহন নিজেই বিস্ময়ের সঙ্গে লিখেছিলেন, শান্তিনিকেতনের দেহলি নামক বাড়ির দোতলায় রবীন্দ্রনাথ গান গাইছেন। আর সেই গান বোলপুর স্টেশনের রাস্তায় শোনা যাচ্ছে, এটা এক আশ্চর্য ঘটনা হলেও এতটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠের শক্তি। সেই প্রথম দিন থেকে ৫০ বছর শান্তিনিকেতনেই রয়ে গিয়েছিলেন আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন। এই ব্রহ্মচর্যাশ্রমকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ দেওয়ার পথ চলায় তাঁর অবদান অকল্পনীয়।
কতটা স্বীকৃতিপ্রাপ্ত জ্ঞানী ছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন? গত শতকের পাঁচের দশকে অক্সফোর্ডে স্প্যালডিং প্রফেসর হিসেবে প্রাচ্য দর্শন ও নীতিবিদ্যাশাস্ত্র পড়াতেন সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ। বিখ্যাত গ্রন্থ প্রকাশনা সংস্থা পেঙ্গুইন বুক ভারতীয় শাস্ত্র সম্পর্কে বই প্রকাশ করতে আগ্রহ প্রকাশ করলে, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ একবাক্যে তাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন, আপনারা শান্তিনিকেতনের মহাপণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেনকে অনুরোধ করতে পারেন এই বিষয়ে লিখতে। ভারতে তাঁর মতো হিন্দুশাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত কমই আছে। তবে তিনি হিন্দি, বাংলা অথবা সংস্কৃতে লিখবেন। ইংরাজি অনুবাদকের একজন ব্যবস্থা করতে হবে। সেই মতোই পেঙ্গুইন বুকসের পক্ষ থেকে ‘হিন্দুধর্ম’ শীর্ষক বই লিখতে বলা হয় ক্ষিতিমোহনকে। এবং সেই বইয়ের ইংরাজি অনুবাদ করেন ক্ষিতিমোহন সেনের দৌহিত্র অমর্ত্য সেন। যিনি অর্থনীতির ছাত্র ও অধ্যাপক হলেও অসামান্য সংস্কৃতজ্ঞ।
ক্ষিতিমোহন সেনের কন্যা অমিতা সেন রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যগুলির সিংহভাগের পারফর্মার ছিলেন। যে নৃত্যশৈলীকে আজ বলা হয় আধুনিক নৃত্য, সেই আধুনিক নৃত্যের স্টাইলও সেই সময় তাঁদের নৃত্যদলের মাধ্যমেই প্রথম চালু হয়। আবার আশ্চর্যজনকভাবে সেই একই নারী জুডো নামক মার্শাল আর্টে ছিলেন পারঙ্গম। নাচ এবং জুডো। সেই সময় যা ছিল বাঙালি শিক্ষিত পরিবারের কাছে যথেষ্ট দূরবর্তী এক বিষয়, চর্চার ক্ষেত্রে। সেই দুটি নিয়েই উৎকর্ষের শীর্ষে যান অমিতা সেন।
ক্ষিতিমোহন সেনকে ব্রহ্মচর্যাশ্রম থেকে দেওয়া হয়েছিল বাসস্থান। গুরুপল্লীতে। আর তাঁর কন্যা ও জামাতা ঢাকা থেকে এসে শ্রীপল্লীতে পৃথক একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। যার নাম দেওয়া হয় প্রতীচী। ক্ষিতিমোহনের স্ত্রী কিরণবালা একাধারে ছিলেন অসামান্য চিত্রশিল্পী এবং ধাত্রীমাতা। আধুনিক সন্তানপ্রসব ব্যবস্থা শিখে তিনি বোলপুর শান্তিনিকেতনের গরিব মানুষের ঘরে ঘরে বিজ্ঞানসম্মতভাবে নিরাপদ উপায়ে মা ও সন্তানকে যাতে বাঁচিয়ে রাখা যায়, সেই লক্ষ্যে নিপূণ প্রসব বিদ্যায় তিনি সেই সময়ে ওই গ্রাম্য এলাকায় ছিলেন কিংবদন্তি।
বাঙালি হিসেবে আমাদের একটাই সংশয়। বর্তমান বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি বঙ্গ বিজেপির একাংশ যে অধ্যাপক অমর্ত্য সেনকে লক্ষ্য করে নানাবিধ অসম্মানসূচক লাগাতার মন্তব্য করে চলেন, সেটা কি তাঁদের মনের কথা? নাকি তাঁদের কেরিয়ারের জন্য এরকম করে যাওয়া খুবই প্রয়োজন? কারণ, সকলেই নিজেদের প্রভু অর্থাৎ উপরওয়ালাকে খুশি করতে চায়। যাঁরা লাগাতার অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের নোবেল পাওয়াকে ‘মিথ্যা’ কথা বলে আখ্যা দেন, জমি দখলদার হিসেবে তকমা দিয়ে থাকেন, তাঁরা কি তাঁদের দিল্লিবাসী প্রভুদের খুশি করার জন্য এতটাই মরিয়া যে, নিজেদের বাঙালিয়ানার আইডেন্টিটিকেও জলাঞ্জলি দিতে দ্বিধা করছেন না?
অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের জগৎজোড়া খ্যাতি ও স্বীকৃতি। বাংলায় ১৯১৩ সালের পর থেকে একাধিক নোবেল এসেছে। অন্য প্রদেশবাসীর মনে ক্ষোভ জমতেই পারে। বিশেষ করে যেসব প্রদেশের প্রতিনিধিরা নিজেদের রাজ্যকে ভারতের মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করেন। তাঁদের এই আন্তর্জাতিক নোবেল অথবা অস্কারের ব্যাপারে মনে ঈর্ষা হতেই পারে। যদিও তাঁরা নিছক ওই কারণেই যে অমর্ত্য সেনের উপর ক্ষিপ্ত তা নয়।। অমর্ত্য সেন যেহেতু লাগাতার বিজেপির বিভাজনের রাজনীতি এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সরব, প্রতিবাদ করে থাকেন, সেই কারণে তাঁদের এই ক্রোধ। কিন্তু সাধারণ নিয়মে সেই প্রতিবাদ অথবা বিরুদ্ধতার জবাব দেওয়া উচিত পাল্টা যুক্তি কিংবা ঐতিহাসিক রেফারেন্স দিয়ে।
যখনই সেই ইতিহাস অথবা যুক্তির রেফারেন্সকে এড়িয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হবে, অপমান করা হবে এবং সমাজের চোখে প্রতিপক্ষকে হেয় প্রতিপন্ন করা হবে অশালীনভাবে, তখনই প্রমাণ হয় যে, আক্রমণকারীদের কাছে ক্ষমতা আছে, যুক্তি নেই। তর্কে তারা পরাস্ত করতে পারছে না অমর্ত্য সেনকে। তাই ব্যক্তি আক্রমণকে বেছে নেওয়া হয়েছে। দুটি অভিযোগ ক্রমাগত করা হচ্ছে। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ বলেছে, প্রতীচী বাড়ির কাছে যত জমি থাকা উচিত, তার থেকে বেশি জমি দখল করে রাখা হয়েছে। ওই জমি ছেড়ে দিতে হবে। আর দ্বিতীয়ত নোবেল পাননি অমর্ত্য সেন। যে বাড়ির সঙ্গে আচার্য ক্ষিতিমোহন সেনের স্মৃতি জড়িয়ে, সেটা নিয়ে এরকম বুক ফুলিয়ে লাগাতার কার্যত অপপ্রচার করার প্রয়াস আদতে কাদের খুব আনন্দ দিচ্ছে? দিল্লীশ্বরদের এবং অন্য প্রদেশবাসীকে। বাঙালির শিক্ষা আইকন হিসেবে যাঁদের নিয়ে আমরা গর্ব করি, তাঁদের প্রকাশ্যে অপমান করা হলে কারা তৃপ্তি পাবে? যারা বাঙালিকে জাতি হিসেবে প্রথম থেকে ইতিহাসগতভাবে পছন্দ করে না। তার ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ। তিনি বাঙালির এই অপমানের যোগ্য জবাব দিতে আসরে আবির্ভূত হয়ে সরকারি নথিপত্র প্রকাশ্যে এনে দেখিয়েছেন, বিশ্বভারতীর অভিযোগ অসত্য। বরং তিনি পরোক্ষে হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন যে, এরপর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রশ্ন হল, বঙ্গ বিজেপি লাগাতার তাদের দিল্লীশ্বরদের খুশি করতে বাংলা ও বাঙালির বিরাগভাজন হয়ে চলেছে কেন? এই আত্মঘাতী আচরণগুলির কারণ কী? তাদের একাংশ অমর্ত্য সেনকে অপমান করে। তাদের একাংশ আবার বাংলাকে ভাগ করার পক্ষে সওয়াল করে। এসব করে সবথেকে বেশি ক্ষতি তো বঙ্গ বিজেপিরই!
স্বস্তির কথা অবশ্য একটাই। ভবিষ্যৎ ইতিহাস বিশ্বভারতীর বর্তমান কর্তৃপক্ষ অথবা তাঁদের কোনও মৌলিক অবদানের কথা মনেই রাখবে না। পদ থেকে অপসারিত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের নামও ভুলে যাবে ইতিহাস। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন, আচার্য ক্ষিতিমোহন সেনদের নাম কিন্তু রয়েই যাবে বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাসে! এই পরিবারটিকে অপমান করার অর্থ কি বাঙালি সংস্কৃতিকেই অপমান করা নয়?