বিদ্যালাভের পক্ষে দিনটি উত্তম। ব্যবসার উন্নতি, পেশায় সুনাম। উপার্জন বাড়বে। ... বিশদ
চব্বিশের লোকসভা ভোটের আগে সরকারের এটাই শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। ভাবা হয়েছিল, সাধারণ মানুষের জন্য বিশেষ সুরাহা এতে থাকবে। কিন্তু তেমন কোনও প্রস্তাবও এল না।
কর ছাড়ের যে-কথা বলা হয়েছে, সেটাও কেবলমাত্র নতুন ব্যবস্থার জন্য। পুরনো করব্যবস্থায় ছাড় বা লাভ তেমন নেই। এই বাজেট থেকে সুবিধা পাবেন সম্পন্ন মধ্যবিত্ত এবং বেশিটাই উচ্চবিত্ত মানুষ। যার যত আয় তার সুবিধা প্রাপ্তি, ছাড় ও লাভ তত বেশি। তাই এই বাজেট সমাজে অসাম্য আরও বেশি বাড়াবে। ছাড় পেলেন শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকারীরা। সাধারণ মানুষের এতে উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। মিউচুয়াল ফান্ড থেকে আয়ের উপর ছাড় নেই। সোনা ও রুপোর দাম বাড়ছে, আরও বাড়বে।
অর্থনীতির উপর এই বাজেটের সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া খুবই নেতিবাচক হতে বাধ্য। সুদের হার বাড়বে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার কোনও ভাবনাই নেই। আমদানি শুল্ক হ্রাসের কারণে বাড়বে আমদানি। রপ্তানি বাড়াতে নতুন কোনও ঘোষণা নেই। ফলে, বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি বাড়বে, যার পরিণামে টাকার দাম কমবে, সমস্ত জিনিসপত্র হবে অগ্নিমূল্য। এমন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই দেশ চলছে। আগের বাজেটগুলির লাগাতার ভুলের মাশুল গুনছে মানুষ। এইভাবেই নিরন্তর দামবৃদ্ধির চক্রের মধ্যে দিয়ে পেরচ্ছে অর্থনীতি। এই বাজেট তার প্রতিষেধক হিসেবে কিছু ব্যবস্থা নেবে, এটাই ভাবা হচ্ছিল। কিন্তু সেই পথে হাঁটলেনই না নির্মলা সীতারামন।
আসলে অর্থমন্ত্রীর কাছে সাধারণ মানুষকে রেহাই দেওয়ার চাইতে বৃদ্ধির হার বাড়ানোই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই মুদ্রাস্ফীতির নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা না নিয়েই তিনি উচ্চবিত্তকে ছাড় দিয়ে বাজারে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়াতে চেয়েছেন। যে-রাষ্ট্র এভাবে চলে, তার বাজেট রচিত হয় বড়লোকদের কথা ভেবে। সাধারণের সঞ্চয় বাড়িয়ে চাহিদা বাড়বে, সেই ভাবনাটাই নেই। তাই কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সম্ভাবনা সামান্যই। বড়লোকের ভোগ্যপণ্য নির্ভর শিল্পগুলিতে কর্মী নেওয়ার সুযোগ কমছে। সেখানে এখন চলছে দ্রুত গতিতে রোবোটিক আধুনিকীকরণ। এই বাজেটে ধাক্কা খেল বস্ত্রশিল্প, ব্রাত্য রইল নির্মাণ ও গাড়ি শিল্প, ম্যানুফ্যাকচারিং এবং পরিষেবা ক্ষেত্র। অথচ আম জনতার চাকরির সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র এইগুলোই। কৃষি, ছোট ব্যবসা এবং গ্রামোন্নয়নের বিকাশে বড় কোনও ঘোষণা নেই।
সরকার আম জনতার কথা ভেবে কোনও প্রস্তাব রাখেনি। তাঁদের জীবিকার স্বার্থে, সঞ্চয় বাড়ানোর উদ্দেশ্যে কোনও কথা নেই। অথচ বাজেট প্রস্তাবে সরকার জানিয়েছে, তারা কর ছাড়া নির্ভর করছে ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের উপরই বেশি। নতুন বন্ড ছেড়ে খোলা বাজার এবং সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা তোলার কথা বলা হয়েছে। এতে অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী, সুদের হার আরও বাড়বে। তাতে চাপে পড়বে শিল্প-বাণিজ্য। ফলে নতুন লগ্নি, চাকরি, কর্মসংস্থান কমিয়ে আনা হবে। ছাঁটাই বাড়বে। এদিকে বাজেটে এমন কিছু প্রস্তাব আছে যাতে বড়লোকের আয় এবং অসাম্য বাড়বে। অন্যদিকে, সার্বিকভাবে সাধারণ মানুষ ও দেশের কোষাগারের আয় কমতে বাধ্য।
এই বাজেটের একমাত্র ইতিবাচক দিক হল—পরিকাঠামো ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ বরাদ্দ বৃদ্ধি। কিন্তু সেটাতেও সাধারণের বিশেষ লাভ নেই। উন্নত পরিকাঠামো তুলে দেওয়া হচ্ছে পেটোয়া কর্পোরেট গোষ্ঠীগুলোর হাতে। এগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকলে বা ব্যবহার করার বরাত সরকারি সংস্থাগুলো পেলে শ্রীবৃদ্ধি হতো দেশের কোষাগারের। সুফল পেত সাধাণ মানুষও। আরও পঞ্চাশটি নতুন বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, শহর, গ্রিন এনার্জি, হাইড্রোজেন জ্বালানি তৈরির প্রকল্প প্রভৃতির বরাত পাবে কর্পোরেট ক্ষেত্র। বাজেটে এই প্রস্তাব দেখে লাফাচ্ছে শেয়ার বাজার। জনগণের সঞ্চয়ের টাকা ব্যাঙ্ক মারফত তারাই ঋণ হিসেবে নেবে, লগ্নি করার জন্য পাবে। লাভের মুনাফা তাই কুক্ষিগত হবে তাদেরই কাছে। এভাবেই বাড়বে অসাম্য। এই দেশে তৈরি হবে আরও কিছু ধনাঢ্য (বিলিয়নেয়ার) মালিক। সরকার চাইছে, আরও অনেক উদ্যোগপতি গড়ে তুলতে। তাই নতুন স্কিল ডেভেলপমেন্ট ও স্টার্ট আপ গড়ে তোলার বরাদ্দ বেড়েছে। এসবই সমাজের সেই উচ্চস্তরের শিক্ষিত ও পুঁজির মালিকদের জন্য। পরিণামে, আরও ক্ষুধার কষ্ট নিয়ে ঘুমোতে যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা যে বাড়বে, তা নিয়ে হেলদোল নেই এই বাজেটের। দাম বৃদ্ধি ও বেকারির যে চাপ সাধারণের উপর পড়বে, তা হ্রাসেরও দিশা দেখানো হয়নি। শুধুই ‘উন্নয়নের’ কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু কার উন্নয়ন? তার কোনও উত্তর নেই। এভাবেই অর্থমন্ত্রীর নানা প্রস্তাবের পর্দা সরিয়ে সেটা বুঝে নিতে হচ্ছে।
এই বাজেটে আছে রাজনীতির কৌশলী হিসেব। গত নির্বাচনগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে—উচ্চবিত্ত হিন্দু ভোট সংহত করতে পারলে আর দলিত ও আদিবাসী ভোট ক্রমশ বিজেপির দিকে ঝুঁকে পড়লে হিন্দিবলয়ে নরেন্দ্র মোদির প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখা সম্ভব। সেদিকে তাকিয়েই নানা প্রস্তাব সাজানো হল এবারের বাজেটে। দলিত ও আদিবাসীদের জীবন ও জীবিকার উন্নয়নে প্রস্তাব রাখা হয়েছে। একইসঙ্গে ধর্মীয় উৎসবে উৎসাহ দিয়ে এবং গোবর্ধন স্কিম এনে হিন্দু রাজনীতি ও পুঁজির যৌথ ককটেল তৈরি করল সরকার। এখন দেশে উচ্চবিত্তকেন্দ্রিক অর্থনীতির নির্মাণই মোদির এজেন্ডা। তাদের শহরকেন্দ্রিক উন্নয়নই লক্ষ্য। বাকি মানুষ যেন অন্য ভারতের বাসিন্দা। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ও পুঁজি রাষ্ট্র ভাবনার আধারে জারি রইল ডিজিটাল ইন্ডিয়ার নির্মাণ। এভাবেই গড়ে তোলা হয়েছে কেন্দ্রীয় বাজেট।
তৈরি হবে নতুন ‘অমৃতকাল’। মোদি-যুগের সুবিধাভোগী কারা? সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণি। সাধারণ মানুষ পাবেন ছিঁটেফোঁটা। নেই সর্বসাধারণের ক্ষমতায়নে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার জন্য প্রস্তাব। জনস্বাস্থ্য ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য কাঠামো বিস্তারে তাই নেই ব্যয় বরাদ্দ। নেই মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের (এমএসএমই) জন্য ঋণমুক্তির প্রস্তাব। উল্টে এল তাদের আরও লোন প্রদান ও রিফান্ড প্রস্তাব। এই নিদান তাদের ঘুরে দাঁড়াতে বাস্তবিকই কোনও উপকারে আসবে না। তাই অনাহারী কৃষি শ্রমিক, ক্ষুদ্র চাষি এবং সার্বিকভাবে কৃষকের কল্যাণে কোনও বরাদ্দ এই বাজেটে নেই। তুলনায় ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার (এনপিআর), আধার ও ব্যবসার জন্য প্যান, ডিজিটাল আইডেন্টিটি, ডিজি লকার তৈরি প্রভৃতিই অগ্রাধিকার পেয়েছে। ভোট পেরলেই মেয়াদ ফুরোবে—এমন স্কিমও চালু করে বলা হচ্ছে এটা প্রধানমন্ত্রীর মহিলা সম্মান! গ্রামে গ্রামে আবাস যোজনায় বরাদ্দ বৃদ্ধি আম জনতার একমাত্র প্রাপ্তি। বাজেটে উপেক্ষিত দেশ, গ্রাম ও সাধারণ মানুষ। লক্ষ্য কেবলই উচ্চবিত্তের ইন্ডিয়া, যেখানে কর্পোরেট উন্নয়নই শেষ কথা।