গৃহ পরিবেশে চাপ ও মানসিক চিন্তা বৃদ্ধি। কপট লোকের দ্বার কর্মে বিপত্তি ও অর্থক্ষতির যোগ। ... বিশদ
জি-২০-র সভাপতিত্বের দায়িত্বভার ভারতের উপর অর্পিত হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে খুব স্বাভাবিকভাবেই যে প্রশ্নটি আমার মনে এসেছিল তা হল, জি-২০কে কি আরও সাফল্যের দিকে আমরা নিয়ে যেতে পারি না? সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তনকে এমন একটি পর্যায়ে উন্নীত করতে পারি না যা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করবে?
হ্যাঁ, আমরা পারি। এটাই আমার স্থির বিশ্বাস।
আমাদের মানসিকতা গড়ে ওঠার পিছনে পরিস্থিতির এক বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে। যদি আমরা ইতিহাসের পাতা ওল্টাই তাহলে দেখতে পাব যে, সার্বিকভাবে মানবজাতিকে বেঁচে থাকতে হয়েছে অভাব-অভিযোগকে সঙ্গে করেই। সীমিত সম্পদের সেই আবহে আমরা পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছি। কারণ, আমাদের অস্তিত্ব নির্ভর করেছে অন্যকে বঞ্চিত করে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা আহরণের মধ্য দিয়েই। মতবাদ, মতাদর্শ এবং আত্মপরিচয়— এই সবকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক তীব্র সংঘর্ষ ও প্রতিযোগিতা। আসলে, এটাই যেন হয়ে উঠেছিল স্বাভাবিক এক নিয়ম-নীতি!
দুর্ভাগ্যবশত, আমরা আজও সেই মানসিকতার মধ্যে নিজেদের বন্দি করে রেখেছি। সম্পদ ও ভূখণ্ড দখলের জন্য একটি দেশ অন্যটির সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে। অস্ত্র দেখিয়ে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যসামগ্রী। কোটি কোটি মানুষের প্রাণ সংশয় জেনেও ভ্যাকসিন অর্থাৎ প্রতিষেধককে মজুত করে রাখার প্রবণতাও আমরা লক্ষ করেছি।
তর্কের খাতিরে অনেকেই হয়তো বলবেন , সংঘাত ও সংঘর্ষ এবং লোভ ও লালসা তো মানব প্রকৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। না, একথা আমি স্বীকার করি না। যদি মানুষ তাঁর অন্তরাত্মার দিক থেকে স্বার্থপর হয়ে উঠত, তাহলে কীভাবে আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের বাণী এক শাশ্বত সত্য হয়ে পৌঁছে যেত বিশ্ব জগতের সর্বত্র? ঐক্যের ধ্বনি কি অনুরণিত হয়নি এই আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের মধ্যে?
এই ধরনের একটি ঐতিহ্য আমাদের ভারতবর্ষে খুবই জনপ্রিয়। পাঁচটি মূল উপাদান থেকে সমস্ত প্রাণী এবং জড়বস্তুর উদ্ভব ও উৎপত্তির কথা বলা হয়েছে সেই বিশেষ ঐতিহ্যে। ভূ (পৃথিবী), জল, অগ্নি, বায়ু এবং আকাশ হল সেই পাঁচটি বিশেষ উপাদান যা ‘পঞ্চতত্ত্ব’ নামে পরিচিত। ব্যবহারিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত দিক থেকে আমাদের ভালো থাকার পক্ষে এর অবদান অনস্বীকার্য। এইভাবেই গড়ে
উঠতে পারে সমস্ত প্রাণীর মধ্যেই সম্প্রীতির এক
উন্নত বাতাবরণ।
এই ঐক্যের বাণীই আমরা পৌঁছে দিতে চেষ্টা করব ভারতের জি-২০র সভাপতিত্বকালে। তাই, আমাদের মূল থিম বা বিষয়বস্তু হয়ে উঠবে— ‘বসুধৈবকুটুম্বকম’। এর অন্তর্নিহিত অর্থ হল, সমগ্র পৃথিবীই হল এক অভিন্ন পরিবার। তাই, আমাদের সকলের ভবিষ্যৎ-ও এক ও অভিন্ন। এটি একটি স্লোগানমাত্র নয়। যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বর্তমানে মানবজাতি এগিয়ে চলেছে, সাম্প্রতিককালে তার কিছু কিছু পরিবর্তন অবশ্যই ঘটেছে, যা আমরা সার্বিকভাবে অনুভব বা উপলব্ধি করতে পারিনি। কিন্তু আজ, বিশ্ব মানবতার ন্যূনতম চাহিদা পূরণের পথ বা উপায় আমাদের সামনে রয়েছে। বেঁচে থাকার জন্য, টিকে থাকার জন্য আমাদের এখন আর পরস্পরের সঙ্গে লড়াই করার প্রয়োজন নেই। কারণ, এই যুগ যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হওয়ার যুগ নয়। আর কখনওই তা হতে পারে না!
জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাস এবং অতিমারীর মতো বড় বড় চ্যালেঞ্জগুলির আমরা এখন মুখোমুখি। মনে রাখতে হবে, পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে এই চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলায় আমরা সফল হতে পারব না। ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাওয়ার মধ্য দিয়েই এই সমস্যাগুলির সমাধান সম্ভব।
সৌভাগ্যবশত, বর্তমান প্রযুক্তি মানবজাতির বিভিন্ন সমস্যা নিরসনে আমাদের পথ দেখাতে পারে। প্রযুক্তির কল্যাণে ভার্চুয়াল বিশ্বসংসার এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। ডিজিটাল প্রযুক্তির আজ প্রসার ঘটেছে সর্বত্র। সমগ্র মানবজাতির এক-ষষ্ঠাংশের বাসভূমি হল ভারত। ভাষা, ধর্ম, রীতি-নীতি ও আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এখানে বৈচিত্র্যের কোনও অভাব নেই। তাই, ভারতকে একটি ছোটখাটো বিশ্ব সংসার বললেও অত্যুক্তি হয় না।
সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার এক প্রাচীনতম ঐতিহ্যের দেশ হল ভারত। সেই অর্থে গণতান্ত্রিক মতাদর্শের ডিএনএ-র সন্ধান পাওয়া যাবে আমাদের এই ভারতেই। কারণ ভারত হল ‘গণতন্ত্রের জননী’। ভারতের জাতীয় মতৈক্য গড়ে উঠেছে কারও অঙ্গুলিহেলনে নয়, বরং কোটি কোটি মানুষের নির্ভয় ও অবাধ সমর্থনের মধ্য দিয়ে। এইভাবেই এক সম্প্রীতির সুর বেজে উঠেছে ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রতিটি তন্ত্রীতে।
ভারত বর্তমানে দ্রুততম গতিতে গড়ে ওঠা এক বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। দেশের প্রান্তিক নাগরিকদের অভাব, অভিযোগ ও প্রয়োজনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা। একইসঙ্গে, তরুণ প্রজন্মের মেধা ও প্রতিভাকে উৎসাহিত করে তাঁদের সৃজনশীলতার আবেগকে আমরা কাজে লাগিয়েছি।
আমাদের উন্নয়ন প্রচেষ্টার মূল লক্ষ্য কিন্তু শুরু হয় নাগরিকদের জন-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। আমাদের কাজের ধারা হল এমনই, যেখানে সমাজের উচ্চস্তরের মানুষের কল্যাণের দিকে আমরা প্রথমেই নজর দিই না, বরং সাধারণ নাগরিকদের কল্যাণকেই আমরা একটি অগ্রাধিকার বলে মনে করি। সাধারণের স্বার্থে প্রযুক্তিকে সম্বল করে আমরা এমন কিছু ডিজিটাল ব্যবস্থা গড়ে তুলেছি যা একাধারে মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। সামাজিক সুরক্ষা, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং ইলেক্ট্রনিক ব্যবস্থায় লেনদেনের ক্ষেত্রে তা এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনেক সমস্যার সমাধানের পথ এখন ভারত বাতলে দিতে পারে আমাদের এই প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন প্রচেষ্টার মাধ্যমে।
জি-২০-র সভাপতিত্বকালে ভারতের শিক্ষা, অভিজ্ঞতা এবং উন্নয়নের মডেলগুলিকে আমরা অন্যদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করব। বিশেষত, উন্নয়নশীল দেশগুলির কাছে তা অনুসরণযোগ্য
হয়ে উঠতে পারে। জি-২০-র সভাপতিত্বকালে অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রগুলি আমরা চিহ্নিত করব
শুধুমাত্র জি-২০ ভুক্ত দেশগুলির সঙ্গে পরামর্শের মাধ্যমেই নয়, সেইসঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিতে যাঁরা সফর করতে আসবেন তাঁদের সঙ্গে
আলাপ-আলোচনা করেও। কারণ, এই দেশে সফরে আসা পর্যটকদের কথা অনেক সময়েই আমাদের
কানে এসে পৌঁছয় না।
তবে, এক ‘অভিন্ন পৃথিবী’ গড়ে তোলাই যে আমাদের অগ্রাধিকারের একটি ক্ষেত্র হয়ে উঠতে চলেছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এক
‘অভিন্ন পরিবার’-এর সঙ্গে সম্প্রীতির সম্পর্ক সৃষ্টি করাই হবে আমাদের লক্ষ্য। তবেই এক ‘অভিন্ন ভবিষ্যৎ’-এর আশার বাণী আমরা পৌঁছে দিতে পারব সকলের কাছে।
আমাদের এই পৃথিবীকে সুস্থ রাখতে নিরন্তর এবং পরিবেশবান্ধব জীবনশৈলীকে আমরা উৎসাহ দিয়ে যাব। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা ও একাত্মবোধের যে ভারতীয় ঐতিহ্য আজও বহমান, তাকে অবলম্বন করেই এই প্রচেষ্টায় আমরা শামিল হব। সমগ্র মানবজাতির মধ্যে সম্প্রীতির প্রসারে বিশ্বের সর্বত্র খাদ্য, সার ও চিকিৎসার সাজ-সরঞ্জামের জোগানকে রাজনীতির কবল থেকে মুক্ত করার চেষ্টা আমরা চালিয়ে যাব। ভূ-রাজনৈতিক দ্বিধা-দ্বন্দ ও টানাপোড়েন যাতে কখনওই মানবজাতির কাছে সঙ্কটজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি না করতে পারে তা নিশ্চিত করাই হবে আমাদের লক্ষ্য। কোনও একটি পরিবারে যার বা যাঁদের প্রয়োজন সবথেকে বেশি, খুব স্বাভাবিকভাবেই সেদিকে আমরা প্রথম নজর দিই।
আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মগুলির মধ্যে আশাকে আরও সজীব করে তুলতে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে আমরা খোলামেলা মনে আলোচনার বাতাবরণকে উৎসাহ দিয়ে যাব। অস্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার যাতে কমিয়ে আনা যায় এবং বিশ্ব নিরাপত্তাকে যাতে নিশ্চিত করা যায়, সেই লক্ষ্যে আমরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব।
জি-২০-র সভাপতিত্বকালে আমাদের সবক’টি কর্মসূচিই হয়ে উঠবে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, অন্তর্ভুক্তিমূলক, কর্মপ্রচেষ্টা-কেন্দ্রিক এবং সুনির্দিষ্ট।
আসুন, আমরা সকলে মিলে চেষ্টা করি ভারতের জি-২০-র সভাপতিত্বের সময়কালটিকে সার্বিক কল্যাণ, সম্প্রীতি ও আশার এক বিশেষ সময়কালরূপে তুলে ধরার।
আমাদের বিশ্বায়নের লক্ষ্য হয়ে উঠুক পুরোপুরি মানবকেন্দ্রিক। এই সময়কালকে অনুসরণযোগ্য এক দৃষ্টান্ত রূপে তুলে ধরতে আমরা আগ্রহী। তাই আমি সকলকেই আহ্বান জানাই একত্রে কাজ করে যাওয়ার জন্য।