রাজনীতিক ও পেশাদারদের ব্যস্ততা বাড়বে। বয়স্করা শরীর স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিন। ধনযোগ আছে। ... বিশদ
কিন্তু যদি দেখা যায়, আমার সংগঠন বা দল যে নীতি ও আদর্শে বিশ্বাসী, তার বিপরীত মতাবলম্বী কোনও তুমুল জনপ্রিয় নেতাকে হত্যা করলাম, তার অর্থ কী? অর্থ হল, আমি তাঁর অথবা তাঁর দলের সঙ্গে নীতি ও আদর্শের লড়াইয়ে জিততে পারলাম না। বারংবার হেরে যাচ্ছি। তাই শর্টকার্ট পদ্ধতিতে আমি সেই দলের প্রধান নেতাকে হত্যা করলাম। কার্যত আমি এভাবে স্বীকার করে নিলাম যে, আমার দলের চিন্তাধারা ও দলীয় নেতৃত্ব জনপ্রিয়তার লড়াইয়ে ওই বিরুদ্ধপক্ষীয় নেতার কাছে হেরে গিয়েছে। তাই আমার খুব রাগ হয়েছে। সুতরাং রেগে গিয়ে আমি বিরুদ্ধপক্ষীয় নেতাকে হত্যা করে সরিয়ে দিলাম। ভাবলাম, এর ফলে আমার দল জনপ্রিয় হয়ে যাবে।
নাথুরাম গডসে, নারায়ণ আপ্তেরা এটাই ভেবেছিলেন। গডসে কি দেশভাগের জন্য গান্ধীহত্যা করেছেন? একেবারেই না। কারণ, তিনি তো একবার নয়। একাধিকবার গান্ধীকে হত্যা করার চেষ্টা করেছেন। কখনও পঞ্চগনিতে গিয়েছেন হামলা করতে। কখনও সেবাগ্রামে টার্গেট করেছেন। সেসব তো দেশভাগের আগে। নাথুরাম গডসে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করে বস্তুত অসহায়ভাবে পরোক্ষে যেন স্বীকারই করে নিয়েছিলেন যে, নীতি, আদর্শ ও চিন্তাধারার প্রতিযোগিতায় তাঁর দল অথবা সংগঠন মহাত্মা গান্ধীকে হারাতে পারছে না। গান্ধীর জনপ্রিয়তার ধারেকাছে ভারতজুড়ে নাথুরাম গডসের নেতারা জনপ্রিয় হতে পারছেন না। তাহলে কী করণীয়? সহজ পদ্ধতি। গান্ধীকে হত্যা করে ফেলা। খুবই বুদ্ধিহীন ও নিম্নমেধার সিদ্ধান্ত বলাই বাহুল্য। কারণ, প্রথমত এভাবে ভাবার মধ্যে সুদূরপ্রসারী সাফল্যের পরিকল্পনা, অনুশীলন কিংবা পরিশ্রম থাকে না। নিজের সমমনস্ক সংগঠন ও নেতাকর্মীদের কাছে হিরো হওয়ার বাসনা থাকে। নাথুরাম গডসের হৃদয়ে শোনা যায় প্রবল দেশপ্রেম ছিল। যে সময় সক্রিয়ভাবে হিন্দু মহাসভার সদস্য হয়েছেন, সেই সময় তাঁর বয়সি হাজার হাজার ভারতীয় নারীপুরুষ নেতাজির আজাদ হিন্দ বাহিনীর হয়ে সরাসরি ব্রিটিশের সঙ্গে লড়াইয়ে আত্মনিবেদন করে প্রাণদান করছেন। ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বম্বের একটি নৌবাহিনীর জাহাজ ও ব্যারাকে যে বিদ্রোহ সূচিত হল, সেখানে অল্পবয়সি রেটিংসদের সঙ্গে সাধারণ মানুষও যোগ দিয়েছিল ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলনে। বম্বে থেকে করাচিতে যুবসমাজ ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই বিদ্রোহের সমর্থনে। কী করছিলেন গডসে তখন?
যে সংগঠনের তিনি সদস্য হয়েছিলেন, সেই হিন্দু মহাসভা গান্ধীহত্যার আগেও সফল ছিল না ভোট মানচিত্রে। পরেও বিশেষ সাফল্য পেল না। ১৯৪৬ সালের বাংলার বিধানসভা ভোটে মাত্র তিন। গান্ধীহত্যার পরবর্তীকালে আরও তো উত্তরোত্তর জনপ্রিয় হওয়ার কথা ছিল! কই হল না তো! এমনকী স্বয়ং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পরে নিজস্ব পৃথক দল গঠন করলেন। হিন্দু মহাসভা রাজনৈতিক আলোচনাতেই আর নেই গত ৭০ বছর ধরে।
রুবি পার্কে একটি পুজোয় গান্ধীজিকে মহিষাসুর সাজিয়ে চমক দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। বিদ্বেষ ও ঘৃণার রাজনীতিকে উৎসবের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। হিন্দু মহাসভা নামক একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে এই আয়োজন। কিন্তু এই আয়োজকরা বাংলার সামাজিক আচরণটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। তারা বিশ্লেষণ করে দেখলে বুঝতে পারবে যে, বাংলা ওভার পলিটিসাইজড জাতি কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু আশ্চর্যভাবে এই জাতি কোনও ব্যাপারেই বাড়াবাড়ি অর্থাৎ মাত্রাজ্ঞানহীন আচরণ পছন্দ করে না। রিজেক্ট করে দেয়। ছয়ের দশকের শেষভাগ থেকে নকশাল আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। উগ্র বামপন্থার প্রচার ও ব্যক্তিহত্যা। শ্রেণিশত্রু হত্যার নামে সাধারণ ট্রাফিক পুলিস কিংবা গ্রামের কোনও ব্যবসায়ীকে হত্যা করা। এই গোটা মাত্রাছাড়া অবাস্তবতা নিয়ে আজও প্রচুর বই লেখা হয়। সিনেমা হয়। নাটক হয়। কিন্তু প্রকৃত বার্তাটি হল, বাঙালি ওই প্রোজেক্টকে রিফিউজ করেছে। কয়েক বছর একটু আতঙ্ক টেনশন উত্তেজনা, ছেলে হারানোর কান্না গ্রাস করে রেখেছিল। কিন্তু আমবাঙালির সমর্থন পায়নি। তাই ব্যর্থ হয়ে গবেষণা ও প্রবন্ধে ঢুকে পড়েছে ওই আন্দোলন। তাঁদের উদ্দেশ্য নিশ্চিত মহৎ ছিল। পথ ছিল অবাস্তব ও ইমম্যাচিওরড।
৩৪ বছর ধরে রাজ্যে একটি কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় ছিল। অথচ সেই রাজ্যের মানুষের মধ্যে ঈশ্বর আরাধনা, ধর্মীয় উৎসবের রমরমা একটুও কমল না তো বটেই, বেড়ে গেল উত্তরোত্তর। আজ আমাদের পারিপার্শ্বিক দেখলে মনে হয় যে এই রাজ্যটা ৩৪ বছর কমিউনিস্ট শাসনে ছিল? কী ছাপ পড়েছে ধর্মাচরণে? বাস্তববাদী জ্যোতিবাবু চেষ্টাও করেননি কখনও নাস্তিকতা কিংবা কমিউনিজম জোর করে বলবৎ করতে। কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকারী ক্ষমতার দর্পে প্রথমত বেশি বেশি কথাও বলতেন। আর আজীবন মানুষের পাশে থাকা দলকে সরিয়ে আনলেন বিরোধী ও সাধারণ মানুষের প্রতি দম্ভ, অহং এবং তাচ্ছিল্যের জগতে। সেটা কর্মস্থলে যাতায়াতের পথে অপাঙ্গে দেখল মানুষ। সেই সময় দুটি বাড়াবাড়ি এবং মাত্রাজ্ঞানহীনতার নমুনাও উপহার দিলেন তিনি। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম। ঠিক পরের বছর থেকেই মানুষ সরে যেতে শুরু করলেন। কারণ কিন্তু নিছক কোনও অপ্রাপ্তি ও উন্নয়নহীনতা নয়। প্রধান কারণ ওই আচরণগত মাত্রাজ্ঞানহীনতা। দাম্ভিকের ইমম্যাচিওরিটি।
২০২১ সালে বিজেপি ছিল যথেষ্ট সম্ভাবনাময়। কিন্তু হিল্লিদিল্লি থেকে নেতাদের নিয়ে এমন উচ্চগ্রামে একটা ভিন্ন সংস্কৃতির বাজনা শুরু হল যে, বাঙালি বিরক্ত হয়ে তাদের প্রত্যাখ্যান করল। সুতরাং মানুষের মনস্তত্ত্ব বুঝে নিখুঁত একটি ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা আয়ত্ত করতে না পারলে, এই রাজ্যে টিকে থাকা খুব সমস্যা। এই রাজ্যটি হুজুগে। কিন্তু একইসঙ্গে আবার সতর্ক। যেভাবেই হোক অতি সক্রিয়তা, অতি বিদ্বেষ, অতি ঘৃণা, অতি রাজনৈতিক দম্ভ, অতি আগ্রাসী সংস্কৃতি, কোনওটাই মেনে নেয় না। কতটা সংস্কৃতির সঙ্গে কতটা ধর্ম মেশাতে হবে, কতটা শিষ্টতার সঙ্গে কতটা রাজনৈতিক আগ্রাসন মেশাতে হবে, কতটা আক্রমণাত্মক বক্তৃতায় কতটা সৌজন্য মেশাতে হবে, এসব মাপার একটি অদৃশ্য পরীক্ষাগার আছে এই রাজ্যবাসীর মস্তিষ্কে। গান্ধীজির থেকে নেতাজি এখানে শতগুণ জনপ্রিয়। কিন্তু তাই বলে গান্ধীজিকে রাক্ষস বানিয়ে জনপ্রিয়তা পাওয়ার চেষ্টায় জয়ধ্বনি প্রত্যাশা করলাম, এসব ছেলেমানুষি অন্য রাজ্যে চলতে পারে। এখানে নয়। আর তাই রাতারাতি রূপ বদলে ফেলা হল। এই নির্বুদ্ধিতার অর্থ হল, রাজ্যবাসীকে না চেনা এবং রাজনীতিও না বোঝা! স্বাধীনতার পর থেকে এই রাজ্যটি সবথেকে বেশি প্রত্যাখ্যান করেছে অপরিণতমনস্কদের!