পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
আট বছর আগে যখন তিনি প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেন তখন বয়স ছিল ৬৪। আর আজ ৭২। ক্ষমতার দাপটে সেদিন থেকেই ১৭ সেপ্টেম্বরের আলাদা গুরুত্ব বিজেপির কাছে। ক্রমে তা ধারে ও ভারে পল্লবিত হয়েছে। শাখা প্রশাখা বিস্তার করেছে। ২৫ ডিসেম্বর বাজপেয়িজির জন্মদিনের জৌলুস অনেকটাই বিবর্ণ। কোনও টেস্ট না খেলেই নিজের জীবদ্দশায় গুজরাতের মোতেরা স্টেডিয়ামকে নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে পরিণত করেছেন তিনি। বেকার চাকরি না পাক, মূল্যবৃদ্ধি যতই জখম করুক সাধারণ মানুষকে ভোট রাজনীতিতে তিনি এখনও বুক উঁচিয়ে পয়লা নম্বরে। ওইটাই তাঁর শক্তি ও ক্যারিশমা। ‘ভারত জোড়ো’ আন্দোলনে নামা রাহুল, সোনিয়ার দল রাজ্যে রাজ্যে নেতা-বিধায়ক হারিয়ে রক্তশূন্য। বরং আজ ‘কংগ্রেস তোড়ো’, এই আওয়াজটাই টাকার জোরে উচ্চকিত গর্জনে পরিণত। কংগ্রেস ভেঙে ছোট ছোট আঞ্চলিক দল যত বাড়ে, ততই গেরুয়া পালে নতুন করে হাওয়া লাগার উপক্রম। ‘সবাই রাজার’ রাজত্বে জোট ধরে রাখার মতো শক্তিশালী মুখ বড্ড কম পড়িয়াছে! বিরোধীদের এই দুর্বলতার কথা জানেন বলেই ক্রমাগত তিনি কংগ্রেস ভাঙার খেলায় মশগুল। পাঞ্জাবের ক্যাপ্টেন থেকে কাশ্মীরের করণ সিং সবাই আজ গেরুয়ামুখী। কেউ সরাসরি তো কেউ আড়াল থেকে। সঙ্গে মোক্ষম বিভাজনের তাস। এই ফর্মুলাতেই তাঁর নজরকাড়া সাফল্য। এর নিট ফল, সরকারের সঙ্গে দলেরও একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ, যা বাজপেয়ি-আদবানি পর্যন্ত কোনওদিন স্বপ্নেও ভাবেননি। সেই দিক দিয়ে পরিবারবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে তিনিও জ্ঞাতে কিংবা অজ্ঞাতে দলে ও সরকারে নিঃশব্দে ব্যক্তিতন্ত্রকেই প্রতিষ্ঠা করেছেন। পরিবারতন্ত্রের মতো এটিও কম ভয়ঙ্কর নয়। কংগ্রেসের মতো বিজেপিতেও আজ আর সম্মিলিতভাবে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না। দল ও সরকার চলে একজনেরই অঙ্গুলিহেলনে। নীতির প্রশ্নে বাকিরা সবাই পুতুল কিংবা ল্যাম্পপোস্ট মাত্র। যতক্ষণ সাফল্য আসে এর রকমফের ঘটানো অসাধ্য। ফলে আপাতত বার্ধক্য, বয়স কোনওকিছুই তাঁর ক্ষমতা ভোগের পথে বাধা হবে বলে মনে হয় না। কারণ, সত্তর বছর বয়সের পর অন্য নেতাদের বাণপ্রস্থে পাঠানোর ব্যবস্থা হলেও তাঁর ক্ষেত্রে নিয়মটা ভিন্ন। এই জীবনে যোশি-আদবানির মতো দলের গালভরা মার্গদর্শকমণ্ডলীর তাৎপর্যহীন সদস্য হিসেবে তাঁকে থাকতে হবে না। আর দেড় বছর বাদে রুগ্ন কংগ্রেসের অপদার্থতা ও বিরোধীদের অনৈক্যের সুযোগে তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে ফিরলে তাঁকে ঘিরে জাতীয় রাজনীতির ধারাস্রোতই নতুন খাতে প্রবাহিত হবে। যার অভিঘাতে নেহরু-গান্ধীর সঙ্গে পুরনো বহু কীর্তিও মুছে যাবে। তখন আর তাঁকে পায় কে!
কিন্তু ইতিহাস তো বড়ই নির্মম। তাই বারবার ক্ষমতাধরকে নীরবে নিঃশব্দে শিক্ষা দিয়ে যায় অক্লেশে। চব্বিশ সালে তিনি তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হলে তাঁর বয়স তখন হবে ৭৪। অর্থাৎ ৭৯ বছর পর্যন্ত তাঁকে দেশের সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে থাকতে হবে। এতে করে ৭৫ বছর বয়সের আগেই পদ ও ক্ষমতা থেকে বিদায়ের যে রীতি (পড়ুন অলিখিত আইন) তিনি চালু করেছেন, তাকেই কোনওভাবে লঙ্ঘন করা হবে না তো? নাকি নিজের তৈরি করা আইনকেই পা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দেবেন অবলীলায়। এই টানাপোড়েন কিন্তু তাঁকে সইতে হবে। অনেকেই হয়তো মুখ ফুটে এখনই বলবেন না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে গজরাবেন। এবং সেই খেলায় তিনি জিতবেন কি না, তা ইতিহাসই বলবে।
জন্মদিনকে দেশব্যাপী একটা ইভেন্টে পরিণত করার এই উদ্যোগ কিন্তু শুরু হয় ক্ষমতায় এসেই। ২০১৪ সালে শুরু করে ধীরে ধীরে তা এগিয়েছে। গত বছর ১৭ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিনে দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রক টার্গেট নিয়েছিল আড়াই কোটি কোভিড টিকা প্রদানের। সেই লক্ষ্যমাত্রা ছাপিয়ে টিকাকরণ সম্পূর্ণ হয়। আর ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়েই প্রথম জন্মদিনে তিনি আমেদাবাদে চীনের রাষ্ট্রপ্রধান শি জিনপিংয়ের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে বসেন। তাঁকে সবরমতী আশ্রম ঘুরিয়ে দেখান। তারপর থেকে প্রতিটি ১৭ সেপ্টেম্বরকেই তিনি স্মরণীয় করে রেখেছেন। পাঁচ বছর আগে সর্দার সরোবর ড্যামকে জাতির উদ্দেশে উৎসর্গ করেন। আর এবার তো আয়োজন আরও বড়। নামিবিয়া থেকে আনা আটটি চিতাকে তিনি এদিনই মধ্যপ্রদেশের কুনো জাতীয় উদ্যানে ছেড়েছেন। মিলিত হয়েছেন সেল্ফ হেল্প গ্রুপের মহিলা ও আইটিআই সমাবর্তনে প্রশিক্ষিত ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গেও। দিয়েছেন স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ভাষণ।
কিন্তু তাঁর এই দশ হাজার ওয়াটের দেখানো সাফল্যের ঝলকানি আর উচ্চস্বরে ক্রমাগত ঢাক বাজানোর পাশেই ব্যর্থতার অন্ধকারও বড় কম নয়। নোটবন্দির ক্ষত, কৃষকদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা, জিএসটি নিয়ে বিভ্রান্তিকর নীতি চাপিয়ে দেওয়া দেশের মানুষ আজও মেনে নিতে তৈরি নয়। কালো টাকার দৌরাত্ম্য কমেনি, উল্টে বেড়েছে। আজ জনপ্রতিনিধি কেনাবেচার হাটে কালো টাকাই সরকার ভাঙাগড়ার প্রধান অস্ত্র। গণতন্ত্রকে সস্তা পণ্য করে তার ফায়দা লুটছে কে? সঙ্গে নাভিশ্বাস উঠছে কর্মসংস্থান ও আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির জোড়া আঘাতে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে গলা টিপে মারা হচ্ছে। মানুষের শেষ সম্বল এখন নির্বাচন কমিশন ও সুপ্রিম কোর্ট। তাছাড়া সুবিচার পাওয়ার আর কোনও জায়গা বেঁচে নেই। কাশ্মীর নিয়ে কত পরীক্ষা নিরীক্ষা হল, কিন্তু সমাধান এখনও দূরঅস্ত। এখন গুলাম নবি আজাদ ও বৃদ্ধ করণ সিংকে দিয়ে নতুন খেলা শুরু হচ্ছে। আর মানবাধিকার? সুপ্রিম কোর্ট জামিন দেওয়ার পরও সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান এখনও অন্য আর একটা মামলায় জেলে। কোনও দাগী অপরাধী নন, পাকিস্তানের জঙ্গিও নন। কিন্তু ইউএপিএ ধারায় প্রায় দু’বছর তিনি জেলবন্দি। তিস্তা শীতলবাদও কোনওক্রমে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তাই আজ ক্ষমতার দাক্ষিণ্যে কীর্তি যতই উজ্জ্বল হোক না কেন, স্বাধীনতার আসন্ন শতবর্ষে তা যেন ফিকে হয়ে মিলিয়ে না যায়। জৌলুস যেন অটুট থাকে। অমৃতকালের শেষে ২০৪৭’এর ১৭ সেপ্টেম্বর থেকেও পক্ষকাল সেবাপক্ষ পালিত হলে তবে বোঝা যাবে তিনি স্বাধীন ভারতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু তখন মানুষ দুয়ো দিলে, ৯৭ বছর বয়সে তা সইতে পারবেন তো! দেবীপক্ষ যুগ যুগ ধরে আসবে যাবে, কিন্তু সেবাপক্ষের আড়ালে মোদিপক্ষ?