বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
১৯৮৯ সালের ৪ জুনের রাতে বেজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে ছাত্র-বিক্ষোভ গুঁড়িয়ে দিতে চীনা ‘পিপলস লিবারেশন আর্মি’(পিএলএ)-র অভিযানে বহু প্রাণহানি ঘটেছিল। তার দু’বছর পর ১৯৯১ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি প্রতিনিধিদল বেজিং সফরে যায়। সফরসঙ্গী দুই কংগ্রেস সদস্যকে কিছু না জানিয়েই সেদিন পেলোসি তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে বিক্ষোভ দেখাতে চলে যান। কোনও অনুমতির তোয়াক্কা না করে তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে গিয়ে হাতে লেখা একটি পোস্টার নিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। ছোট কালো রঙের ওই পোস্টারে লেখা ছিল ‘যারা চীনের গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ দিয়েছেন’। চীনের মাটিতে দাঁড়িয়ে চীনেরই বিরোধিতা? এর থেকে লজ্জা কী হতে পারে? রাতারাতি পেলোসি হয়ে উঠেছিলেন চীনের ঘোর শত্রু। সেই শুরু...।
২০০২ সালে একবার চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হু জিনতাওয়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন পেলোসি। ওই বৈঠকে পেলোসি তাঁর হাতে চিঠি গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এসব চিঠিতে ছিল, চীন ও তিব্বতের বিক্ষোভকারীদের উপর নির্যাতন নিয়ে গভীর উদ্বেগ। তাঁদের মুক্তির আহ্বান। তবে হু ওই চিঠি প্রত্যাখ্যান করেন। এই ঘটনার সাত বছর পর তৎকালীন চীনের প্রেসিডেন্ট হু-কে হাতে হাতে আরেকটি চিঠি দেন পেলোসি। ওই চিঠিতে তিনি লিউ জিয়াবোসহ অন্য রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিতে আহ্বান জানান। চীনা সরকারবিরোধী নেতা লিউ জিয়াবো ২০১০ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন। তবে সেই পুরস্কার নিতে তাঁকে নরওয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। লিউ জিয়াবো নিয়ে তখন সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন পেলোসি।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ওলিম্পিক গেমসের আয়োজক দেশ হিসেবে চীনকে নেওয়ার বিরোধিতা করেছেন। ২০০৮ সালে চীনে গ্রীষ্মকালীন ওলিম্পিকসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বয়কট করতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে যেসব আইনপ্রণেতা অনুরোধ জানিয়েছিলেন, তাঁদের একজন পেলোসি। এ বছরও প্রায় একই চেষ্টা করেছিলেন পেলোসি। চীনে উইঘুর মুসলিমদের উপর নির্যাতনের অভিযোগে শীতকালীন ওলিম্পিকসে বেজিংকে কূটনৈতিকভাবে বয়কট করতে আহ্বান জানান হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের স্পিকার পেলোসি। বলেন, ‘ওলিম্পিকে যোগ দিতে দেশের প্রধান হিসেবে আপনারা চীনে যাচ্ছেন। অথচ চীনে গণহত্যা চলছে। এই অবস্থায় প্রশ্ন জাগে, এই আসনে বসে থেকে বিশ্বের কোনও দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কথা বলার কতটুকু নৈতিক অধিকার আপনাদের রয়েছে।’ বছরের পর বছর ধরে পেলোসি চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে বাণিজ্যিক অবস্থাকে মেলাতে চেয়েছেন। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় চীনের উপর শর্ত আরোপেরও চেষ্টা করেছেন। প্রশ্ন হল, চীনের আপত্তি অগ্রাহ্য করে পেলোসি হঠাৎ তাইওয়ান ছুটে গেলেন কেন?
নিওডিমিয়াম, ইউরোপিয়াম, প্রমিথিয়াম, স্ক্যান্ডিয়ামসহ মোট ১৭টি মৌলিক পদার্থকে একসঙ্গে বলে ‘রেয়ার আর্থ এলিমেন্ট’। মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান পর্যন্ত অতি উচ্চপ্রযুক্তির সব পণ্যে এই মৌলগুলি অত্যন্ত জরুরি। আগামী বিশ্ব এসব মৌল ছাড়া কোনওভাবেই কল্পনা করা যায় না এবং এর চাহিদা বাড়ছে অতি দ্রুত। রেয়ার আর্থ এলিমেন্ট প্রথাগত খনির মতো একসঙ্গে অনেক বেশি পাওয়া যায় না। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, ভারত, ভিয়েতনামসহ আরও কিছু দেশে এই মৌলগুলি পাওয়া গেলেও এর এক-তৃতীয়াংশের বেশি খনি রয়েছে চীনে। এর চেয়েও বড় কথা খনি থেকে সংগৃহীত মৃত্তিকার মৌলগুলি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা একচ্ছত্রভাবে চীনের হাতে। এখনও গোটা দুনিয়ায় এসব পণ্যের ৬০ শতাংশের বেশি সরবরাহ করে চীন।
লোহা ও অ্যালুমিনিয়াম বাদ দিলে একটি ইলেকট্রিক গাড়িতে অন্যান্য গাড়ির তুলনায় তিন গুণ বেশি খনিজ পদার্থ ব্যবহৃত হয়। এগুলি হল, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, লিথিয়াম, নিকেল, কোবাল্ট, গ্রাফাইট ও বেশ কয়েকটি রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস। বৈদ্যুতিন গাড়ি ব্যবহারের শুরুর দিকে ব্যাটারির সক্ষমতা এক বড় সমস্যা ছিল। যার কারণে একবার চার্জের পর গাড়ি বেশি দূর যেতে পারত না। ক্রমান্বয়ে অনেক বেশি সক্ষমতার ব্যাটারি বিদ্যুৎচালিত গাড়িকে অন্যান্য গাড়ির সঙ্গে তুলনীয় করে তুলেছে। ব্যাটারির এই বিপ্লবে প্রধান উপকরণ লিথিয়াম যেমন রয়েছে, তেমনই বিরাট ভূমিকা রয়েছে কোবাল্টের। যা ব্যাটারির চার্জ ধরে রাখা আর উত্তপ্ত হয়ে যাওয়া কমাতে জাদুর মতো কাজ করে।
বিশ্বের মোট কোবাল্ট মজুতের ৭০ শতাংশ রয়েছে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে। আর এই দেশের প্রধান ১৯টি কোবাল্ট খনির ১৫টিই চীনের নিয়ন্ত্রণে। এ ছাড়া এখানকার পুরো কোবাল্ট প্রক্রিয়াকরণ এবং ব্যবসার চাবিকাঠি চীনের হাতে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির (আইইএ) বলছে, ২০৪০ সালে লিথিয়াম ৪২ গুণ, গ্রাফাইট ২৫ গুণ, কোবাল্ট ২১ গুণ, নিকেল ১৯ গুণ, রেয়ার আর্থ এলিমেন্টসের ৭ গুণ চাহিদা বাড়বে। এসব পণ্যের বেশিরভাগের নিয়ন্ত্রণ চীনের হাতে। পরিস্থিতির নাটকীয় কোনও পরিবর্তন না হলে একসময় এসবের জন্য বিশ্ব পুরোপুরি নির্ভর করবে চীনের উপর। সেই ১৯৯২ সালে চীনের অর্থনৈতিক সংস্কারের জনক দেং জিয়াও পিং বলে গিয়েছিলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের আছে পেট্রলিয়াম আর আমাদের রয়েছে রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস।’ আর এটাই এখন আমেরিকার মাথাব্যথার অন্যতম কারণ।
সামনের পৃথিবীকে পাল্টে দেওয়া আরেক প্রযুক্তি কোয়ান্টাম কম্পিউটার গবেষণায় চীন এখন আমেরিকার সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দিচ্ছে। ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য জরুরি প্রায় প্রতিটি জিনিসের উপর চীনের নিয়ন্ত্রণ বাড়ছে। নেই শুধু একটা জিনিস, সেমিকন্ডাক্টর চিপ। ডেটা বা তথ্যকে যদি আধুনিক যুগের তেল বলা হয়, তবে চিপকে বলা চলে ইঞ্জিন। যেসব ইলেকট্রনিক পণ্যের উপর নির্ভর করে আজকের পৃথিবী দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেগুলির মূল ভিত্তি হচ্ছে চিপ। যন্ত্রের প্রাণ এই ‘চিপ’ নিয়ে এখন আমেরিকা ও চীনের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এই মাইক্রোচিপ নিয়েই এখন কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা। শুরু হয়ে গিয়েছে ‘চিপযুদ্ধ’।
সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরিতে একচ্ছত্র সক্ষমতা তাইওয়ানের। সর্বোচ্চ মানের অর্থাৎ ৭ ন্যানোমিটার বা তার চেয়ে কম আর্কিটেকচারের চিপ তৈরির প্রধান মার্কেট শেয়ার রয়েছে তাইওয়ানের দুই কোম্পানি তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি (টিএসএমসি) আর ইউনাইটেড মাইক্রো ইলেকট্রনিকস কোম্পানির (ইউএমসি)। চীনের কোম্পানি সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন (এসএমআইসি) চিপ উৎপাদক কোম্পানি হিসেবে পৃথিবীতে পঞ্চম হলেও সর্বোচ্চ মানের চিপ উৎপাদনের আশপাশেও নেই। সেমিকন্ডাক্টর চিপ নির্মাণে তাইওয়ানকে ধরা চীনের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। ফলে, দ্রুত তাইওয়ানকে নিজের হাতের মুঠোয় আনতেই হবে। তাহলে তাইওয়ানের হাতে থাকা এই অকল্পনীয় বড় কৌশলগত পণ্যের একচ্ছত্র অধিকার চীনের হাতে চলে আসবে।
অন্যদিকে, নয়া কৌশল হিসেবে এশীয় চিপ জায়ান্টদের আমেরিকায় উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনে উৎসাহিত করছে ওয়াশিংটন। স্থানীয় শিল্পকেও এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিচ্ছে মার্কিন প্রশাসন। এরমধ্যেই মার্কিন জায়ান্ট ইন্টেল-এর সিইও প্যাট গেলসিঙ্গার কোম্পানির ফাউন্ড্রি ব্যবসাকে আধুনিকীকরণের বড় উদ্যোগ নিতে শুরু করেছেন। আমেরিকার উৎসাহে, অ্যারিজোনায় ১২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সর্বাধুনিক একটি কারখানা নির্মাণ করছে টিএসএমসি। গত সপ্তাহে এই শিল্পের জন্য ৫২ বিলিয়ন ডলারের একটি প্যাকেজ পাস করেছে মার্কিন কংগ্রেস। এর মূল্য উদ্দেশ্য আমেরিকার চিপ শিল্পে সক্ষমতা বৃদ্ধি। আমেরিকার বহুজাতিক প্রযুক্তি সংস্থাগুলি পুরোপুরি টিএসএমসির উপরই নির্ভরশীল। ফলে টিএসএমসি কার দখলে থাকবে—তা নিয়েই লড়াই তুঙ্গে।
তাইওয়ান সফরে এসে একাধিক কূটনৈতিক বৈঠকের পাশাপাশি ন্যান্সির বৈঠক হয়েছে মার্ক লুইয়ের সঙ্গেও। মার্ক লুই হলেন তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কর্পোরেশন (টিএসএমসি)-এর চেয়ারম্যান। এই কর্পোরেশনের হাতেই অর্ধেকেরও বেশি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বিশ্বের সেমিকন্ডাক্টর বা কম্পিউটার চিপ বাজারের। ৫জি প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তারের ফলে ‘ইন্টারনেট অব থিংস’ বা প্রতিটি বৈদ্যুতিন সামগ্রী পরস্পর সম্পর্কযুক্ত, এই ধারণার বাস্তবায়ন গতি পেয়েছে। এই মুহূর্তে তার সবচেয়ে বড় বাজার আমেরিকা। সেই কারণেই তাইওয়ান যদি চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় তা হলে সমস্যা বাড়বে আমেরিকার। একবার চিপযুদ্ধে পিছিয়ে পড়লে বিশ্ব অর্থনীতিতে পরাজয় নিশ্চিত।
মেলবোর্নের লা ট্রোব ইউনিভার্সিটির ফেলো টনি ওয়াকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে প্রশ্ন করেছিলেন, সুস্পষ্ট কারণে আপনি সামরিকভাবে ইউক্রেন সংঘাতে জড়াতে চাননি। কিন্তু তাইওয়ান আক্রান্ত হলে আপনি কি সামরিকভাবে জড়াতে ইচ্ছুক? জবাবে বাইডেন জানিয়েছেন, ইয়েস! বাইডেন বুঝিয়ে দিয়েছেন, আমেরিকার কাছে ইউক্রেনের থেকে তাইওয়ান অনেক বেশি জরুরি।