বিমাসূত্রে ধনাগম হতে পারে। প্রেম-প্রণয়ে আনন্দ। কাজকর্মে অগ্রগতি ও সুনাম। ... বিশদ
মেঘালয়ের রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক বলেছিলেন, তিনি জম্মু-কাশ্মীরের দায়িত্বভার নেওয়ার পরে দেশের একটি প্রথম সারির শিল্পগোষ্ঠী (যেটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ বলে বিরোধীদের অভিযোগ) এবং আরএসএস-ঘনিষ্ঠ এক নেতার দু’টি ফাইল পাশ করানোর জন্য তাঁর কাছে পেশ করা হয়। বলা হয়, ওই দু’টি ফাইল পাশ করালে তাঁকে ৩০০ কোটি টাকা ‘ঘুষ’ দেওয়া হবে। যদিও সত্যপাল দু’টি ফাইলই ফেরত পাঠান। সত্যপাল মালিক বরাবর ঠোঁটকাটা মানুষ। তাঁর কথায়, গোয়ার গভর্নর থাকাকালীন, বিজেপি সরকার কোভিড ত্রাণ তহবিলেও বড়সড় দুর্নীতি করেছিল এবং এ বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে অভিযোগপত্রও পাঠিয়েছিলেন। তারপর? সত্যপালের জবাব, ‘ওয়েল, কী আর, আমাকে সেখান থেকে সরিয়ে শিলংয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হল!’ এতেই স্পষ্ট, মোদি জমানায় রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি রয়েছে বহাল তবিয়তে। এসব শুনতে শুনতে একসময় মনে হতেই পারে, নীতি আবার কী? মঙ্গলবারে যেটা নীতি, বুধবারে সেটাই দুর্নীতি। পরের সোমবার ফের সুনীতি...।
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়ার পর তাঁর প্রথম স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে জাতির উদ্দেশে নরেন্দ্র মোদি বার্তা দিয়েছিলেন- ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’, অর্থাৎ, নিজেও ঘুষ খাব না, কাউকে ঘুষ খেতে দেবও না। পরের বছর স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতাতেই বলেছিলেন, পনেরো মাসে এক পয়সার দুর্নীতি নেই। অথচ, সেই সময়ই ব্যাপম কেলেঙ্কারিতে উত্তাল বিজেপি শাসিত রাজ্য। মধ্যপ্রদেশের ব্যবসায়িক পরীক্ষা মণ্ডল বা ব্যাপম কেলেঙ্কারির কথা প্রকাশ্যে আসার আগে ভারতের মানুষ বড় মাপের দুর্নীতি দেখেনি, এমনটা নয়। প্রতাপশালী রাজনীতিক, প্রভাবশালী আমলা আর মহাকোটিপতি ব্যবসায়ীদের দুষ্টচক্র আমাদের চেনা। তদন্ত চলাকালীন অভিযুক্ত বা সাক্ষী খুন? তা-ও বহু বার দেখেছে ভারত। কিন্তু ব্যাপম কেলেঙ্কারি বিভিন্ন সরকারি চাকরি এবং উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, বিশেষত মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা দুর্নীতির এক জটিল আবর্ত। বলতেই পারেন, এ আর নতুন কী! দেশটার নাম যখন ভারত!
এ দেশ ক্ষমতার যত রকম অপব্যবহার দেখেছে, সরকারি চাকরিতে বা ডাক্তারির মতো উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ঘুষ নিয়ে ভর্তির যত উদাহরণ দেখেছে, সবকিছু ছাপিয়ে গিয়েছিল ব্যাপম। ব্যাপম কেলেঙ্কারির তদন্তের রিপোর্ট বলছে, এখনও পর্যন্ত এই মামলায় অভিযুক্ত বা সন্দেহভাজন অন্তত ৪৩ জনের ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’ হয়েছে। কারও মতে, মৃতের প্রকৃত সংখ্যা সরকারি হিসেবের দ্বিগুণ। কারও মতে তিনগুণ, কারও মতে ছয়গুণের বেশি। অভিযোগ, মৃতের তালিকায় যাঁরা, তাঁরা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য অথবা নিচুতলার সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের দালালদের হাতে মোটা টাকা তুলে দিয়েছিলেন। মামলায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান, তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী উমা ভারতী, বিজেপির সর্বভারতীয় মুখপাত্র সুধাংশু মিত্তল, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের দুই অতি গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা সুরেশ সোনি ও প্রভাত ঝার নাম। এ ছাড়াও নাম জড়িয়েছে রাজ্যের বেশ কিছু মন্ত্রী ও সাংসদের। সুপ্রিম কোর্ট পেনের এক খোঁচায় ৬৩৪ জন ডাক্তারের ডিগ্রি বাতিল করে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ব্যাপম কাণ্ডের সেই রহস্যের পর্দা আজও খোলেনি। কেন খোলেনি? এতো বড় দুর্নীতি মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানের অগোচরে ছিল। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? ক’জন বিজেপি নেতাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে? আসলে, বিজেপির আদি বা নব্য, কোনও গোত্রের নেতার দুর্নীতিই সিবিআই বা ইডি খুঁজে পায় না। গেরুয়া শিবিরের তরফে অবধারিতভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা হয়, দেশে সব দুর্নীতি করে বিজেপি বিরোধীরা। বিজেপি ‘ধোয়া তুলসী পাতা’!
যতদিন বিজেপি বিরোধী, ততদিন কেন্দ্রীয় সংস্থার দপ্তরে নিয়মিত ডাক। দল পাল্টে গৈরিকবর্ণ ধারণের পর সেই নেতাই আইনরক্ষকদের চোখে অদৃশ্য হয়ে যান। সমস্ত অপরাধ সাফ হয়ে যায় বিজেপিতে যোগ দিলেই। এমন নজির রয়েছে ভূরিভূরি। কে না জানে, মোদির লৌহপুরুষ সত্তার নির্মাণ হয়েছিল তাঁর দুর্নীতি-বিরোধী যোদ্ধার পরিচিতির উপর নির্ভর করে। আর সেই মোদি জমানায় চলতি বছরে প্রকাশিত বিশ্ব দুর্নীতি সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ৮৫। কী বলবেন, সূচকে গরমিল রয়েছে? আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং-এর ২০১৩ সালের এক সমীক্ষা জানাচ্ছে, পরিকাঠামো, বিশেষ করে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায় ঘুষের রমরমা অত্যধিক। কেন না, এই ব্যবসায়
ঘুষের ফল পাওয়া যায় দ্রুত, এক হাত টাকা দেয়, অন্য হাতে চলে আসে নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখানোর ছাড়পত্র। অর্থনীতির ভাষায় ‘পলিটিকাল রেন্ট সিকিং’, অর্থাৎ নেতানেত্রীরা তাঁদের ক্ষমতা ‘ভাড়া’ দেন বেআইনি কাজ করতে আর কব্জি ডুবিয়ে বুঝে নেন টাকা বা অন্য কিছু।
সাংবাদিক রাজদীপ সরদেশাই লিখছেন, ‘বড় মাপের কোনও দুর্নীতির পর্দা ফাঁস হয় সাধারণত প্রভাবশালী কোনও নজরদার প্রতিষ্ঠান বা স্বাধীন মিডিয়া হাউসের তদন্তের ফলে। বিগত কয়েক বছরে যেভাবে প্রতিষ্ঠানগুলি অকেজো হয়ে গিয়েছে, মিডিয়া যেভাবে আপস করেছে, তাতে একটি সর্বশক্তিমান সরকারের পক্ষে তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ার উপর অস্বচ্ছতার পরত চাপিয়ে দেওয়া কোনও বিষয়ই নয় এখন আর। ‘রাইট টু ইনফরমেশন’-এর অল্প কিছু আবেদনেরই সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যায়। ‘সিএজি’ বা ‘কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল’-এর কোনও রিপোর্টই আর জনপরিসরে তর্কের বিষয় হয়ে নেই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যাবতীয় জেহাদ, লোকপাল ইত্যাদি কার্যত উবে গিয়েছে আলোচনার পরিসর থেকে। মাঝেমধ্যে যদিও বা মিডিয়ার তরফে কোনও দুর্নীতির ঘটনার একটি শক্তিশালী তদন্তের আভাস পাওয়া যায়, তা নিয়ে সচরাচর ঠিকঠাক প্রচার চোখে পড়ে না।’ এটাই মোদি সরকারের খেলা। গেরুয়া শিবির জানে, কীভাবে খবর ধামাচাপা দিতে হয়। কীভাবে একটা খবর মুছে ফেলতে আরও একটা খবর তৈরি করতে হয়।
নরেন্দ্র মোদির বক্তৃতায় প্রায়ই নিজের চৌকিদারিত্বের মহিমা বর্ণনা করতে করতে বলেন, আগে যে দুর্নীতিগ্রস্তরা দাপিয়ে বেড়াত, তাঁর জমানায় তাঁদের কেউ আদালতের চক্কর কাটছেন, কেউ জামিনে মুক্ত। কিন্তু, কর্ণাটকের বি এস ইয়েদুরাপ্পা? জমি এবং খনি, দুইটি বড় কেলেঙ্কারিতে জড়িত ইয়েদুরাপ্পা চতুর্থ বার কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তাঁর বাড়ি থেকে বিপজ্জনক নথি উদ্ধার হয়েছিল। অথচ, মোদি সরকার ক্ষমতায় আসা ইস্তক সিবিআই সে বিষয়ে নীরব। যেমন, শিবরাজ সিং চৌহান। ব্যাপম কেলেঙ্কারির ঘটনায় সিবিআই তাঁরও দোষ খুঁজে পায়নি। যেমন, হেমন্ত বিশ্বশর্মা। গুয়াহাটিতে জল সরবরাহ কেলেঙ্কারির মূল অভিযুক্ত ছিলেন হেমন্ত। অভিযোগ তুলেছিল বিজেপি। এমনকী এই অভিযোগের বিস্তারিত তুলে ধরে বুকলেটও ছাপায়। অভিযোগ করা হয়, প্রকল্পটির কাজ পেতে আমেরিকান একটি ব্যবস্থাপক কোম্পানির থেকে তিনি ঘুষ নিয়েছেন। এমনকী মার্কিন বিচার বিভাগের বৈদেশিক দুর্নীতি নিরোধ আইন- ফরেন করাপ্ট প্র্যাক্টিসেস অ্যাক্টের আওতায় অসমের অজ্ঞাত একজন মন্ত্রীকে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে। এতকিছুর পরও যেই মাত্র হেমন্ত বিজেপিতে যোগ দিলেন, তখনই মামলাটির ভার সিবিআইকে দেওয়ার দাবি থেকে সরে আসে বিজেপি। বর্তমানে সেই হেমন্ত বিশ্বশর্মাই অসমে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী। যেমন, মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নারায়ণ রানে। তাঁর বিরুদ্ধে অর্থপাচার ও জমি কেলেঙ্কারির মামলার এখন কী হাল, তা কেউই জানে না। তবে, বিজেপিতে যোগ দেওয়া মাত্র তাঁকে রাজ্যসভায় দলের এমপি বানানো হয়। পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গ নাই তুললাম। তাহলে উদাহরণের তালিকাটি দীর্ঘতর হবে। এতেই স্পষ্ট, দুর্নীতিগ্রস্তদের জেলে ভরবার মোদির শপথটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিরোধীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কেউ প্রশ্ন করার নেই, দুর্নীতিতে বিজেপির ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি’ কি শুধুমাত্র বিরোধীদের ক্ষেত্রেই? মোদির দুর্নীতি-বিরোধী স্লোগানকে এখন আরও বেশি করে রাজনৈতিক ভাষ্য ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না।
এ এমন একটি দেশ, অর্থনীতিবিদ অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যমের মতে যেখানে ‘কালিমালিপ্ত পুঁজি’-র কোনও অভাব নেই। এ দেশ মানে, ‘তুমি তো প্রহর গোনো, তারা মুদ্রা গোনে কোটি কোটি।’ ফলে রাজ্যের সদ্য অপসারিত মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দুর্নীতি নিয়ে অবাক হওয়ার কী আছে!