সামাজিক কর্মে সম্মান লাভ। স্ত্রী’র শরীর-স্বাস্থ্য খারাপ হতে পারে। দেরীতে অর্থপ্রাপ্তি। ... বিশদ
শুধু গ্রেপ্তারি নয়, বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলিকে মামলা-মোকদ্দমা, এজেন্সির ভয় আর আইটি, ইডির নোটিসে তটস্থ করে রেখেছে অমিত শাহ অ্যান্ড কোম্পানি। উদ্ধবকে আরও একা করে দিতে আয়কর দপ্তরের ‘প্রেমপত্র’ পৌঁছে গিয়েছে প্রবীণ মারাঠা নেতা শারদ পাওয়ারের ঠিকানাতেও। ওই একটু কড়কে দেওয়া আর কী! একুশের নির্বাচনের আগে নিত্যদিনের এই যন্ত্রণা সহ্য করেও প্রবল বিক্রমে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন বাংলার ‘স্ট্রিট ফাইটার’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সেই দম আর হিম্মত সারা দেশে আর কার আছে? মহারাষ্ট্র পারেনি। মধ্যপ্রদেশের কংগ্রেস সরকার পারেনি। বেহাত হয়েছে কর্ণাটক, অরুণাচল, গোয়া। বিধায়ক কেনাবেচার পঙ্কিল আবর্তে হাতবদল হয়ে গিয়েছে সরকার। একে একে সরকার ভাঙার সংখ্যাটা মোদির আট বছরের শাসনকালে কিন্তু প্রায় আট ছুঁই ছুঁই। মহারাষ্ট্রে হিন্দুত্ব বনাম হিন্দুত্বের লড়াইয়ে বাল থ্যাকারের নামটাকেই মুছে দিতে মরিয়া মোদি বাহিনী। পুতুল মুখ্যমন্ত্রীকে বসানোর মহানাটকটাও সেই কারণেই। শুধু শাসন ক্ষমতা কেড়ে নিয়েই থামতে রাজি নন, এবার উদ্ধব পরিবারের হাত থেকে শিবসেনার নিয়ন্ত্রণটাকেই কেড়ে নেওয়ার খেলা চলছে। দেশের বাণিজ্য রাজধানীতে অর্থনীতি বাঁচানোর পরিবর্তে হিন্দুত্ব বনাম হিন্দুত্বের লড়াই। গত এক পক্ষকাল মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে যে ঢেউ সঞ্চারিত হয়েছে, তা মূলত হিন্দুর হৃদয় সম্রাট বাল থ্যাকারের ‘লিগ্যাসি’কে খতম করার লক্ষ্যকে সামনে রেখেই। আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মুম্বই পুরসভার নির্বাচন তাই বিজেপির কাছে অ্যাসিড টেস্ট।
আসলে চব্বিশ সালের সাধারণ নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে, কোনও তাস খেলতেই আর দেরি করছেন না নরেন্দ্র মোদি। নেহরুকে ইতিহাস থেকে মুছে দিতে তাঁর টানা তৃতীয়বার দেশ শাসনের রেকর্ডও ছুঁতে হবে যে! গেরুয়া আগ্রাসনের সেই নেশায় ইন্ধন জোগাচ্ছে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও টুকরো টুকরো বিরোধী দলগুলির অনৈক্য। কংগ্রেসকে আরও দুর্বল করে টুকরো টুকরো আঞ্চলিক শক্তি মাথা তুললে পোয়াবারো গেরুয়া শাসকেরই। কারণ, এরা শুধু নিজের সীমিত গণ্ডিটাকেই বোঝে। ফলে সামগ্রিক দেশ শাসন এদের কাছে অলীক কল্পনা হয়ে থেকে যাবে। সেই কারণে শুধু মেরুকরণের আড়ালে সাম্প্রদায়িক প্রচার নয়, হিন্দুত্বের কোনও শাখা কিংবা দলিত আদিবাসী ভোট-ব্যাঙ্ককে পর্যন্ত দখল না করে থামতে রাজি নন গেরুয়া শিবিরের নেতানেত্রীরা।
সেই কৌশল মেনেই ‘বিদ্রোহী’ শিবসেনার বকলমে মহারাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিজেপির ‘সরকার’। কৌশল করে বাল থ্যাকারে ও তাঁর বংশধরদের হাত থেকে শিবসেনার রাশ ছিনিয়ে তুলে দেওয়া হয়েছে রাজনীতিতে তেমন গুরুত্ব না থাকা একদা থানের অটোচালক একনাথ সিন্ধের হাতে। নরেন্দ্র মোদি জানেন এভাবে চললে শিবসেনাও আস্তে আস্তে বিজেপির গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। তখন মহারাষ্ট্রে হিন্দু ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসানোর আর কেউ থাকবে না। সেই কৌশলে বিজেপির বর্তমান নেতৃত্ব ও সঙ্ঘ পরিবার ষোলোআনা সফল। হিন্দুত্ব বনাম হিন্দুত্বের এই লড়াইয়ে শেষ কথা বলবে মোদির গেরুয়া দলই।
আসলে আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে যেখানে যা কৌশলগত খামতি আছে তা ঢেকে দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর অনুগত সেবকরা। সেই লক্ষ্যেই নরেন্দ্র মোদি অত্যন্ত কৌশলে এখন থেকেই অগ্রসর হচ্ছেন। উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার ভোটে মুলায়ম পুত্র অখিলেশকে তিনি শুধু পর্যুদস্তই করেননি, একই সঙ্গে সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে গোটা দেশকে চমকে দিয়ে রামপুর ও আজমগড়ের মতো দু’টি মুসলিম অধ্যুষিত লোকসভা আসন জয় করে নিয়েছেন। সেইদিক দিয়ে বিজেপির এই সাফল্য সমীহ জাগানোর মতোই। রামপুরে ৫০ শতাংশ মুসলিম ভোটার। আর আজমগড়ে প্রায় ৪০ শতাংশ। তাহলে কি সংখ্যালঘু ভোটও কোনও অজানা কারণে বিজেপির বাক্সে ঝুঁকছে? রহস্যটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। এ তো গেল উত্তরপ্রদেশের কথা। আমরা সবাই জানি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোকসভা আসন আছে উত্তরপ্রদেশে। সংখ্যাটা আশি। আর দ্বিতীয় স্থানে মহারাষ্ট্র, আসন সংখ্যা ৪৮। এই দু’টি রাজ্যের সিংহভাগ ভোট ও আসন যে দলের বাক্সে যাবে কেন্দ্রে আগামী সরকার গড়া তার ভাগ্যেই লেখা আছে। এই আপ্তবাক্য মেনেই মোদি-অমিত শাহ জুটি এগচ্ছেন। এরই মধ্যে আবার পূর্ব ও উত্তরপূর্ব ভারতের আদিবাসী ভোটব্যাঙ্কের কথা মাথায় রেখে মাস্টারস্ট্রোক দিয়েছেন মোদিজি। দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী করে ওড়িশা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড় ও মধ্যপ্রদেশের আদিবাসী ভোটব্যাঙ্ককে অত্যন্ত স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে। তার জেরে ভোটের দু’সপ্তাহ আগেই ময়ূরভঞ্জের সাঁওতাল মহিলার বিপুল ভোটে জিতে রাষ্ট্রপতি হওয়া একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। আদিবাসী ভোটব্যাঙ্কের রাশ গেরুয়া দখলে গেলে নরেন্দ্র মোদির তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়াও অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যাবে।
জোট গড়ব গড়ব করেও ঘর গুছিয়ে উঠতে পারেনি বিরোধীরা। বিরোধীদের এই অনৈক্য এবং মত-পথ ও স্বার্থের পার্থক্য আগামী দিনে বাড়বে বই কমবে না। কংগ্রেস রাজ্যে রাজ্যে ছন্নছাড়া। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও সমস্ত বিরোধী দল কতটা তাঁর নেতৃত্বকে মেনে নিতে প্রস্তুত, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কয়েকটা রাজ্যে জিতে আপ সর্বাধিনায়ক অরবিন্দ কেজরিওয়ালও সহজে দান ছাড়তে রাজি নন। এই অবস্থায় নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহের কাছে আগামী দিনের লড়াইটা অনেকটাই সহজ। উপরন্তু এই সেদিনও যে শিবসেনা কংগ্রেস ও এনসিপির সঙ্গে মিলে বিরোধী শিবিরের শক্তি বৃদ্ধি করছিল, তারাও এখন বিজেপির আঁচলে বাঁধা হয়ে গেল। স্বভাবত প্রশ্ন উঠেছে, মহারাষ্ট্রের পর বিজেপির লক্ষ্য কী রাজস্থান ও বিহার দখল? মহারাষ্ট্রের মতো আগেও রাজস্থানে ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করেছিল বিজেপি। কিন্তু কংগ্রেস ভাঙার খেলায় সাফল্য আসেনি। চেষ্টা কিন্তু চলছেই। রাজনীতিতে অসম্ভব বলে কিছুই হয় না। বিদ্রোহের আগের সপ্তাহেও উদ্ধব পুত্রের সঙ্গে একনাথ সিন্ধে অযোধ্যা গিয়েছিলেন। তাই শচীন পাইলট আগামী দিনে কী করবেন এখনই বলা সম্ভব নয়। নীতীশ বেসুরো হওয়ায় বিহারের পরিস্থিতিও জটিল। তাই বিহার দখলের গোপন ছকও তৈরি গেরুয়া পার্টির। কুর্সি ও মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার খোয়াব দেখে না, এমন নেতা ভূভারতে কোথায়। অপেক্ষা শুধু সঠিক সময়ের। রাজস্থান গেরুয়া নিয়ন্ত্রণে গেলে বিরোধীদের মেরুদণ্ড খতমের লক্ষ্যে সঙ্ঘ পরিবারের পরিকল্পনা অনেকটাই সফল হবে। বিরোধী ঐক্যের তাগিদ এখনও যদি না দেখা যায়, তাহলে পরিস্থিতি ইন্দিরা গান্ধীর মিসা জমানার চেয়েও ভয়ঙ্কর হবে। প্রতিবাদ করার কেউ থাকবে না। দেশে কার্যত একদলীয় শাসন কায়েম হবে। আর মোদি জমানার অতুলনীয় কীর্তি, নয়া সংসদ ভবনের অন্দরে শুধুই গণতন্ত্রের আর্তকান্না শোনা যাবে।