কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
এক আদিবাসী নারীকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বিজেপি তাঁকে প্রার্থী করে স্বাধীনতার পর এই প্রথম উপজাতি সম্প্রদায়ের কোনও প্রতিনিধিকে ভারতের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে বসানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। দ্রৌপদী মুর্মু জয়ী হলে এই প্রথম আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ পৌঁছবেন রাইসিনা হিলসের ৩৪০ ঘরের অট্টালিকায়। ঠিক যখনই রাষ্ট্রপতি পদের জন্য দ্রৌপদী মুর্মুর নাম ঘোষণা করা হল, তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ওড়িশা প্রশাসন জুড়ে এক যুদ্ধকালীন তৎপরতা দেখা গেল। একটিমাত্র গ্রামকে কেন্দ্র করে। সে হল ওই দ্রৌপদী মুর্মুর নিজের গ্রাম। এটা ওই গ্রামের কাছে আনন্দদায়ক। আর দেশের কাছে লজ্জাজনক হল। কারণ, যতদিন না পর্যন্ত গ্রামের মেয়ে রাষ্ট্রপতি পদের দিকে পা বাড়ালেন, ততদিন গ্রাম কেন রয়ে গেল বিদ্যুৎহীন?
ঠিক একদিন পর আরও মজার ঘটনা ঘটেছে জার্মানিতে। মিউনিখ শহরে প্রবাসী ভারতীয় এক সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভারত সরকারের কৃতিত্ব আর সাফল্যের কথা জানিয়ে উদাহরণ প্রদান করেন গৌরবের সঙ্গে। তিনি বলেছিলেন, ভারতের সব গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ হয়ে গিয়েছে। ভারতের সব গ্রামেই শৌচাগার আছে। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে (৫) সরকারি পরিসংখ্যান। সেখানে বলা হয়েছে এখনও প্রায় ৭ শতাংশ পরিবারের কাছে শৌচাগার নেই। প্রকাশ্য স্থানই ভরসা। আর যেখানে যেখানে সত্যিই সরকারি অর্থে শৌচাগার হয়েছে? তার মধ্যে আবার আকর্ষণীয় ঘটনা ঘটছে। কোথাও দেখা যাচ্ছে, শৌচালয় থাকলেও জলের ব্যবস্থা নেই। তাই সেগুলির ব্যবহারও নেই। মধ্যপ্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যেমন সরকারের করে দেওয়া শৌচাগার পরিণত হয়েছে স্টোররুমে। কারণ জল নেই। টয়লেট দিয়ে কী হবে? ওড়িশার কান্দামাল জেলার দাশিগুড়া গ্রামের প্রবেশপথেই সিমেন্ট ব্লকের উপর লেখা রয়েছে, প্রকাশ্যে শৌচকার্যহীন এই গ্রামে আপনাদের স্বাগত। অর্থাৎ এখানে প্রত্যেকেই ব্যবহার করে টয়লেট। সরকারি পরিভাষায় যাকে বলা হয় ওপেন ডেফিকেশন ফ্রি গ্রাম। এরকম অসংখ্য গ্রাম আছে ভারতে। খুবই গর্বের কথা। কিন্তু দাশিগুড়া গ্রামের আদিবাসী মানুষের সমস্যা হল, বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে শৌচালয়। আসলে একটা কাঠামো। সিমেন্ট রিং বসানো হয়নি। ট্যাঙ্ক বসানো হয়নি। জলের সাপ্লাই নেই। বাইরে থেকে ছবি তুলেই সরকারি দপ্তরে জমা দিয়ে টাকা নিয়ে পালিয়েছে কন্ট্রাক্টর। এরকম ঘটনা প্রচুর।
দ্রৌপদী মুর্মুর গ্রামের মতো হাজার হাজার গ্রাম এখনও অপেক্ষা করছে বিদ্যুতের জন্য, সেসব আমরা সকলেই জানি। কিন্তু বিদ্যুৎ আছে যেখানে? সেখানে কী অবস্থা? কয়েকদিন আগেই বিহারের মুঙ্গেরে আর ডি অ্যান্ড ডিজে কলেজে পরীক্ষা দিতে এসেছে জে আর এস কলেজের বিএ ফার্স্ট ইয়ার এবং সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রছাত্রীরা। বিদ্যুৎহীন সেই সেন্টার। দেখা গেল জেনারেটরও বিকল। রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি। তাহলে পরীক্ষা হল কীভাবে? প্রত্যেককে অ্যালাউ করা হল মোবাইল সঙ্গে রাখতে। পরীক্ষার্থীরা একহাতে মোবাইলের টর্চ জ্বেলে প্রশ্ন এবং উত্তরপত্রের উপর ফেলল। আর অন্য হাতে উত্তর লিখল। যাদের মোবাইলের চার্জ চলে গেল তারা কী করল? অন্যদের পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল। মুঙ্গের কি গ্রাম? মোটেই নয়। আস্ত এক বনেদী শহর।
অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনমের বহু প্রত্যন্ত গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির প্রধান টার্গেট একটি ঘোড়া কেনা। মাদুগুলা, থান্ডাস, সুরলপালেম, পাদেরু, আরাকু। রাস্তা নেই। স্বাধীনতার এত বছর পরও সড়ক সংযোগ না হওয়ায় এই জঙ্গল আর পাহাড়ি অঞ্চলগুলির একমাত্র পরিবহণ ঘোড়া। জল আনতে যেতে হবে ১২ কিলোমিটার দূরে। ঘোড়ায় চেপে। কলেজে যেতে হবে ঘোড়ায় চেপে। সরকারি দপ্তরে যেতে হয় ঘোড়ায় চেপে। এসব বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভোটিং মেশিন আর ভোটকর্মী আসে ঘোড়ায় চেপে। ওড়িশার ১২৪২টি গ্রাম আছে যেখানে কোনও রাস্তা সংযোগ নেই। মধ্যপ্রদেশের কুকশী, প্যাটেলপুরাল বিরালির মতো জনপদে একটা মাত্র সেতু করে দিলেই নিকটবর্তী ব্লক হেলথ সেন্টারে যেতে পারে গ্রামবাসীরা। রাস্তা অথবা সেতু না থাকায় অসুস্থ অথবা গর্ভবতীদের খাটে চাপিয়ে চারজন সেটা বহন করে কুকশী নদী পেরয়।
প্রধানমন্ত্রী মাঝেমধ্যেই ঘোষণা করেন ভারতের ব্যাঙ্কিং, উপজাতি উন্নয়ন, গরিবের জন্য খাদ্য, অর্থনীতি, সব বিষয়ে চরম উন্নতি হয়েছে গত আট বছরে। ৭০ বছরে অন্য সরকারগুলি কিছু করেনি
বলে তাঁর বিশ্বাস। কিন্তু স্বাধীনতার পর আজও ভারত যতই অন্তরীক্ষজয়ের স্বপ্নে মশগুল থাকুক, মানুষের ন্যূনতম চাহিদা বিজলি, পানি, সড়কের সমস্যাই কেন এখনও মেটানো যাচ্ছে না? সমস্যা একটাই। পরিকল্পনার অভাব। প্রধানমন্ত্রী তাঁর পূর্বসূরিদের এতটাই অপছন্দ করেন যে, ক্ষমতায় এসেই সর্বাগ্রে যোজনা কমিশনের নাম বদলে দিয়েছেন। যোজনার অন্য নাম হল পরিকল্পনা। সেটা শুনতে ছোট শব্দ হলেও বোঝা এবং কার্যকর করা অনেক কঠিন। সভা সমাবেশে উচ্চকিত সংলাপ, জয়ধ্বনি এবং প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে মানুষের মন জয়ের অভ্যাস হয়ে গেলে পরিকল্পনা শব্দটির অর্থ বোঝা যাবে না।
১৯৩৮ সালে কংগ্রেসের নতুন সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসু একটি কমিটি গঠন করেন। ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি। স্বাধীন ভারতের উন্নয়নের আগাম রূপরেখা। সেই সময় লন্ডনে থাকা জওহরলাল নেহরুকে টেলিগ্রাম করে সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন, আপনাকে এই কমিটির চেয়ারম্যান হতে হবে। এই কমিটির উদ্দেশ্য সফল হবে একমাত্র তখনই, যখন আপনি এই
দায়িত্ব নেবেন। নেহরু নিয়েছিলেন দায়িত্ব। ১৫ জন সদস্যের সেই কমিটির প্রধান অর্থনীতিবিদ ছিলেন কে টি শাহ। ক্ষুদ্র শিল্প, বৃহৎ শিল্প, লগ্নি ইত্যাদির
পাশাপাশি ভারত নির্মাণের প্রধান শর্ত হিসেবে সেই কমিটির বৈঠকে বলা হয়েছিল, সর্বাগ্রে গ্রামে গ্রামে জল, সড়ক এবং বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে হবে। এরপর অনেক বছর কেটে গিয়েছিল। সুভাষচন্দ্রের সেই স্বপ্নটির বীজ কিন্তু রয়ে যায়। তাই স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জওহরলাল নেহরু আর এক বাঙালি প্রশান্তচন্দ্র মহলনাবিশকে দায়িত্ব দিয়ে শুরু করলেন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। যা নিছক উন্নয়নের ভিত্তি নয়, গণতন্ত্রের চালিকাশক্তি হবে। তারই ফসল ছিল পরিকল্পনা কমিশন।
শুধুই প্রতিপক্ষের ঘর ভাঙিয়ে রাজ্যে রাজ্যে সরকার দখল, বিদ্বেষ বিভাজনের রাজনীতি, সরকার অথবা দলের সমালোচনা করা হলেই জেলে দেওয়া আর অবাস্তব মনভোলানো প্রচার করলে হবে? পুরনো ইতিহাস থেকে একটু আধটু শিক্ষা নিয়ে ভারতনির্মাণের কাজও তো করতে হবে। শুধুই ফাইভ জি স্পেকট্র্যাম আর বুলেট ট্রেন তো আধুনিক ভারত নয়! সকলের জন্য রোজগার, রাস্তা, পানীয় জল, বিদ্যুৎ এসব কবে হবে? বেলা যে বয়ে যায়!