পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
রঘুরাম রাজন, অরবিন্দ পানাগাড়িয়া থেকে অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যম। বিশ্বের প্রথম সারির অর্থনীতিবিদরা একে একে বিদায় নিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি সরকারের রাজত্ব থেকে। মেয়াদ ফুরনোর অনেক আগেই। দেশের অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভালো করার রাস্তা খুঁজতে লম্বা সময় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিকে মন্ত্রণা জুগিয়েছেন তিনি। রঘুরামের মতো গো-রাজনীতি বা অসহিষ্ণুতা নিয়ে মুখ খোলেননি সুব্রহ্মণ্যম। বলেছিলেন, মুখ খুললে চাকরি যেতে পারে। তবে নোটবন্দির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে গিয়েছিলেন বিদায় নেওয়ার আগেই।
পরে মোদি সরকারের নোটবন্দির নাটকীয় সিদ্ধান্তকে নির্মম বলেই দাগিয়ে দিয়েছেন অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যম। বছর খানেক আগে প্রকাশিত বই ‘অব কাউন্সেল: দ্য চ্যালেঞ্জেস অব মোদি-জেটলি ইকনমি’-তে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে সেই নির্মমতার কথা। ক্ষমতার অলিন্দে গুঞ্জন ছিল, অর্থমন্ত্রী ও উপদেষ্টা সুব্রহ্মণ্যমকে অন্ধকারে রেখেই নাকি ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। সেই জল্পনা উস্কে দিয়ে ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর রাতে নর্থ ব্লকে নিজের ঘরে বসে টিভির পর্দায় মোদির সেই নাটকীয় বক্তৃতা শোনার স্মৃতি লিখেছেন সুব্রহ্মণ্যম। যে নোটবন্দি নিয়ে এত আক্রমণ, মানুষ তা সহজে মেনে নিলেন কী করে? নোটবন্দির পরেই উত্তরপ্রদেশে কীভাবেই বা বিপুল ভোটে জিতে মসনদ দখল করেছিল বিজেপি? সম্ভাব্য কারণ হিসেবে সুব্রহ্মণ্যম লিখেছেন, সম্ভবত বড়লোকরা বিপদে পড়বে, এই আশায় যাবতীয় কষ্ট মেনে নিয়েছিলেন দেশের গরিবরা।
সময়টা ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর। সন্ধ্যার সময়ে জানা গিয়েছিল, পাঁচশো ও হাজার টাকার নোট বাতিল হচ্ছে। কেন? কালো টাকা উদ্ধার এবং সেই সূত্রে জাল টাকা, সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করা। পাশাপাশি, ডিজিটাল, নগদহীন অর্থনীতির দিকে হাঁটা। ‘৫৬ ইঞ্চি’র বলিষ্ঠ, দুঃসাহসিক পদক্ষেপে অনেকে ধন্য ধন্য করে উঠেছিলেন। কিছু নাগরিক সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, বিরুদ্ধ যুক্তি দিয়েছিলেন। তাঁদের ঠারেঠোরে ‘দেশদ্রোহী’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। নোটবন্দির খেলায় দেশপ্রমিক-দেশদ্রোহী আড়াআড়ি বিভাজন স্পষ্ট হয়েছিল।
পরের দিন সকাল থেকে ব্যাঙ্ক ও এটিএম-এর সামনে লম্বা লাইন। ব্যাঙ্ক কর্মীদের দুর্বিষহ দিনযাপন। ঘন ঘন নির্দেশিকা বদল। সাধারণ নাগরিকদের চূড়ান্ত হয়রানি। সঙ্গে কিছু মৃত্যু। ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলি, যাদের দৈনন্দিন ব্যবসা নগদ-নির্ভর তারা রুগ্ন হতে শুরু করল। অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়লেন। বিশেষ করে অর্থনীতির অসংগঠিত ক্ষেত্রে ভয়াবহ কাঁপন ধরল। ঝাঁকানিটি যে মোক্ষম হয়েছিল, তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন এ দেশের মানুষ। গেরুয়া শিবির মনে করে, এই ঝাঁকানি দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। কেন? কালো টাকার বিরুদ্ধে জেহাদ, কাশ্মীরে উগ্রপন্থীদের ভাতে মারবার পরিকল্পনা, নকল টাকা রোখার প্রতিজ্ঞা...।
তারপরে প্রায় সাড়ে ছ’বছর ঘুরে গেল। কালো টাকা ফিরল কই? ২০১৯-এর এপ্রিলে জানা গেল, ফিনান্সিয়াল ইন্টালিজেন্স ইউনিটের (এফআইইউ) সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, শুধু নোটবন্দির পরের অর্থবর্ষেই (২০১৭-১৮) দেশে সন্দেহজনক লেনদেনের খবর এসেছে প্রায় ১৪ লক্ষ। আগের তুলনায় ১,৪০০ শতাংশ বেশি। এর আগে ২০১৩-১৪ সালে ৬১,৯৫৩টি, ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষে ৫৮,৬৪৬টি এবং ২০১৫-১৬ সালে ১,০৫,৯৭৩টি সন্দেহজনক লেনদেন ধরা পড়েছিল। সেই বছরই ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো বা এনসিআরবি-র প্রকাশিত তথ্য জানিয়েছিল, ২০১৭ সালে প্রায় ২৮ কোটি টাকার জালনোট বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। যা তার আগের বছরের প্রায় দ্বিগুণ। ২০১৬-য় দেশে প্রায় ১৫.৯ কোটি টাকার জালনোট বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। এনসিআরবি-র তথ্য অনুযায়ী নোট বাতিলের পরে জালনোট কমেনি, বরং বেড়েছে। ২০১৯ সালে এনসিআরবি-র রিপোর্ট জানিয়েছিল, নোট বাতিলের পরে যে-দু’হাজার টাকার নোট বাজারে ছাড়া হয়েছিল, ২০১৭ সালে প্রায় ৭৫ হাজারটি সেই নোট জাল হয়েছে। ২০১৭ সালে সব চেয়ে বেশি জালনোট (৮০,৫১৯টি, টাকার অঙ্কে ন’কোটি) বাজেয়াপ্ত হয়েছে গুজরাত থেকেই। দ্বিতীয়স্থানে ছিল দিল্লি (বাজেয়াপ্ত ছ’কোটি ৭৮ লক্ষ টাকার জালনোট)।
‘সুইস ব্যাঙ্ক থেকে কালো টাকা ফিরিয়ে আনব। প্রত্যেক দেশবাসীর অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা জমা করব।’ ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। আট বছরেও সেই টাকা আসেনি। সুইস ব্যাঙ্কের দেওয়া পরিসংখ্যান বলছে, মোদি দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সুইজারল্যান্ডের ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের আমানতের পরিমাণ হু হু করে বেড়েছে। এমনকী, কোভিডকালে সেই টাকার অঙ্ক বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকায়, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সুইস ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক (এসএনবি)-র তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের শেষদিকে সুইস ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের তহবিলের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালের শেষে তা ২০ হাজার ৭০৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ, মাত্র এক বছরে কালো টাকার অঙ্ক বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা জমা হয়েছে বন্ড, সিকিউরিটিস এবং অন্যান্য আর্থিক প্রক্রিয়ায়। ৪ হাজার কোটির বেশি গ্রাহকরা নিজে জমা করেছেন। ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশি এসেছে অন্য ব্যাঙ্ক থেকে এবং সাড়ে ১৬ কোটি টাকা বিভিন্ন ট্রাস্ট মারফত।
সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে নতুন চুক্তি অনুযায়ী, সুইস ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের তহবিলের হিসেব এক বছর পর হাতে পায় ভারত। সেই সূত্রেই এই হিসেব এসেছে। ২০০৭ সালে ৯ হাজার কোটির বেশি অর্থ সুইস ব্যাঙ্কে জমা ছিল। এতদিন সেই হিসেব ছিল সর্বোচ্চ। ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার আগে বিজেপির দাবি ছিল, সুইস ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের সাড়ে ১৭ লক্ষ কোটি কালো টাকা লুকনো রয়েছে। সেই টাকা তাঁরা উদ্ধার করবেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মোদি। ‘কালো টাকা’ উদ্ধারের গাজর ঝুলিয়ে দেশবাসীকে আজও বোকা বানিয়ে চলেছেন। আর উল্টো দিকে, কোটি কোটি টাকা ঋণখেলাপ করে ‘ঘনিষ্ঠ’ শিল্পপতিরা একে একে বিদেশ চলে যাচ্ছেন। কাশ্মীর উপত্যকায় একের পর এক সন্ত্রাসবাদী ঘটনা প্রমাণ করে দিয়েছে, নোটবন্দি করে সন্ত্রাস নির্মূল করা যায়নি। আর পড়ে থাকে ডিজিটাল ও নগদহীন অর্থনীতির গল্প। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সূত্র থেকে জানা গিয়েছে, অর্থনীতিতে নগদ লেনদেনের মাত্রা আগের তুলনায় কমেনি, উল্টে আরও বেড়েছে।
তথ্য বলছে, ২০১৮, ২০১৯— পর পর দু’বছর সুইস ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ কমছিল। কিন্তু ২০২০-তে তা এক লাফে আগের বছরের তুলনায় ২৮৬ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। অথচ, অর্থ মন্ত্রকের যুক্তি, গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ বাড়লেও কালো টাকা জমার পরিমাণ বাড়ার কোনও যুক্তি নেই। কারণ ভারত-সুইজারল্যান্ডের মধ্যে কর ফাঁকি সংক্রান্ত বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার চুক্তি হয়েছে। প্রতি বছর আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য আদানপ্রদানেরও চুক্তি হয়েছে। ২০১৯ ও ২০২০, দুই বছরই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত তথ্য আদানপ্রদান হয়েছে। এই আইনি চুক্তি কর ফাঁকির কালো টাকা সুইস ব্যাঙ্কে জমা রাখার সম্ভাবনা অনেকখানিই কমিয়ে দেয়। বিরোধীরা পাল্টা তিনটি প্রশ্ন তুলেছেন। এক, গত এক বছরে যে সব ব্যক্তি সুইস ব্যাঙ্কে টাকা জমা করেছেন, তাঁরা কারা? যেখানে ৯৭ শতাংশ ভারতীয় আরও গরিব হয়েছেন সেই সময় কারা সুইস ব্যাঙ্কে টাকা ঢুকিয়েছেন? দুই, গত সাত বছরে কোন দেশ থেকে কত কালো টাকা কেন্দ্রীয় সরকার ফেরত এনেছে? তিন, বিদেশি অ্যাকাউন্ট থেকে কালো টাকা সরানো রুখতে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে মোদি সরকার। এখনও এর কোনও উত্তর মেলেনি।
প্রণব মুখোপাধ্যায় ‘দ্য প্রেসিডেন্সিয়াল ইয়ার্স: ২০১২-২০১৭’ বইয়ে লিখেছিলেন, তাঁকেও নোটবাতিলের বিষয়ে আগে জানানো হয়নি। আগাম পরামর্শ করেননি মোদি। তাঁর স্মৃতিচারণ, ‘প্রধানমন্ত্রী (নোটবন্দি ঘোষণার) বক্তৃতা দেওয়ার পরে রাষ্ট্রপতি ভবনে এসে আমার সঙ্গে দেখা করেন। ব্যাখ্যা করেন তাঁর যুক্তি। জানান, কালো টাকা উদ্ধার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই এবং সন্ত্রাসবাদীদের হাতে টাকা সরবরাহ বন্ধ করতেই এই পদক্ষেপ। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী হিসেবে এতে আমার সমর্থন চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ...বিরোধিতা হবে এমন ভয় না-রেখেই একটা কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, নোটবন্দির নানা উদ্দেশ্য একেবারেই সিদ্ধ হয়নি।’ যাকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছিলেন, ‘পরিকল্পিত লুট’।
আজ স্পষ্ট, নোটবাতিল নামক তাণ্ডবটি সম্পূর্ণ অনর্থক ছিল। নোটবাতিলের পিছনে অর্থনীতির যুক্তি ছিল না, ছিল শুধু একজন রাজনীতিকের বিসদৃশ আত্মম্ভরিতা, তা স্বীকার করা মোদির পক্ষে অসম্ভব। বিরোধীদের অভিযোগ, আসলে কালো টাকার পাহাড় বানাচ্ছেন মোদির বন্ধুরাই!