সামাজিক কর্মে সম্মান লাভ। স্ত্রী’র শরীর-স্বাস্থ্য খারাপ হতে পারে। দেরীতে অর্থপ্রাপ্তি। ... বিশদ
আজকাল আমাদের কাছে এ বড্ড চেনা শব্দ। আজাদির অমৃত মহোৎসব, আত্মনির্ভরতা... রাজনৈতিক মানে বোঝা দায় হলেও আগাপাশতলা ভীষণ আকর্ষণীয়। কঠিন শব্দের প্রতি এমনিতেই আমাদের প্রবল টান। রাজেশ খান্না শিখিয়ে গিয়েছেন, নাম লম্বা চওড়া না হলে সে রোগ কিছুতেই জাতে ওঠে না। ঠিক তেমনই উচ্চারণে আম জনতা হোঁচট না খেলে তাতে উন্নয়নের ভার আসে না। তাই প্যাকেজটা জবরদস্ত হতে হবে। সেটাই হচ্ছে। এখন আমরা ভীষণ ব্যস্ত। গত আট বছরের নরেন্দ্র মোদি সরকার দেশের কী কী উপকার করেছে, তার ফিরিস্তি দেওয়া সবে শেষ হয়েছে। রেশ অবশ্য আছে এখনও। মোদ্দা বিষয়টা এমন—মোদিজি ক্ষমতায় আসার আগে ভারতের মানুষের জন্য কোনও সরকারই কিছু করেনি। যা করেছেন মোদিজি। তিনিই মানুষের কাছে ব্যাঙ্কের পরিষেবা পৌঁছে দিয়েছেন, ঘরে ঘরে জল-আলোর ব্যবস্থা করেছেন, সরকারি পরিষেবা যা শুধুই উচ্চবিত্তদের জন্য কুক্ষিগত ছিল, তা সাধারণের স্তরে টেনে নামিয়েছেন। সবটা হজম হয় না ঠিকই, তাও না মানুষ কতকটা মেনে নিয়েছে। নিতে বাধ্য হচ্ছে। আরও অন্তত দু’টো বছর মানতে হবে। তা হোক। বিজেপির প্রচার মতো নরেন্দ্র মোদিই যদি স্বাধীন ভারতের সবথেকে দক্ষ প্রধানমন্ত্রী হতেন, তাহলেও আপত্তি ছিল না। কিন্তু আমাদের দেশের পূর্ববর্তী রাষ্ট্রনেতা বা নেত্রীদের কর্মকাণ্ডই তো এই প্রচারকে বাস্তব রূপ দিতে পারছে না! কারণ, একটা ছোট্ট প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি মারছে—উন্নয়ন যা করেছেন মোদিজি, তার মধ্যে একটিও কি যুগান্তকারী পদক্ষেপ রয়েছে? মানে এমন কোনও প্রকল্প, এমন কোনও উন্নয়নমূলক কাজ... যাতে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী উপকৃত হয়েছে? বলতে পারেন, বানিহাল-কাজিগুন্দ অল ওয়েদার সুড়ঙ্গের কথা। নিশ্চিত ভালো কাজ, কিন্তু এতে পাটনার কোনও এক দিনমজুরের কী উপকার হয়েছে বলতে পারেন? আপনারা হয়তো বলবেন রাজস্থানের ৯২৫ নম্বর জাতীয় সড়কের কথাও। হারকিউলিস বিমান নামছে সেখানে, সুখোই যুদ্ধবিমান জরুরি অবতরণ করছে... এটাও কি কম কিছু? নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু এতে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ভারতের কিছু সুযোগ সুবিধা হবে মাত্র। অর্থাৎ, দুর্বল এবং স্বাধীনতার পর থেকে লাগাতার খাবি খাওয়া পাকিস্তান নামক একটি দেশ যদি কখনও প্রবল আক্রমণ করে, তাহলে ভারত বারমের এই জাতীয় সড়কে যুদ্ধবিমান নামিয়ে পাল্টা কিছু করতে পারে। তাতেও কিন্তু নাসিকের পেঁয়াজ চাষি কিংবা লকডাউনে কলকাতায় চাকরি হারানো নিম্ন মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের উপকার হবে না। বক্তব্যটা পরিষ্কার, উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু যুগান্তকারী বলা যাচ্ছে কি? নাঃ, বলাটা কঠিন। কংগ্রেসের প্রতি মোদিজির জাতক্রোধ। দেশ-বিদেশের মাটিতে যে কোনও প্রসঙ্গে তিনি কংগ্রেসকে টেনে আনেন এবং তুলোধোনা করেন। এই তো মিউনিখে পৌঁছেও ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা নিয়ে বলতে শুরু করলেন তিনি। দেখালেন, দেশের গণতন্ত্র কীভাবে কংগ্রেস ধুলোয় মিশিয়েছে। ঠিক কথা। জরুরি অবস্থা কখনওই গণতন্ত্রের জন্য ভালো বিজ্ঞাপন নয়। সেক্ষেত্রে ইন্দিরা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু বা ভারতের আধুনিক অর্থনীতির রূপকার নরসিমা রাও ও মনমোহন সিংকে পিছনের সারিতে ঠেলে দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু অটলবিহারী বাজপেয়ি?
তিনিও কি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মেদির মাপকাঠিতে দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত? না হয় মাত্র একটি প্রকল্পের কথা বলা যাক—সোনালি চতুর্ভুজ। বাজপেয়িজির দূরদর্শিতায় সড়কপথে জুড়েছে
তামাম ভারত। দেশের পরিকাঠামোগত উন্নয়নে যুগান্তকারী এক পদক্ষেপ। ঠিক যেমন হাসিনার পদ্মা সেতু। আরও একটি লক্ষ্য ছিল অটলবিহারী বাজপেয়ির—নদী সংযুক্তিকরণ।
দীর্ঘ ইতিহাস এই প্রকল্পের। ব্রিটিশ শাসনকালে আর্থার কটন প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন, ভারতের প্রধান নদীগুলিকে জুড়ে দেওয়া হোক। উদ্দেশ্যটা অবশ্যই ছিল ব্যবসায়িক। তিনি ভেবেছিলেন, এমন একটা প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে জলপথে জিনিসপত্র আমদানি এবং রপ্তানিতে দারুণ সুবিধা হবে। ধীরে ধীরে অবশ্য সেই প্রজেক্টে ধুলোর আস্তরণ জমা পড়েছে। ফাইল চাপা পড়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের উত্তাপে। ১৯৭০’এর দশকে ফের সেই প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলেন ডঃ কে এল রাও। ইঞ্জিনিয়ার এবং কংগ্রেস মন্ত্রিসভার সেচমন্ত্রী। তিনি বুঝেছিলেন, দেশের খরা এবং বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে এর থেকে ভালো উপায় আর নেই। মাত্র চার মাসের বর্ষণকাল ভারতে। ওই সময়ই নদীগুলি ফুলেফেঁপে ওঠে, ভাসিয়ে দেয় আশপাশের এলাকা। কিন্তু সর্বত্র নয়। বহু এলাকাই থেকে যায় খরা কবলিত। নদী সংযুক্তিকরণ সম্ভব হলে খরা এবং বন্যার কবল থেকে বেরিয়ে আসবে উত্তর থেকে দক্ষিণ ভারত। মাটির নীচের জলস্তর স্বাভাবিক থাকবে। সেচে বা চাষবাসে সমস্যা থাকবে না। দেশের অর্থনীতি একটা মারাত্মক মোড় নেবে। ’৮২ সালে আবার থমকে যায় প্রজেক্টটি। অটলবিহারী বাজপেয়ি ক্ষমতায় আসার পর সেটির গুরুত্ব বোঝেন এবং নদী সংযুক্তিকরণে উদ্যোগী হন। যদিও তাঁর সেই স্বপ্ন সফল হয়নি। সেই সময় তিনি পাননি। পেলে সোনালি চতুর্ভুজের মতো আরও একটি যুগান্তকারী প্রকল্পের সুবিধা পেত ভারতবাসী। আর খুব বুঝেশুনেই এই প্রকল্পকে ইস্তাহারে রেখেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বদলে যাবে ভারতীয় কৃষি অর্থনীতির ভোল। কিন্তু আট বছর অতিক্রান্ত। কতটা এগিয়েছে সেই কাজ? মোদি সরকার নোট বাতিল করেছে, জিএসটি কার্যকর হয়েছে, সুদ কমিয়েছে স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পের, বছরে দু’কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও বেকারত্বের হার শিখরে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু নদী সংযুক্তিকরণ হয়নি। অন্তত ১২টি নদীকে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা কিন্তু কংগ্রেস সরকার নিয়েছিল। তার মধ্যে প্রথম
এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে কেন-বেতোয়া নদী এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে দামনগঙ্গা-পিঞ্জল ও পার-তাপি-নর্মদা সংযুক্তিকরণের প্রাথমিক কাজকর্মও সারা হয়ে গিয়েছিল। খরচ কত হতে পারে, হিসেব হয়েছিল তারও। পরিবেশবিদদের আন্দোলনে অবশ্য কংগ্রেস তা সফল করতে পারেনি। বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় একদিকে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ, আর অন্যদিকে শরিকি বাধাবিপত্তি—সাঁড়াশি চাপে থমকে গিয়েছিল প্রকল্প। কিন্তু মোদি সরকারের তো শরিকি ঝঞ্ঝাট ছিল না! পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যা দূর করার পাল্টা কোনও পথও ভাবা যেত! তাহলে সেটা কেন হয়নি? কেন-বেতোয়া প্রজেক্টের ডিপিআর হয়েছে, বাজট বরাদ্দও। ব্যস, আট বছরে ওই পর্যন্তই। অথচ, কংগ্রেসের আরও একটা পরিকল্পনা কার্যকর করে দেশের কাছে নায়ক হয়ে উঠতে পারতেন তিনি। এমন প্রকল্পকেই না বলে যুগান্তকারী?
নাঃ, বিজেপি সরকার সে সব করছে না। তাদের এখন লক্ষ্য ভাঙাগড়ার খেলা। মহারাষ্ট্র নিয়ে তুমুল টেনশন চলছে। সরকার ভাঙল বলে। আর তাহলেই কেল্লাফতে। আরও একটি রাজ্যে তারা আসবে ক্ষমতায়। ভারতের মানচিত্রের আরও একটু গেরুয়াকরণ। দিনের শেষে ক্ষমতাই সত্য। আত্মনির্ভর ভারত নয়... আট বছর পূর্তির স্লোগান—আত্মমগ্ন বিজেপি।