পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
মনে আছে, বাজপেয়ি জমানায় এক মামলায় তাঁর গ্রেপ্তারের কথা উঠেছিল। আর তাতেই থানায় থানায় হাই অ্যালার্ট। শিবসৈনিকদের ফুঁসে ওঠা আবেগ থেকে হাঙ্গামার আশঙ্কাতেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল গোটা মুম্বই শহর। একদিন নয়, পরপর তিনদিন। থেমে গিয়েছিল জনজীবন। থানে, দাদর, আন্ধেরি সর্বত্র। সৈনিকদের গর্জন থামাতে বাজপেয়ির নির্দেশে দিল্লি থেকে ছুটে যেতে হয়েছিল একাধিক ছোটবড় নেতাকে। মাতশ্রীতে গিয়ে প্রণাম ঠুকে শান্ত করতে হয়েছিল তাঁদের। সঙ্গে ঘনঘন দিল্লি থেকে ফোন আদবানিজির। এবারেও বিদ্রোহী বিধায়ক ও তাঁদের সেনাপতি একনাথ সিন্ধের বিরুদ্ধে শিবসৈনিকদের বিক্ষোভ, ভাঙচুর চলছে গোটা মহারাষ্ট্রে। মুম্বইয়ে জারি হয়েছে ১৪৪ ধারা। কিন্তু সেই হাঙ্গামার তীব্রতা ২০০০ সালের মতো নয়। যতদিন বালাসাহেব বেঁচে ছিলেন মহারাষ্ট্রের জোটে সিনিয়র পার্টনারের সম্মান অক্ষুণ্ণ ছিল শিবসেনার। ওখানে কোনও জারিজুরি চলত না। তাঁর জীবদ্দশায় বিজেপি বরাবর ছিল জোটের জুনিয়র শরিক। সরকারে থাকুন আর নাই থাকুন, বাণিজ্যনগরী মুম্বইয়ের শেষ কথা ছিলেন তিনিই। ভোটের মুখে আসন বণ্টনে ওই সমীকরণ বদলানোর ভাবনা একবারও আসেনি আদবানিজিদের মনে। বালাসাহেবের মুখের উপর নির্দেশের সুরে কথা বলার ক্ষমতা রাজ্যের কোনও বিজেপি নেতা তো দূরঅস্ত, বাজপেয়ি-আদবানিজিরও ছিল না। তখনও যে বাঘের পিঠে সওয়ার দলটার মধ্যে বিদ্রোহ একেবারে হয়নি, সেকথা বলব না। আজ থেকে তিন দশক আগে ১৯৯১ সালে প্রথম বিদ্রোহ করেন ছগন ভুজবল। তারপর একে এক সঞ্জয় নিরুপম, নারায়ণ রানে, রাজ থ্যাকারে, সুরেশ প্রভু। অনেকেই বেরিয়ে গিয়েছেন দল থেকে। পুত্র-সমান ভাইপো রাজ থ্যাকারে তৈরি করেছেন মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা। কিন্তু ছোটখাটো ঢেউ উঠলেও শিবসেনার দাপট কমেনি। দল ভাঙার প্রশ্নও ওঠেনি। কিন্তু এখন সেই দাপটই যে ঘুমিয়ে রয়েছে শিবাজী পার্কের শান্ত চৌহদ্দিতে তাঁর স্মৃতি স্মারকের নিরাপদ ঘেরাটোপে। আর সেই সুযোগেই ভোটব্যাঙ্ক লুটের খেলায় ঝাঁপিয়েছে গেরুয়া শিবির। দেশকে শুধু কংগ্রেস শূন্যই নয়, বিরোধী ও প্রতিদ্বন্দ্বীশূন্য করাই যে আজকের মোদি-শাহর প্রধান এজেন্ডা।
আর এই লক্ষ্যে সাহায্য করছে আঞ্চলিক দলগুলির অক্ষম পারিবারিক শাসন এবং সেই সঙ্গে অযোগ্য নেতৃত্ব। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে আগামী লোকসভা ভোটের পর কংগ্রেস আর জাতীয় দল থাকবে কি না, তা ঘিরেই গভীর প্রশ্নচিহ্ন উঁকি মারছে। বংশানুক্রমে একটা দলের সর্বময় কর্তৃত্ব হাতে এলেও পরবর্তী প্রজন্ম অযোগ্য হলে কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে যায়। টাকা-পয়সা, সাম্রাজ্যের মালিক হওয়া সম্ভব হলেও যোগ্যতা, ব্যক্তিত্ব আর দাপট উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া যায় না। ওই ফাঁক দিয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরনোই সঙ্ঘ পরিবারের লক্ষ্য। বিজেপির কড়া সমালোচনা করেও এই সরল সত্যটা কিন্তু মেনে নেওয়ার সময় এসেছে। বিগত সাতদিনের মহারাষ্ট্র কিসসার সঙ্গে ময়ূরভঞ্জের সাঁওতাল মহিলা দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী করে মোদিজির মাস্টারস্ট্রোক, তার জ্বলন্ত প্রমাণ। স্বীকার করতেই হবে, এই অক্ষমতা আর সীমাবদ্ধতা শুধু উদ্ধব নয়, অত্যন্ত বড় হয়ে বাজছে রাহুল গান্ধীর ক্ষেত্রেও। কংগ্রেসের ক্রমে অস্ত যাওয়াও সেই কারণেই। সেই পড়ে পাওয়া চোদ্দআনা সুযোগটার পুরোপুরি ব্যবহার করছে নরেন্দ্র মোদির সর্বগ্রাসী বিজেপি। উল্টোদিকে গোটা দেশের একমাত্র রাস্তায় নেমে লড়াইয়ের মুখ মমতা। আদ্যন্ত স্ট্রিট ফাইটার। আর যেদিকে তাকাও শুধু শূন্যতা আর শূন্যতা। তাই তৃণমূলকে যেনতেন আক্রমণের ছক কষা চলছে সর্বশক্তি দিয়ে।
কংগ্রেসের ভরা বসন্তে ইন্দিরা গান্ধীর অস্ত্র ছিল অকৃত্রিম ৩৫৬ ধারা ও একান্ত অনুগত রাজ্যপালরা। ওই কালা আইনের সুযোগ নিয়ে একের পর এক সরকার ভাঙার নেশা চেপে গিয়েছিল জওহরলাল কন্যার। সে নিয়ে কংগ্রেসকে তোপ দাগতে ছাড়েননি নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা। সংসদে দাঁড়িয়ে এই সেদিনও দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, এখনও পর্যন্ত ১৩২ বার রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়েছে। তার মধ্যে ৯৩ বার সরকার উল্টেছে নেহরু-গান্ধী পরিবারের দল। এর সিংহভাগই নিঃসন্দেহে ইন্দিরা গান্ধীর ‘একার কৃতিত্ব’। কংগ্রেসের স্বর্ণযুগে এভাবেই ইচ্ছেমতো ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে গিয়েছেন তিনি। মায় জরুরি অবস্থায় গণতন্ত্রকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া পর্যন্ত। কিন্তু আজ আটবছর সরকার চালানোর পর নরেন্দ্র মোদির মুখেও কি গণতন্ত্র কথাটা আর শোভা পায়? এত জয়গান, এত ঢাক বাজানো সব ফিকে হয়ে যায় একের পর এক সরকার ভাঙার নোংরা কুনাট্যের নীচে!
ইন্দিরা যুগের ৩৫৬ই যেন এখন নরেন্দ্র মোদির হাতে পড়ে সাবালক হয়েছে বিধায়ক ভাঙানোর সস্তা ছলচাতুরিতে। এই ‘পবিত্র’ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত এজেন্সিকে। সিবিআই, ইডি, ইনকাম ট্যাক্স বেছে বেছে যাঁরা এখনও লাইনে আসেনি, তাঁদের হেনস্তা করছে। কথা না শুনলেই জেলের গরাদের পিছনে যাও। অনিল দেশমুখ আর নবাব মালিকের পরিণতি তাই তাড়া করছে একনাথ সিন্ধে ও তাঁর পাশে জড়ো হওয়া ৫১ জন বিধায়ককে। নেহরু-ইন্দিরার সবচেয়ে কট্টর সমালোচক সরাসরি ৩৫৬ না এনে মেতেছেন দল ভাঙার নেশায়। একুশের বিধানসভা ভোটের আগে তার উলঙ্গ প্রকাশ দেখেছে বাংলা। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে রোজ জেলায় জেলায় অনুষ্ঠিত হয়েছে যোগদান মেলা পর্যন্ত। বাহ! এই তো আদর্শ গণতন্ত্র। সৌজন্যে চা ওয়ালার ব্যাটা! সংবিধান প্রণেতারা দয়া করে দেখে যান ৫৬ ইঞ্চি ছাতির বীরত্ব।
মমতার সঙ্গে এঁটে উঠতে না পারলেও বিধায়ক কিনে গোয়া, কর্ণাটক, অরুণাচল, মধ্যপ্রদেশ, একের পর এক রাজ্যে সরকার উল্টে দেওয়ার খেলায় মেতেছেন নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর বশংবদরা। রাজস্থানেও গদি উল্টে দেওয়ার চেষ্টা চলছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু সিন্ধিয়া-পুত্র জ্যোতিরাদিত্যের মতো সহজে শচীন পাইলটকে কব্জা করা যায়নি। এবার তাঁদের পাখির চোখ মহারাষ্ট্র। আগেরবার ব্যর্থ হলেও এবার উদ্ধব থ্যাকারের ভুলে কেল্লাফতে করার অপেক্ষায় অমিত শাহের টিম। পিছন থেকে যার নেতৃত্বে রয়েছেন মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ।
কিন্তু এই উলটপুরাণের আসল কারণ, উদ্ধব থ্যাকারের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস আর অহঙ্কার। গত দু’বছর দল পরিচালনার যাবতীয় ভার তিনি ছেড়ে দিয়েছেন ছেলের হাতে। নিয়মিত বিধায়কদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ পর্যন্ত করেননি। মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন বর্ষা থেকেই পরিচালিত হয়েছে তিন দলের জোট সরকার। অথচ এই বয়সেও অসুস্থতা উপেক্ষা করে দিল্লি থেকে মুম্বই ছুটছেন শারদ পাওয়ার। এই সুযোগটাকেই পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছে বিজেপির স্ট্র্যাটেজিস্টরা। গত ১১ জুন যখন রাজ্যসভার ভোটে ক্রসভোটিং হল, তখনও সতর্ক হয়নি নেতৃত্ব। ঘুমিয়ে ছিল। ওই নির্বাচনেও শিবসেনার ভোট যায় বিজেপির বাক্সে। ফলে সকলকে চমকে দিয়ে ছ’টি আসনের মধ্যে তিনটি জিতে নেয় বিজেপি। বিধান পরিষদের নির্বাচনেও মুখ পোড়ে। অন্তত ২০ জন বিধায়ক বিরুদ্ধে ভোট দেয়। উদ্ধব ভুলে গিয়েছিলেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু হয় না। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস পতন ডেকে আনে। বালাসাহেবের উগ্র হিন্দুত্বের লাইন থেকে সরে শারদ পাওয়ারের কথায় পথ চলা একদিন না একদিন যে ব্যুমেরাং হবেই, তা নিশ্চিত ছিল। সেই সুযোগটার ফায়দা তুলতে নেমেছে গেরুয়া শিবির। সঙ্গে শিবসেনার হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক দখলের হাতছানি!
এই খেলার অন্তিম পরিণতি জানতে আরও বেশ কিছুটা সময় অপেক্ষা করতেই হবে। শিবসৈনিকদের রাশ কার হাতে থাকবে তা এখনও অনিশ্চিত। তবে, বালাসাহেব আজ যেখানেই থাকুন না কেন, তিনি নিশ্চয়ই নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে যে কথাটা গুজরাত দাঙ্গার পর আদবানিকে বলেছিলেন, সেটাই বারবার স্মরণ করছেন। ২০০২ সালের দাঙ্গার পর তখন মোদির দুর্দিন। তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বালাসাহেব। আদবানিকে তাঁর পরামর্শ ছিল, গোধরা ও তার পরবর্তী ঘটনার জন্য গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী বদল করলে হিন্দুত্বের সর্বনাশ হয়ে যাবে। কী আশ্চর্য সমাপতন! আজ বালাসাহেবের মূত্যুর এক দশক পর তাঁর শিবসেনাকে গুরুদক্ষিণা দেওয়ার সব আয়োজন সম্পূর্ণ। নরেন্দ্র মোদি শিবসৈনিকদেরই মুছে দিতে মরিয়া। মোদিজিকে কুর্নিশ!