বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
২০১৪ সাল। সেই লার্জার দ্যান ইমেজ আরও একবার ফিরল। এবার সংসদীয় রাজনীতিতে। নরেন্দ্র মোদি দেখালেন, তিনিই শেষ কথা। যা বলবেন, সেটাই হবে। যা করবেন, সেটাই মানবে ভারত। অনেকটা সলমন খানের সেই ডায়লগের মতো, ‘একবার অগর ম্যায় কমিটমেন্ট কর দি, তো ম্যায় খুদকি ভি নেহি সুনতা’। ঠিক তার চার বছরের মাথায় দিল্লির দেহাত কিষান মজদুরদের মহাপঞ্চায়েতে ভাষণ দিচ্ছেন বেঙ্কাইয়া নাইডু। সবে তখন ৫০০ ও হাজার টাকার নোট বাতিল করেছেন নরেন্দ্র মোদি। রাত আটটায় তাঁর জাতির উদ্দেশে ভাষণ মানেই দেশবাসীর কাছে আতঙ্ক। চর্চা তখন শুধু নোট নিয়ে। আর তার সঙ্গে ভোগান্তি। বেঙ্কাইয়া তাঁর বক্তব্যে টানলেন নোট বাতিলের প্রসঙ্গ। গর্বের সঙ্গে বললেন, ‘ওয়াপস লেনা মোদিজিকে খুন মে নেহি হ্যায়’। সিদ্ধান্ত ফেরান না নরেন্দ্র মোদি। ফেরাবেনও না। দেশবাসীর চোখে তখনও ‘আচ্ছে দিনে’র ধাঁধা। আম আদমি
ভাবছে, মোদিজি যখন করেছেন, তখন তাতে
ভালোই হবে। এখন খেতে পাচ্ছি না তো কী! সবুরে মেওয়া ফলে। ক’দিন পর ঠিক ভালো ভালো খেতে পাব। কালো টাকা সব সাদা হবে। ১৫ লক্ষ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট হবে।
রোলব্যাক। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় জনপ্রিয় হয়ে ওঠা একটি শব্দ। আর সেটাই এখন প্রাসঙ্গিক ভারতে। মোদি জমানায়। আচ্ছে দিন আসেনি। বরং নরেন্দ্র মোদি পিছু হটেছেন। একের পর এক সিদ্ধান্তে। রাজনৈতিক অভিধান অনুযায়ী, রোলব্যাক। নোট বাতিলের পর দু’সপ্তাহে অন্তত চার ডজন সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেছিল মোদি সরকার। কখনও বলা হয়েছিল, ব্যাঙ্কে গিয়ে যত খুশি পুরনো নোট বদলে আনুন। তারপরই আবার মোদি সরকার জানাল, ৪ হাজার টাকা সিলিং। এর বেশি একজন একবারে বদলাতে পারবে না। সেটাই আবার হঠাৎ নেমে এল দু’হাজারে। মানুষের তখন খাবি খাওয়ার মতো অবস্থা। রাতে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, পরদিন সকালে তাঁরা দেখছেন, সেটা আর নেই। নতুন ফরমান। নতুন নিয়ম। দেশ ভাবল, সংস্কার করতে গেলে এমন একটু হতেই পারে। কিন্তু জিএসটি? কত ছোট কোম্পানি সেই ধাক্কায় বন্ধ হয়েছে? মোদি সরকার নিশ্চয়ই হিসেবটা জানে। রাজ্যগুলিতে তার জন্য ক্ষতিপূরণ আজও দিয়ে চলেছে কেন্দ্র। পিএফের বিল আনলেন, বিতর্কের পর আবার সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরেও এলেন। জমি অধিগ্রহণ আইন এল... তা ফিরিয়েও নিলেন মোদিজি। ফেরানো অবশ্য তাঁর রক্তে নেই। তাও নিলেন। হয়তো জনস্বার্থে। লকডাউন ঘোষণা করে মোদিজি বললেন, যে যেখানে আছেন, সেখানেই থাকুন। কিন্তু কীভাবে? খাবেন কী তাঁরা? থাকবেন কোথায়? রাস্তায়? উপায় মিলল না। শুরু হল হাঁটা। তারপর এল কৃষি আইন। অবরুদ্ধ দিল্লি সীমানা। বছর ঘুরল। কৃষকরা নড়লেন না। আর শেষে মোদিজি কী করলেন? রোলব্যাক। ক্ষমা চাইলেন। বললেন, আমরাই কৃষকদের একাংশকে বোঝাতে পারিনি। তাই বাতিল হচ্ছে তিন কৃষি আইন। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের রুল এখন নির্ধারিত হয়নি। শ্রম কোড কার্যকর... সেও ঝুলে। আর তার মাঝেই ‘অগ্নিপথ’। আগুন জ্বলেছে দেশের সব প্রান্তে। যুব সমাজ গর্জে উঠেছে, সেনাবাহিনীতে ভর্তির নামে এই ধ্যাষ্টামো চলবে না। চার বছরের চাকরি! সেও কি হয়? ধরা যাক ৫০ হাজার নিয়োগ হল। চার বছর পর তাদের মধ্যে থাকবে মাত্র ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ, সাড়ে ১২ হাজার। বাকিদের চাকরি নট। কেন? দেশের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত বলেই না তারা বাহিনীর কঠিন জীবন বেছে নিয়েছে! কঠোর ট্রেনিংয়ে শরীরকে রোবটের মতো খাটিয়েছে তারা। সেই পরিশ্রমের, আবেগের মূল্য মাত্র চার বছরের চাকরি? ওই ব্যাচের ৪৫ হাজার যুবক-যুবতী যদি দক্ষ হয়, তাহলেও? সেই বিচার নিরপেক্ষ হবে তো? কিন্তু সিদ্ধান্ত সরকার নিয়ে ফেলেছে। পিছু তো হটা যাবে না! সেটা তো আবার রক্তে নেই! তাই মাঝের বছরগুলিতে আরও ছেলেমেয়ে যোগ দেবে বাহিনীতে। দাবি থাকবে তাদেরও। আরও একটা প্রশ্নের উত্তর কিন্তু মিলছে না... চার বছরই কেন? কোন অঙ্কে? এভাবেই কি মিলবে কর্মসংস্থানের সমীকরণ? প্রত্যেক বছর কোনও না কোনও বিধানসভা ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী বলবেন, এই দেখুন, এক বছরে আমরা এত লক্ষ চাকরি দিয়েছি। হোক না চুক্তি-নিয়োগ। সরকারি চাকরি তো! মানতেই হবে, মোদি জমানায় কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির সংজ্ঞাটাই বদলে যাচ্ছে। চাকরি থাকবে, কিন্তু পেনশন নয়। চুক্তি শেষ হলেই একটা থোক টাকা হাতে ধরিয়ে বিদেয় দেওয়া যাবে। তারপর কেউ ধোপার কাজ করবে, কেউ নাপিত, কেউ নিরাপত্তারক্ষী। সরকারের দায়বদ্ধতা থাকছে না। অর্থনীতির ভাষায় লায়াবিলিটি। একজন স্থায়ী কর্মী মানে তাঁর বেতন, বছর বছর ইনক্রিমেন্ট, পেনশন, গ্র্যাচুইটি, অবসরের পরও চিকিৎসা খাতে টাকা জুগিয়ে যাওয়া... এক ধাক্কায় সব শেষ। সরকারি সংস্থাই যদি না থাকে, কর্মী থাকবে কীভাবে? তাই তো বেসরকারিকরণ! তেল, গ্যাসে ভর্তুকি—সে আরও একটা ভয়ানক লায়াবিলিটি। তার থেকেও মুক্তির দিশা খুঁজে নিয়েছে সরকার। দেশের অর্থনীতি যতই টালমাটাল করুক না কেন, দায় ঝেড়ে ফেলায় জুড়ি নেই এই সরকারের। বাকি ছিল দেশের নিরাপত্তা বুক দিয়ে আগলে রাখা সৈনিকরা। তার সঙ্গেও সমঝোতা শুরু হয়েছে। তাই জ্বলছে আগুন। এক্ষেত্রেও কি সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেনি কেন্দ্র? আপস কি করেনি? সেও করেছে। চলতি বছরের জন্য নিয়োগের বয়সসীমা ২১ থেকে বাড়িয়ে ২৩ করা হয়েছে। এসেছে সংরক্ষণের ঘোষণাও। তাও মোদিজি নীরব। ট্রেন-বাসে আগুন লাগানো হয়েছে, যুব সম্প্রদায় উন্মত্তের মতো ‘অগ্নিপথে’র থেকে মুক্তি চেয়েছে, আত্মহত্যার খবর এসেছে... তাও মোদিজি একটি শব্দও এই ক’দিনে উচ্চারণ করেননি। একবার শুধু বলেছেন, অনেক ভালো কাজ রাজনীতির আড়ালে নষ্ট হয়ে যায়। বিশ্লেষকরা টিভিতে আসর বসিয়েছেন—মোদিজি আসলে এটা অগ্নিপথ নিয়েই বলতে চেয়েছেন। কে গ্যারান্টি দেবে? নাম তো উনি করেননি! রবিবার থেকে আবার শোনা গেল নয়া তত্ত্ব—আন্দোলন নাকি আসলে পুরোটাই পরিকল্পিত। ২১ তারিখ পর্যন্ত বিহারকে উত্তপ্ত রাখার ছক কষা হয়েছিল। সত্যিই কি তাই? এটা একটু কাঁচা খেলা হয়ে গেল না? আসলে একটা প্রকল্পের ঘোষণায় এমন দক্ষযজ্ঞ হবে, তা মোদি সরকার ঠাহর করতে পারেনি। তাই এখন এসকেপ রুটের খোঁজ চলছে। যদি একবার বিক্ষোভ-আন্দোলনের ব্যাপারটাকে বিরোধী বা কোনও জঙ্গি গোষ্ঠীর পরিকল্পনা বলে চালিয়ে দেওয়া যায়, তাহলেই তো কেল্লাফতে! আবার নজর ঘুরে যাবে মানুষের। দেশবাসী আরও একবার বিশ্বাস করবে, মোদিজি ভালো করতে চান। কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী মহল করতে দেয় না। তাই প্রধানমন্ত্রী এখনও চুপ। এই মৌনব্রত চলবে। কারণ তিনি জানেন, কিছু বলা মানেই তাঁকে এসপার বা ওসপার বেছে নিতে হবে। হয় বলতে হবে, অগ্নিপথ মিশন ঘোষণা করেছি, বেশ করেছি। এটা থাকবে। আর না হলে রোলব্যাক। দুই ক্ষেত্রেই ইমেজে ধস নামার সমূল সম্ভাবনা। কারণ, পিছু হটা তাঁর রক্তে নেই।
লার্জার দ্যান লাইফ... এই ইমেজ সত্যিই কি আর বেঁচেবর্তে আছে? থাকলে তিনি কি সিদ্ধান্তের ইগোয় আটকে থাকতেন? দাঁড়াতেন মানুষের সামনে। বলতেন, আপনারা মহাত্মা গান্ধীর দেশের মানুষ। হিংসা আপনাদের পথ নয়। বোঝাতেন তিনি
প্রকল্পের সুফল। দাঁড়াতেন নতুন প্রজন্মের পাশে। কিন্তু তিনি মায়ের শতবর্ষ পালন করছেন। লিখছেন আব্বাসের কথা। নরেন্দ্র, আর আব্বাস এই দুই ছেলে হিরাবেনের। একসঙ্গে বড় হয়েছেন তাঁরা। এর আগেও বহুবার অতীত হাতড়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন মায়ের কথা, বাবার চায়ের দোকান, কষ্টের ছেলেবেলার কথা। আব্বাস? মনে পড়ে না। তাহলে হঠাৎ এখন কেন? এবার কি তাহলে বিভাজনের রাজনীতি থেকে রোলব্যাক?
পুনশ্চ: নরেন্দ্র মোদির মা হিরাবেনের নামে রাস্তার নামকরণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্ত আপাতত স্থগিত।