কর্মে অগ্রগতি ও নতুন কাজের বরাত প্রাপ্তি। আইটি কর্মীদের শুভ। মানসিক চঞ্চলতার জন্য বিদ্যাচর্চায় বাধা। ... বিশদ
২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নরেন্দ্র মোদি গালভরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি বছরে ২ কোটি করে চাকরি দেবেন। মানুষের মনে সংশয় ছিলই, কিন্তু ভক্তদের ঢক্কা নিনাদের নীচে চাপা পড়ে গিয়েছিল তাঁদের কণ্ঠ। ‘বিদেশে পাচার হওয়া কালো টাকা ফিরিয়ে এনে প্রত্যেক ভারতীয়ের অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা জমা দেওয়া হবে’ সমেত সমস্ত প্রতিশ্রুতিই ভক্তরা গিলেছিল। টাকার অঙ্কটা কষেছিল কি না, আমার সন্দেহ রয়েছে।
নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরই বছরে ২ কোটি চাকরি সৃষ্টি কিংবা প্রত্যেক ভারতীয়ের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা জমা করা সংক্রান্ত সমস্ত কথা বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ বড়ই ক্ষমাশীল! ইউপিএ-র স্কিমগুলিকেই ঝলমলে মোড়কে সাজাতে এবং নতুন নাম দিয়ে নিজের বলে চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সরকার। দরিদ্রদের কর্মসংস্থানের ‘শেষ অবলম্বন’ যে এমজিএনআরইজিএ স্কিম—সেটাকেই বিদ্রুপ করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি—কিন্তু শেষমেশ বহালও রাখা হয়েছে, কারণ এর কোনও বিকল্প স্কিম এই সরকারের মাথা থেকে বেরয়নি।
খারাপ থেকে আরও খারাপ
বেকারত্বের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। সর্বজনীনভাবে ব্যবহৃত দুটি পরিমাপ পদ্ধতি রয়েছে: প্রথমটি হল সমগ্র শ্রমশক্তি (টোটাল লেবার ফোর্স বা টিএলএফ) এবং দ্বিতীয়টি হল শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের হার (লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট বা এলএফপিআর)। ভারতের সমগ্র শ্রমশক্তি হল ৪৩ কোটি। এলএফপিআর হল মোট শ্রমশক্তির অনুপাত যা বর্তমানে নিযুক্ত অথবা চাকরি বা কাজ খুঁজছে। ২০২২ সালের মে মাসে এই হার ছিল ৪২.১৩ শতাংশ (সূত্র: সিএমআইই)। এই হিসেবটি বিশ্বের সবচেয়ে খারাপগুলির মধ্যে একটি (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে: ৬৩ শতাংশ)। সিএমআইই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, ‘লক্ষ লক্ষ মানুষ শ্রমবাজার ছেড়ে চলে গিয়েছেন। এমনকী, চাকরির খোঁজ নেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছেন তাঁরা। সম্ভবত, চাকরি খুঁজে পেতে ব্যর্থতার কারণেই চরম হতাশ তাঁরা এবং তাঁদের মধ্যে এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে যে চাকরি বাকরি আদৌ নেই।’
নিম্নলিখিত তথ্য প্রকাশিত:
পরিবারের সদস্যদের অংশ শতাংশ
একজনও চাকরি করেন না ৭.৮
একজন ব্যক্তি চাকরি করেন ৬৮.০
দুই বা ততোধিক ব্যক্তি চাকুরে ২৪.২
পাশাপাশি, মাত্র ২০ শতাংশ বেতনভুক চাকুরে, ৫০ শতাংশ ব্যক্তি স্বনিযুক্ত এবং বাকিরা দিনমজুর। সিএমআইই-র কনজিউমার পিরামিড হাউসহোল্ড সার্ভে, জুন ২০২১ অনুসারে, গড়পড়তা পরিবারের মাসিক আয় ১৫ হাজার টাকা এবং খরচ ১১ হাজার টাকা। এইরকম অনিশ্চিত শ্রমবাজারে, পরিবারের একমাত্র কর্মরত ব্যক্তি চাকরি খোয়ালে (যেটা মহামারীর ধাক্কার বছরে ঘটেছিল) পরিবারটি অনিবার্যভাবেই দুর্দশা এবং দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে। দরিদ্রতমদের উপর আঘাতটা নেমে এসেছিল নির্মমভাবে। তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, বেড়েছে
অপুষ্টি এবং ক্ষুধা।
২০১৪ সাল থেকে আটবছরে, লক্ষ লক্ষ চাকরি খোওয়া গিয়েছে, চাকরি সৃষ্টি হয়েছে অল্প কিছু, কমেছে এলএফপিআর এবং বেড়েছে বেকারত্ব। আমরা চেঁচিয়ে গলা ভেঙে ফেলেছি কিন্তু সরকার কর্ণপাত করেনি। তারা গোলমেলে পরিসংখ্যানের আশ্রয় নিয়েছে। এক সময় ‘পাকোড়া বিক্রিকেও’ চাকরি বলে দাবি করা হয়েছিল!
সরল দৃষ্টিতে লুকনো
২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ তারিখ আমার কলামে লিখেছিলাম যে ‘চাকরিগুলি সরল দৃষ্টিতে লুকিয়ে আছে’! সরকারি নথি অনুসারে, সরকারের অনুমোদিত পদের সংখ্যা ৩৪ লক্ষ ৬৫ হাজার। ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত শূন্যপদ ছিল ৮ লক্ষ ৭২ হাজার ২৪৩টি,
যার মধ্যে ৭ লক্ষ ৫৬ হাজার ১৪৬টি গ্রুপ সি-তে (সূত্র: দ্য হিন্দু)। প্রতিটি শ্রেণি দুর্দশার মধ্যে রয়েছে, কিন্তু কারও সমস্যা এসসি এবং এসটিদের থেকে বেশি নয়। আগামী ১৮ মাসে ১০ লক্ষ মানুষকে চাকরি দেওয়া হলে সেটা হবে শুভ সূচনা। তবে ইতিমধ্যেই চিহ্নিত চাকরিতে খাঁটি যোগ হবে মাত্র ১,২৭,৭৫৭ জন (=১০,০০,০০০ - ৮,৭২,২৪৩)।
সরকারকে আরও অনেক কিছু করতে হবে। চাকরি আছে লক্ষ লক্ষ। কিন্তু সেগুলি ‘শনাক্ত’ বা ‘আবিষ্কার’ বা ‘সৃষ্টি’ করতে হবে। যেমন শিক্ষক, গবেষক, গ্রন্থাগারিক, ক্রীড়াক্ষেত্রের কোচ ও ট্রেনার, ফিজিও-থেরাপিস্ট, কাউন্সেলার, ডাক্তার, নার্স, প্যারা-মেডিক্স, ল্যাব টেকনিশিয়ান, স্যানিটেশন ও কনজারভেন্সি কর্মী, নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ বিভাগীয় কর্মী, পশুচিকিত্সক, ধীবর প্রভৃতি।
এগুলি একটি উন্নয়নশীল দেশের ‘প্রয়োজনীয়’ চাকরি। সুযোগগুলি সম্পর্কে সরকার সচেতন বলে মনে হয় না।
সরকারের বাইরে চাকরি
বেশিরভাগ চাকরিই সরকারের আওতার বাইরে। সেগুলি বেসরকারি ক্ষেত্রে। যেগুলির পুরোপুরি ‘এক্সপ্লোর’ বা অন্বেষণ করা হয়নি। বিশেষ করে সমুদ্র, নদী ও জলাভূমি এবং শুষ্ক জমিতে কৃষির মতো ক্ষেত্রগুলি। এক বিশাল জনসংখ্যার দেশ, এত মানুষের চাহিদা বহুবিধ এবং পরিষেবা নিয়ে তারা সন্তুষ্ট নয়। সেই চাহিদাগুলি আংশিকভাবে পূরণ করার লক্ষ্য নিয়েও লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব। ব্যক্তিগত গাড়ির দিকটি ধরে এগন: ২৪.৭ শতাংশ পরিবারের কোনও ধরনের গাড়ি বা মোটরবাইক, এমনকী একটি সাইকেলও নেই। অথবা গৃহস্থালির জিনিসপত্রের কথা বিবেচনা করুন: গরমের দেশে মাত্র ২৪ শতাংশ পরিবারের একটি এসি কিংবা এয়ার কুলার রয়েছে। শুধুমাত্র লক্ষ লক্ষ পরিবারকে সাধ্যের মধ্যে দামে এই প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি সরবরাহ করার উদ্যোগ নিলে দেশের উৎপাদন
ক্ষমতা দারুণভাবে বাড়বে। তাতে হাজার হাজার মানুষের জন্য চাকরি সৃষ্টি হবে। মানুষের জীবনও হয়ে উঠবে সুখের।
চাকরিই হওয়া উচিত ছিল মোদি সরকারের পাখির চোখ। কিন্তু সরকারের সেই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। সরকার আটটি বছর নষ্ট করেছে। ভারতের মানুষকে বিভক্ত করতেই ব্যবহার করেছে তার সামাজিক ও রাজনৈতিক পুঁজি। তাদের ভুল নীতির জন্যই একটি বিভক্ত ভারত অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১০ লক্ষ সরকারি চাকরি এই ক্ষত সারাবে না বা অর্থনীতির ক্ষতি মেরামত করবে না। এ যৎকিঞ্চিৎ এবং বড্ড দেরিতে।