পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, প্রত্যেক ব্যাচের এই বাদ পড়া ৩৪ হাজার ছেলের ভবিষ্যৎ কী হবে? সরকারের কেষ্টবিষ্টুরা কি জানেন না, সেনার চাকরিটা আর পাঁচটার মতো সেই অর্থে কোনও কলম কিংবা গতর খাটানো পেশা নয়, একটা আবেগ। দেশমাতাকে রক্ষা করার শপথ। শত্রুকে খতম করার সঙ্কল্প নিয়ে প্রাণ বাজি রেখে এই কাজে যোগ দেন বীর বাহাদুররা। কোনও পরিবারে হয়তো পাঁচ বছর আগে জঙ্গিদমনে গিয়ে মৃত্যু হয়েছিল বাবার। তাঁর সেদিনের ছোট্ট ছেলেটা হাহাকার করা কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে শপথ নিয়েছিল, একদিন বাবার মতো দেশরক্ষায় ব্রতী হওয়ার। কিংবা কোনও স্ত্রী চোখের জলকে শপথে পরিণত করে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল সেনায়। এটাকে শুধু পেট চালানোর তাগিদ বললে ভুল নয়, বড় অপরাধ হয়ে যাবে। এই সামান্য উপলব্ধিটাই জাতীয়তাবাদী সরকার বাহাদুরের এখনও হল না। চার বছর কাজ করিয়ে ২১ বছর থেকে ২৭ বছরের মধ্যে তাঁদের হাতে সামান্য কিছু টাকা, শংসাপত্র আর একগুচছ শুকনো প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঘরে ফেরানো তাই অমানবিক সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়। শুধু অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র কেনার দোহাই দিয়ে এমন হঠকারি সিদ্ধান্ত তাই মেনে নিতে যুব সমাজের স্বভাবতই কষ্ট হচ্ছে। সেই ক্রোধ থেকেই তারা বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। স্তব্ধ করে দিচ্ছে জনজীবন। এই অমানবিক সিদ্ধান্ত নিয়েই ফুঁসছে গোটা দেশ। মায় যোগী, অমিত শাহদের আদরের ডবল ইঞ্জিন রাজ্যগুলিও। ট্রেনের পর ট্রেন পুড়ছে। চাকরি দেওয়ার আড়ালে সরকারের এই প্রহসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে যুবসমাজ। ঠিক কিছুদিন আগে দিল্লির সীমানায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বসে থাকা অনড় কৃষকদের মতোই। এই অগ্নিবীর নিয়োগের ঘোষণা প্রত্যাহার করতে হবে, এটাই দাবি। কৃষকদের মতো শুধু দিল্লি, পাঞ্জাব, হরিয়ানায় এই অসন্তোষের আগুন কিন্তু সীমাবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে তাই অস্বস্তি বাড়ছে নরেন্দ্র মোদি সরকারের। বিরোধীদের ফুৎকারে উড়িয়ে, কংগ্রেসকে মুছে দিয়ে আর সিবিআইকে বেপরোয়া কাজে লাগিয়েও অস্বস্তি কাটছে না। কারণ, এবার দলে দলে মানুষই যে রাস্তায়। গত সপ্তাহে দলের মুখপাত্র নূপুর শর্মার বিস্ফোরক প্ররোচনামূলক মন্তব্যের পর এ সপ্তাহে সেনায় হাস্যকর চাকরির প্রস্তাব। নরেন্দ্র মোদি কিন্তু বারবার ধাক্কা খাচ্ছেন মানুষের আদালতে। ইঙ্গিতটা মোটেই সুখদায়ক নয়।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটা সামনে এসেছে তা হচ্ছে, সেনায় এতদিন ১৮ থেকে ২৫ বছর ছিল লোক নেওয়ার নির্ধারিত বয়স। কোভিডের কারণে সরকার দু’বছর নিয়োগ বন্ধ রাখার পর যাবতীয় সুযোগ সুবিধা ছাড়াই নতুন এই অগ্নিবীর পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সেটা কমিয়ে সাড়ে ১৭ বছর থেকে ২১ করল কোন যুক্তিতে। তারপর আবার চাপে পড়ে এবারের মতো ঊর্ধ্বসীমা ২৩ বছর করলেও আসল সমস্যার কিন্তু সমাধান হল না। সবাই ভেবেছিল দু’বছর নষ্ট হওয়ার দরুন বয়সের ঊর্ধ্বসীমা বেড়ে ২৫ বছরের বদলে ২৭ হবে। তা না হওয়ায় হতাশা চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছেছে। আবার দীর্ঘ চার বছর স্থায়ী সেনাদের সমান ঝুঁকির কাজ করেও কেন পেনশন, গ্র্যাচুইটি থেকে এই বিশাল সংখ্যক অল্পবয়সি যোদ্ধারা বঞ্চিত থাকবেন, তাও ভাবাচ্ছে। আর যদি চার বছর পর চাকরি থেকে বিদায় নিশ্চিতই হয়, তাহলে তাঁরা প্রাণের ঝুঁকি নেবেন কেন? অথচ হিসেব বলছে, এই পেনশন, গ্র্যাচুইটি না পাওয়াদের উপরই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কাজের বোঝা চাপিয়ে দেবেন সিনিয়ররা। এটাই অলিখিত নিয়ম। শত্রুর বুলেটে কখনও লেখা থাকে না, এটা শুধু স্থায়ী কর্মরত সেনারই রক্ত নেবে। চার বছর পর যারা বেকার হবে তাদের নয়। কিন্তু যদি তাই হয়, সেক্ষেত্রে মোদি সরকারের কল্যাণে সেনার মধ্যেই দু’টি পৃথক গোষ্ঠী তৈরি হবে, যা শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনীর পক্ষে মোটেই স্বাস্থ্যকর উদাহরণ হবে না। সেক্ষেত্রে সেনার মধ্যেকার ঐক্য ও সংহতিও ক্ষুণ্ণ হতে বাধ্য।
সরকারের যুক্তি হচ্ছে, কমবয়সিদের নিলে সেনাবাহিনীর মধ্যে গড় বয়স অনেকটা কমবে। আর বয়স কমলে জওয়ানদের ক্ষিপ্রতা ও শত্রু দমনে দক্ষতাও বৃদ্ধি পাবে। যে কোনও দেশই সেনা জওয়ানদের গড় বয়স কমানোর দিকে সবসময় সতর্ক নজর রাখে। কারণ দুর্গম এলাকায় কঠিন অপারেশনে কমবয়সিরাই বাহিনীর সম্পদ। সবই ঠিক আছে, কিন্তু এই অল্পবয়সিদের দায় নিতে সরকারের এত কিন্তু কিন্তু কেন? ওরাও তো এদেশেরই ছেলেমেয়ে।
সেই ২০১৪ সাল থেকেই বছরে দু’কোটি চাকরি স্বপ্নই থেকে গিয়েছে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো করোনার ধাক্কায় দু’বছর সরকারি দপ্তরে নিয়োগ কার্যত বন্ধ। বয়স বেড়ে গিয়েছে অসহায় বেকারদের। আবেদন করার যোগ্যতাই হারাচ্ছেন কোটি কোটি ছেলেমেয়ে। তাদের কথা কে মনে রাখে। এরা তো সবাই সাধারণ। নেতানেত্রীদের ছেলেমেয়ে নন। আজ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারে সরাসরি চাকরি পাওয়ার দু’টোই প্রধান ঠিকানা, রেল আর সেনা। এই দু’টি ক্ষেত্রেই সবথেকে বেশি লোক নেওয়া হয়। সাধারণরাও সুযোগ পেতে পারে। আর তার জন্যই বিহার, উত্তরপ্রদেশ রাজস্থানের লক্ষ লক্ষ যুবক হা-পিত্যেশ করে বসে থাকে। কিন্তু চাকরি দেওয়ার নামে এই প্রহসন! অল্পবয়সি বেকারদের নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলা। অবহেলা সহ্য করতে না পেরে পথে নেমেছেন তাঁরা। বিহার থেকে তেলেঙ্গানা—বিক্ষোভ আন্দোলনে কাঁপছে। ফুঁসছে যুবসমাজ। জমা ক্ষোভ ছিলই। কিন্তু তাতে ঘৃতাহুতির কাজ করল কেন্দ্রীয় সরকারের সেনায় লোক নেওয়ার অগ্নিপথ যোজনা। অবিলম্বে বিজ্ঞপ্তি সংশোধন করে সরকারকে নতুন ঘোষণা করতে হবে। সেনা জওয়ানদের ভবিষ্যৎ জীবনের দায় দায়িত্ব নিতে হবে। না হলে এ আগুন কিন্তু থামবে না। আরও ছড়াবে রাজ্যে রাজ্যে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাওয়ার আগেই মোদি সরকারের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হোক। এই কঠিন সময়ে সাধারণ মানুষ আগুন নয়, শান্তি ও সহাবস্থান চায়।