কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
এখন আদালতে। তবে সেই রিপোর্ট কংগ্রেসের দাবিকে সমর্থন করছে না, উল্টে রাজ্য পুলিসের নেওয়া পদক্ষেপের সঙ্গে মিল রয়েছে বিস্তর। ফলে সিবিআই তদন্তের নির্দেশে যাঁরা একদা উল্লসিত হয়েছিলেন, এখন তাঁরা বেশ হতাশ। কারণ তাঁরাও বুঝতে পারছেন, দূরের সর্ষেখেত ঘন দেখায়, প্রবাদটা মোটেই মিথ্যে নয়।
পুরভোটে ঝালদার ফল হয়েছিল ত্রিশঙ্কু। কংগ্রেস ও তৃণমূল সমসংখ্যক আসন জেতায় বোর্ডের ভাগ্য ঝুলছিল দুই নির্দল কাউন্সিলারের সিদ্ধান্তের উপর। এমনই এক প্রেক্ষাপটে ১৩ মার্চ খুন হয়েছিলেন কংগ্রেস কাউন্সিলার তপন কান্দু। সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপি একযোগে রাজ্যের শাসক দলের দিকে আঙুল তুলেছিল। তাদের অভিযোগ, পুরসভার ক্ষমতা দখলের জন্যই পরিকল্পিতভাবে তপনবাবুকে খুন করা হয়েছে।
তবে পুলিস তদন্তে নেমে বুঝেছিল, রাজনৈতিক নয়, দুই পরিবারের রেষারেষির কারণেই এই খুন। ঘটনাটা একেবারেই পারিবারিক। দুই পরিবারের দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের জেরে তপনবাবুর ভাইপো দীপক তাঁরই বিরুদ্ধে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছিল। দীপককে ধরলে তৃণমূলের নাম জড়াবে, এটা জানার পরেও পুলিস তাকে ও তার বাবা নরেন কান্দুকে গ্রেপ্তার করেছিল। এমনকী, পুলিসের চোখে যে মূল ‘খুনি’ সেই কলেবর সিংকে ঝাড়খণ্ড থেকে ধরে এনেছিল। তদন্ত এগচ্ছিল বেশ দ্রুত। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব সিবিআই তদন্তে অনড় ছিল। তাদের বক্তব্য, খুনের পিছনে আছেন ঝালদা থানার আইসি এবং তৃণমূলের বড় বড় নেতা। তাই তাঁদের গ্রেপ্তার না করলে কোনও তদন্তই তারা মানবে না।
ঝালদা কাণ্ডের সিবিআই তদন্ত হয়েছে। পুলিসের সন্দেহের তালিকায় থাকা আরও একজনকে সিবিআই গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু আইসি বা কোনও তৃণমূল নেতা গ্রেপ্তার হননি। সিবিআইয়ের দেওয়া চার্জশিটে ঝালদার আইসি বা অন্য কোনও তৃণমূল নেতার নাম নেই। এখনও ঝালদা থানার আইসি সেই সঞ্জীব ঘোষ বহাল তবিয়তে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
সিবিআইয়ের এই তদন্ত রাজ্য পুলিসের মর্যাদা বৃদ্ধি করবে। কেন? বিরোধীদের প্রবল চাপ সত্ত্বেও পুলিস কর্তারা আইসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি। সিট তদন্তে নেমে বুঝেছিল, এই ঘটনা একেবারেই পারিবারিক দ্বন্দ্বের পরিণতি। তাতে পুলিস কোনওভাবেই যুক্ত নয়। তাই ‘সাময়িক স্বস্তি’র জন্য আইসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে হিতে বিপরীত হবে। ফোর্সের মনোবলে চিড় ধরবে। তাই তাঁকে সাসপেন্ড বা গ্রেপ্তার করা তো দূরের কথা, অন্য থানায় সরানো পর্যন্ত হয়নি। অনেকে বলছেন, পুলিস কর্তাদের ‘ঝুঁকে গা নেহি’ স্ট্যান্ড ছিল যথার্থ। তবে, জেলা পুলিস বা ‘সিট’ যদি তপন কান্দু খুনের ঘটনায় এই একই চার্জশিট আদালতে পেশ করত তাহলে বিরোধীরা হইচই জুড়ে দিতেন। তাঁরা নিশ্চিত করেই বলতেন, মুখ্যমন্ত্রীর বেঁধে দেওয়া ছকেই পুলিস তদন্ত করছে। পুলিসকে আড়াল করা হচ্ছে। এরাজ্যের পুলিসকে দিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত কিছুতেই সম্ভব নয়। ফের সরগরম হতো বাংলার রাজনীতি। কিন্তু চার্জশিট দিয়েছে সিবিআই। তাই বিরোধীদের মুখে রা নেই। ফলে ঝালদা কাণ্ডে বিরোধীদের সিবিআই তদন্তের দাবি রাজ্যের শাসক দলের কাছে ‘শাপে বর’ হয়েছে।
২১ মার্চ রাতে উপপ্রধান ভাদু শেখ খুনের পাল্টা হিসেবে বগটুই গ্রামের ন’জনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। ঘটনার নৃশংসতায় স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল গোটা বাংলা। শিহরিত, আতঙ্কিত মানুষের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল একটিই শব্দ, ছিঃ।
আক্রান্ত এবং আক্রমণকারী উভয়েরই রাজনৈতিক পরিচয়, তারা তৃণমূলের লোক। তবুও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজধর্ম পালনে পিছপা হননি। ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে নিজের দলের ব্লক সভাপতিকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কর্তব্যে গাফিলতির জন্য সরিয়ে দিয়েছিলেন পুলিস অফিসারকেও। তৃণমূলের ব্লক সভাপতি সহ ২০জনকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিস।
এই কেসের তদন্তে নেমে সিবিআই সাতজনকে গ্রেপ্তার করলেও ভাদু শেখের সবচেয়ে ‘কাছের মানুষ’ লালন এখনও অধরা। ফলে উদ্ধার হয়নি তার বাড়িতে লাগানো সিসি ক্যামেরার ফুটেজ। সেটা পেলে হামলাকারীদের চিহ্নিত করতে সুবিধে হতো। তবে, এখনও রাজ্য পুলিসের দেখানো পথেই এগচ্ছে সিবিআই তদন্ত। তাই দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনমাস অতিক্রান্ত হলেও তদন্তের মোড় অন্যদিকে ঘুরেছে, এমন কোনও তথ্য জনসমক্ষে আসেনি।
হাঁসখালি কাণ্ডে অপরাধ সংগঠিত হয়েছিল ৪ এপ্রিল। নাবালিকার মৃত্যুর বিষয়টি থানায় জানানোর পরের দিনই মূল অভিযুক্ত সোহেল গয়ালিকে পুলিস গ্রেপ্তার করেছিল। তবে, তিনদিনের মাথায় সিবিআইয়ের হাতে তদন্তভার চলে যাওয়ায় পুলিস আর এগতে পারেনি। তারপর দু’মাস অতিক্রান্ত। কিন্তু তদন্তে তেমন গতি নেই। কারণ ময়নাতদন্ত না করেই পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে নাবালিকার দেহ। ফলে অনেক তথ্যপ্রমাণই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাই কেসের ভাগ্য নির্ভর করছে মূলত সাক্ষীর উপর।
অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করাই তদন্তকারী সংস্থার একমাত্র কাজ নয়। তথ্য জোগাড় করে ধৃতকে দোষী প্রমাণ করার দায়ও তদন্তকারী অফিসারদেরই। সেই তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করতেই হাঁসখালির ঘটনার তদন্তকারী অফিসারদের হিমশিম খাওয়ার অবস্থা। এমনিতেই তাদের লোকবল কম। তার উপর ‘সোর্স’ও তেমন নেই। ফলে কাজটা তাদের জন্য বেশ কঠিন। এদিকে, এমন একটা স্পর্শকাতর ঘটনায় অভিযুক্তদের পরিণতি দেখার জন্য গোটা রাজ্য উন্মুখ হয়ে
রয়েছে। এই অবস্থায় দোষীদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে না পারলে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার মুখ আরও একবার ‘পুড়বে’।
বিচারকই ঠিক করবেন, রাজ্যের এই তিনটি ঘটনায় কে বা কারা অপরাধী এবং খুনের উদ্দেশ্য কী? তাই তদন্ত এবং বিচার প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেমন কাউকে ‘খুনি’ বলা যাবে না, তেমনি ‘ক্লিনচিট’ দেওয়াও ঠিক নয়। তবে, তপন কান্দু খুনের সিবিআই তদন্তে একটা বিষয় পরিষ্কার, ঝালদা থানার আইসির বিরুদ্ধে সিবিআই এখনও কোনও তথ্যপ্রমাণ পায়নি। তাই পূর্ণিমাদেবীর দাবি যতই জোরালো হোক না কেন, আইসিকে সিবিআই গ্রেপ্তার করতে পারেনি। চার্জশিটেও তাঁর নাম নেই। ফলে পূর্ণিমাদেবীর আক্ষেপ থেকেই গিয়েছে।
পূর্ণিমাদেবী রাজনীতির মানুষ। তাঁর কথায় রাজনীতির ছাপ স্পষ্ট। সিবিআই তদন্তে এখনও
আস্থা রাখলেও তিনি যে সন্তুষ্ট নন, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, কেন আইসিকে গ্রেপ্তার করা হল না? কেন তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না?
শুধু পূর্ণিমাদেবীই নন, আট মাসে রাজ্যের দশটি মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়া মহামান্য বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের মনেও জেগেছে সংশয়। তাঁর কথায়,‘ডজন খানেক সিবিআই তদন্ত দিয়েছি। সবটাই শেষপর্যন্ত নোবেল চুরি হবে না তো! ভাবছিলাম এতগুলো সিবিআই তদন্ত দিয়ে ভুল করলাম নাকি! বরং সিটকে দিলে ভালো হতো। সিবিআইয়ের ম্যানপাওয়ার নেই।’
বিরোধীদের চোখে সিবিআই ‘অতিমানবীয় শক্তি’ হলেও বাস্তবের মাটিতে তারা হোঁচট খাওয়ার রেকর্ড গড়েছে। সাংবিধানিক ক্ষমতায় বলীয়ান সিবিআইয়ের ‘ভার’ নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু ধার? ‘রাজনৈতিক প্রভু’দের যথেচ্ছ ব্যবহারে তা হয়েছে ‘ভোঁতা’। কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। দেশের সর্বাধিক শক্তিশালী তদন্তকারী সংস্থাকে
ঘিরে সন্দেহের উদ্রেক মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। তবুও সেটাই হচ্ছে।
বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ও কংগ্রেস কাউন্সিলার পূর্ণিমা কান্দু সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর মানুষ।
তা সত্ত্বেও সিবিআইকে ঘিরে তাঁদের মনোভাব কোথাও যেন ‘একই বিন্দুতে’ গিয়ে মিশেছে। কেন সিবিআইকে ঘিরে এত সংশয়, কেন এত প্রশ্ন? সময় এসেছে উত্তর খোঁজার।