গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
১৯৩৯-এর ১ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই তার ধাক্কা এসে লাগে ভারতের আমদানি নির্ভর সাইকেল ব্যবসায়। কারণ, যুদ্ধকালে ইউরোপে উৎপাদন শিল্প মুখ থুবড়ে পড়ে। বিয়াল্লিশে বন্ধই হয়ে যায় বিলাতি পণ্যের আমদানি। সমস্যা বহুগুণ হয় জ্বালানি তেলের সঙ্কট তীব্রতর হওয়ায়। পঁয়তাল্লিশে যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার পরেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। স্বভাবতই সাইকেলের চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে। এই সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিল সদ্য স্বাধীন ভারত। শিল্পায়নের সেই উদ্যোগে উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল বাংলার, বাঙালির।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাওয়ার আশঙ্কা করেছিল পৃথিবী কিছুদিন আগেই। বিশ্বযুদ্ধ না বাধলেও ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পৃথিবী স্পষ্টত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গিয়েছে। তার বিরূপ প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে। সবচেয়ে বেশি সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে খনিজ তেলের ক্রয়-বিক্রয়ে। ভারতের প্রয়োজনের ৮০ শতাংশ তেল আমদানিকৃত। পেট্রল, ডিজেল ও রান্নার গ্যাস ইদানীং যে অগ্নিমূল্য হয়েছে তার বড় কারণ যুদ্ধ। পেট্রপণ্যের দামবৃদ্ধির কারণে পরিবহণ শিল্পে নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছে। পরিবহণ খরচ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। সবকিছুরই দাম সাধারণের সাধ্যের বাইরে চলে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক যে একেবারে তলানিতে পৌঁছেছে তারও কেন্দ্রে পেট্রল, ডিজেলের দাম বিতর্ক।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পরিণামে এই যে অভূতপূর্ব সঙ্কট, তার সুবিধা পাবে বাংলার নয়া শিল্পচিন্তা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের দৃষ্টান্ত সামনেই রয়েছে। গত শতকের প্রথমার্ধ দূষণ নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং সচেতন—কোনওটাই ছিল না। আজকের দূষণ দানব সাইকেল নামক গ্রিন বাহনকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। খড়্গপুরের সাইকেল পার্কে বছরে দুই-আড়াই লক্ষ সাইকেল তৈরি হবে। এই পরিকল্পনার প্রাণভোমরা রাজ্যের স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে সাইকেল বিতরণ কর্মসূচি। সার্থক নাম ‘সবুজসাথী’।
দূরে দূরে স্কুলে যাতায়াতের সুবিধা সব জায়গায় নেই। বাম আমলে স্কুলছুটের এ ছিল অন্যতম এক কারণ। এই সমস্যার শিকার সবচেয়ে বেশি হয়েছিল মেয়েরা। সুরাহা বের করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৫ সালে রাজ্যে চালু হয় ‘সবুজসাথী’—পড়ুয়াদের মধ্যে বিনামূল্যে সাইকেল দেওয়ার প্রকল্প। এই প্রকল্পে বছরে প্রায় ১২ লক্ষ সাইকেল বণ্টিত হয়। এ পর্যন্ত ১ কোটি ৫ লক্ষের মতো সাইকেল দেওয়া হয়ে গিয়েছে। সাইকেল বিতরণের এত বড় কর্মসূচির কথা কোনও রাজ্য এর আগে ভাবতেও পারেনি। এর সঙ্গে শাপে বরের মতোই যোগ হয়েছিল করোনাকাল। করোনাপর্বে গণপরিবহণ ব্যবস্থা আক্ষরিক অর্থেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল। ফলে টানা দু’বছর বহু মানুষের চলাচল হয়ে উঠেছিল সাইকেল নির্ভর। করোনা নিয়ন্ত্রণে আসার পরেও সেই অভ্যাস অনেকের ক্ষেত্রে রয়ে গিয়েছে। সেটা মূলত অগ্নিমূল্যের পেট্রল, ডিজেলের সৌজন্যে। তাই রাজ্যে সাইকেল ব্যবহারকারীর সংখ্যা যথেষ্ট বেড়েছে।
জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার পঞ্চম রিপোর্ট অনুসারে, সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিবারের হাতে সাইকেল রয়েছে এই বাংলাতেই। কোনও সন্দেহ নেই, করোনাকালের নয়া অভ্যাসের প্রতিফলন তাতে পড়েছে। এই সূচকে বৃহত্তম রাজ্য উত্তরপ্রদেশকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্য। জাতীয় সমীক্ষায় প্রকাশ, সাইকেল ব্যবহারকারী পরিবারের জাতীয় গড় ৫০.৪ শতাংশ। অন্যদিকে, যোগীরাজ্যে সাইকেল আছে ৭৫.৬ শতাংশ বাড়িতে। এই হার বাংলার ক্ষেত্রে ৭৮.৯ শতাংশ। এরাজ্যের শহর ও গ্রামীণ দুই এলাকাতেই সাইকেলের ব্যবহার বেশ ভালো। গ্রামবাংলায় সাইকেল চড়ে ৮২.৩ শতাংশ পরিবার। আর, ৭১.৯ শতাংশ পরিবারে সাইকেল আছে বাংলার শহরাঞ্চলে।
শিল্প-বাণিজ্যের প্রাণ হল চাহিদা। বাংলার আর্থ-সামাজিক কাঠামোয় সাইকেলের চাহিদা সবসময়ই ছিল। সেই চাহিদাকে বহুবর্ধিত করেছে রাজ্য সরকার। এত বড় আশীর্বাদ, কোনও একটি শিল্প সচরাচর পায় না। দুর্ভাগ্য হল, দেশের মধ্যে সর্বাধিক চাহিদার রাজ্যের নিজস্ব কোনও সাইকেল কারখানা নেই। সবটাই চলে আমদানির ভরসায়। চাকাটিকেই এবার উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার সঙ্কল্প নিয়েছেন মমতা।
ভারতের সাইকেল শিল্পের অতীতে চোখ রাখা যায়। ব্রিটিশ যুগের শিল্পনীতি ছিল দেশীয় শিল্পের শত্রু। স্বাধীন ভারতের প্রথম শিল্পমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক ঘোষিত শিল্পনীতিতে আশান্বিত হন সাইকেল উৎপাদনে আগ্রহীরা। সুধীরকুমার সেন একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা জমা দেন শ্যামাপ্রসাদের কাছে। ১৯৪৮-এ ইংলন্ডের র্যালে ইন্ডাস্ট্রিজের প্রযুক্তিগত সহযোগিতা আর সুধীরকুমার সেনের ঈর্ষণীয় পরিচালন দক্ষতার সম্মিলনে ভূমিষ্ঠ হল ভারতের সেরা সাইকেল কোম্পানি সেন-র্যালে। যন্ত্রাংশের জন্য প্রযুক্তিগত সহযোগিতা নিলেন জার্মানির দুটি কোম্পানির। সেন র্যালে পূর্ণতা পায় ব্রিটেন ও জার্মানির সহযোগিতায়। আর এই স্বয়ংসম্পূর্ণ সংস্থাটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় সাত দশক আগে (১৯৫২-র ২১ জুন)। ‘রবিনহুড’ ব্র্যান্ডের সাইকেল দিয়ে ওই বছর অক্টোবরে সেন র্যালে কারখানায় উৎপাদনের শুভ সূচনা হয়। পর্যায়ক্রমে র্যালে, হাম্বার ও রাজ ব্র্যান্ডও বাজারে আনে সংস্থাটি। প্রায় একই সময়ে মাদ্রাজে প্রস্তুত হতে থাকে ‘টিআই’ কোম্পানির ফিলিপস ও হারকিউলিস সাইকেল। এছাড়া কমবেশি কমপ্লিট সাইকেল উৎপাদন ছিল অ্যাটলাস ইন্ডিয়া ও হিন্দুস্থান কোম্পানির। তবে সারা ভারতের শিল্পমহল নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছিল যে ভারতে সাইকেল ব্যাবসা তথা সাইকেল শিল্পের সঙ্গে এস কে সেন নামটি সমার্থক হয়ে গিয়েছে, সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের পথপ্রদর্শক তিনিই। তাই সেন-র্যালের একাধিক প্রতিযোগী থাকলেও কন্যাপুর সাইকেল শিল্পনগরীর উপরেই ভারতের সাইকেল শিল্প ও ব্যাবসার সাফল্য-ব্যর্থতা একান্তভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল।
আমরা আশা রাখব, খড়্গপুরের প্রস্তাবিত সাইকেল পার্ক বাংলার সেই ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারেরই এক সোনালি অধ্যায় হয়ে উঠবে। বাড়বে দেশ-বিদেশের বিনিয়োগ। রাজ্যের বিপুল চাহিদাকে পাথেয় করে সাইকেল কারখানার সংখ্যাও বাড়বে ধীরে ধীরে। সাইকেল শিল্পের পথ ধরেই গড়ে উঠবে যন্ত্রাংশ ও টায়ার শিল্প। জোয়ার আসবে বাংলার চাকরির বাজারে। অচিরেই প্রমাণিত হবে ‘বেঙ্গল মিনস বিজনেস’ নিছক কোনও স্লোগান নয়, একটি সত্যের ঘোষণা।