কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
দ্বাদশ পর্যন্ত বাংলা বোর্ডে পড়াশোনা করার পর স্বচ্ছন্দে উচ্চশিক্ষার প্রাঙ্গণে প্রবেশ করার ইতিহাস আমাদের ছিল। চূড়ান্ত সাফল্য পাওয়ার উদাহরণও অন্তহীন। কিন্তু এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে, উচ্চশিক্ষায় এবং উচ্চমানের চাকরি পেতে হলে, শুধুই
প্রথাগত শিক্ষা যথেষ্ট হচ্ছে না। সমান বিপজ্জনক প্রবণতা হল, যে কোনও উচ্চশিক্ষার প্রবেশিকা পরীক্ষা ভারত সরকারের আওতায় থাকা কোনও পরীক্ষা পরিচালন সংস্থার হাতে চলে যাচ্ছে। অথবা বেসরকারি হাতে। যা নিয়ে রাজ্যে রাজ্যে ক্ষোভ বিক্ষোভও হয়েছে। মামলা মোকদ্দমা চলছে। পরিস্থিতিটি এমন করা হচ্ছে যে, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় স্তরের বোর্ড যারা ছোট থেকেই অনুসরণ করেছে, তাদের উত্তীর্ণ হওয়া ও সুযোগ পাওয়ার সুবিধা অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে। সিবিএসই স্কুলের সংখ্যা নগণ্য গোটা দেশের রাজ্য বোর্ডের তুলনায়। অথচ আইআইটিতে সবথেকে বেশি চান্স পাওয়া ছাত্রছাত্রীই আসে কেন্দ্রীয় বোর্ড থেকেই। প্রধানত সিবিএসই। এটা এক আশ্চর্য প্রবণতা। এই প্রবণতার কারণ অনেক গভীরে। সিবিএসই স্কুল সাধারণত বেসরকারি হয়। সরকারি খুব কম। আর এই স্কুলগুলিতে পড়তে হলে অভিভাবকদের আর্থিক সচ্ছলতা থাকতে হবে।
এই ছাত্রছাত্রীরা সচরাচর একটা সময় পর পৃথক কোর্সে ভর্তি হয় উচ্চশিক্ষায় সুযোগ পাওয়ার জন্য। সেই আর্থিক ব্যয়ও অনেক। আর ঘটনাচক্রে সুযোগও পায় তারা অনেক বেশি। এর পাশাপাশি আছে ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা ও চাকরি পাওয়ার একটি বিস্ময়কর প্রবণতা। অতীতে শুধু ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি পাওয়ার পর একটা চাকরি পাওয়া যেত। এখন কিন্তু দেখা যাচ্ছে পাশ করার পর আবার একটা ম্যানেজমেন্ট কোর্স করা হয়। যার খরচ লক্ষ লক্ষ টাকা। সকলেই কি ম্যানেজমেন্ট কোর্স করে দুর্দান্ত উচ্চমানের চাকরি পাচ্ছে? না পাচ্ছে না। যত টাকা ব্যয় করে ম্যানেজমেন্ট পড়ছে, সেই তুলনায় তাদের বেতন হচ্ছে হতাশজনক। আবার এর সঙ্গেই প্রশ্ন, দেশ এবং বিদেশ থেকে এই যে এত ম্যানেজমেন্ট শিক্ষার প্রতিষ্ঠান এবং লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে ম্যানেজমেন্ট পড়ে যোগ দিচ্ছে নানাবিধ সংস্থায়, তাহলে আর্থিক মন্দায় সংস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়া, অবাধে কর্মী ছাঁটাই, বিভিন্ন ইউনিট বন্ধ করে দেওয়া—এসব ঘটছে কেন?
ভারতে ১৫ লক্ষাধিক স্কুল আছে। এর মধ্যে দ্বাদশ ক্লাস পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষ। এই দেড় লক্ষ হাইস্কুলের মধ্যে দেশে সিবিএসই স্কুলের সংখ্যা ২৪ হাজার। বাকি ১ লক্ষ ২৫ হাজার মতো স্কুল রাজ্য স্তরের শিক্ষা বোর্ডের অন্তর্গত। আর বাকি রয়ে যাওয়া স্কুলগুলি আইসিএসই, আইবি কিংবা অনুমোদনহীন। সিবিএসই স্কুল থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩ লক্ষাধিক। কিন্তু শুধু পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য উচ্চ শিক্ষা সংসদের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যাই হল সাড়ে ৮ লক্ষ। সব রাজ্য মিলিয়ে রাজ্যের শিক্ষা বোর্ড যোগ করলে সংখ্যাটি কোথায় যাবে সহজেই অনুমেয়। কিন্তু ‘কেরিয়ার সিক্সটি’ নামক একটি সংস্থা সমীক্ষা করে এক আশ্চর্য তথ্য পেয়েছে। আইআইটি, ট্রিপল আইটি, এনআইটি, সিএফটিআই ইত্যাদি উচ্চশিক্ষার পরীক্ষায় যারা চান্স পেয়েছে, তাদের মধ্যে ৫৯ শতাংশ ছাত্রছাত্রীই এসেছে সিবিএসই বোর্ড থেকে। মাত্র ৩৫ শতাংশ এসেছে রাজ্য বোর্ডগুলি থেকে। অর্থাৎ দেশজুড়ে কম স্কুল থাকা সত্ত্বেও সিবিএসই স্কুলগুলিতে পড়াশোনা করা ছেলেমেয়েরাই বেশি সুযোগ পাচ্ছে। উচ্চশিক্ষায়। কারিগরি শিক্ষায়। এর পিছনে কারণ কী? রাজ্য বোর্ডে খারাপ মেধা আর কেন্দ্রীয় বোর্ডে ভালো মেধার পড়ুয়ারাই থাকে, এটা তো হতে পারে না! তাই সমস্যাটি চিহ্নিত করা দরকার।
২০১৮ সালে আইআইটি কানপুর একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। সেখানে দেখা গিয়েছিল আইআইটির ১১৯৬১ আসনের মধ্যে ৬৬০০ ছাত্রছাত্রীই এসেছে সিবিএসই স্কুল থেকে। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি সিবিএসই। বাকি সব রাজ্যের বোর্ড মিলিয়ে অর্ধেক। এই প্রবণতার এখানেই শেষ হচ্ছে না। আরও বেশি করে ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় পরীক্ষা পরিচালন ব্যবস্থার মধ্যে চলে যাচ্ছে একের পর এক নিয়োগ পরীক্ষা, চাকরির পরীক্ষা, উচ্চশিক্ষার প্রবেশিকা পরীক্ষা। ক্যাট, জয়েন্ট, নিট, এইমস এসব তো ছিলই। এখন আবার নতুন করে স্থির হয়েছে কমন ইউনিভার্সিটি এন্ট্রান্স টেস্ট। বিশেষ করে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আর শুধুই রাজ্য স্তরের শিক্ষা বোর্ডে পড়াশোনা করে উচ্চমানের নম্বর নিয়ে এসে কলেজগুলিতে ভর্তি হওয়া যাবে না। এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে পৃথকভাবে প্রবেশিকা পরীক্ষা হবে।
স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে ভর্তির পরীক্ষার সিলেবাস ও প্রশ্নপত্রের ধাঁচ কেন্দ্রীয় বোর্ডের মতোই হবে। যা সিবিএসই, আইসিএসইর ছাঁদে
তৈরি হবে। অর্থাৎ ওই বোর্ডগুলিতে পড়া পড়ুয়াদের সুবিধা হবে কিছুটা। আর এভাবে কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে উচ্চমাধ্যমিকে প্রাপ্ত নম্বরকে গুরুত্বহীন করে দেওয়ায় উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাটিকেও তাৎপর্যহীন করে দেওয়া হচ্ছে। সকলেই তো প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রস্তুতিতেই মন দেবে।
এই গোটা প্রক্রিয়ায় এতক্ষণ যে বিষয়টি আলোচনার বাইরে রয়ে গেল, তা হল, সূক্ষ্মভাবে দেখলে বোঝা যাবে, উচ্চশিক্ষার অঙ্গনটি ক্রমেই গরিব মানুষের আওতায় বাইরে চলে যাচ্ছে। সিবিএসই চালিত বেসরকারি স্কুলে পড়ার ক্ষমতা সকলের নেই। সেই স্কুলে পড়ার পাশাপাশি প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার যে বেসরকারি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলি আছে, সেখানেও ভর্তি হয়ে কয়েক বছর ধরে পড়ার আর্থিক সক্ষমতাও সকলের নেই। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর আবার নামজাদা ম্যানেজমেন্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার অর্থনৈতিক জোর এই গরিব মানুষের দেশে কতজনের আছে? সর্বোপরি রাজ্য স্তরের শিক্ষা বোর্ডের গুরুত্ব কমিয়ে আনা হচ্ছে সর্বভারতীয় প্রবেশিকা অথবা চাকরি উভয় পরীক্ষার ক্ষেত্রে।
এটা কি অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে? এই ফর্মুলার পিছনে প্রকৃত লক্ষ্য কী? শিক্ষাব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে রাজ্যের হাত থেকে বের করে আনা? কিন্তু যত বেশি রাজ্যের হাতে শিক্ষাপ্রদানের অধিকার কমতে থাকবে, ততই গরিবের পক্ষে শিক্ষার মাধ্যমে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ কমবে।
উচ্চশিক্ষার সুযোগ শুধু নয়, যে কোনও কোর্সে ভর্তি হওয়ার পরিকাঠামো প্রধানত গ্রামীণ গরিবের কাছে নেই। শহুরে ছাত্রছাত্রী যে কোনও এক্সট্রা লার্নিং সেন্টার তাদের শহরে একাধিক পেয়ে যায়। গ্রাম সেটা পায় না। গ্রামের গরিব ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীর কাছে তাই রাজ্য সরকারের পরিচালিত স্কুল কলেজই একমাত্র ভরসা। আর্থিক সঙ্কট তো সবথেকে বড় প্রতিবন্ধকতা। করোনকালে অনলাইন ক্লাস করাই ছিল নিয়ম। কেমন ছিল গ্রামীণ ভারতের করোনাকালের পড়াশোনা? অ্যানুয়াল স্টেট অফ এডুকেশন রিপোর্ট ২০২০ সমীক্ষা অনুযায়ী জানা যাচ্ছে, গ্রামীণ ভারতের ৬৬ শতাংশ ছেলেমেয়ে ওই গোটা করোনাকালে স্কুল থেকে কোনও সাহায্য পায়নি। পড়াশোনা হয়নি। কেন? কারণ ঘরে একটাও স্মার্টফোন নেই!