গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
গত দু’বছর সেই বাৎসরিক প্রতিভার অনুসন্ধানে অনেকটাই ছেদ পড়ে গিয়েছে। মহামারীর আঘাতে অফলাইন পরীক্ষার দফারফা হতেই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ঘর থেকে উঠে আসা সেইসব আশ্চর্য লড়াইয়ের কাহিনিতেও কেমন যেন ভাটার টান। অনলাইন শিক্ষার বহুল প্রসারে যেমন স্কুলশিক্ষার ভূমিকা কমছে, তেমনি প্রত্যন্ত গ্রামের প্রতিভা অন্বেষণের কাজও ধাক্কা খাচ্ছে। সামাজিক দূরত্বের অজুহাতে অনলাইন শিক্ষার বাড়বাড়ন্ত ক্রমেই তাকে গ্রামের গরিব পরিবারের সন্তানের থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত দু’বছরে সারা দেশে ৫১ হাজার সরকারি স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সংখ্যাটা নিঃসন্দেহে বিরাট। বলাবাহুল্য, এর অধিকাংশই প্রত্যন্ত গ্রামের। আর এই স্কুল বন্ধের দৌড়েও ডবল ইঞ্জিন রাজ্যগুলি এগিয়ে। শুধু যোগীরাজ্যেই বন্ধ হয়েছে ২৬ হাজার স্কুল। আর মধ্যপ্রদেশে বন্ধ হয়েছে ২২ হাজার। সরকারি স্কুল বন্ধ করে শিক্ষার ঢালাও বেসরকারিকরণ ও অনলাইন আ্যাপ নির্ভর পড়াশোনার প্রবর্তন কি গ্রামের গরিব ঘরের সন্তানকে প্রথমেই এক হাজার মাইল পিছনে ফেলে দিচ্ছে না? প্রান্তিক যে মানুষটার ঘরে সামান্য উনুন জ্বালানোর লড়াই চলে সকাল থেকে সেই ঘরে কোনও রকমে একটা খাতা আর পেনের ব্যবস্থা হলেও অনলাইন শিক্ষার দামি হরেক কিসিমের সরঞ্জাম কেনা কি সোজা ব্যাপার। আগে তো ভাতের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামের একচিলতে বাড়িতে ছেলেমেয়ের জন্য আলাদা স্টাডি রুম ক’টা পরিবারে আছে। শহরেও খুঁজে পাওয়া কঠিন। সেখানে টেবিল চেয়ার, ল্যাপটপ, ওয়েবক্যাম, নিয়মিত ভালো ইন্টারনেট সংযোগ তো আকাশের চাঁদ ধরে আনার মতো ব্যাপার। ছোট একটা নোটবুক আর পেন-পেন্সিলের দিন যে শেষ তা তো এতদিনে কারও জানতে বাকি নেই। খাতা আর পেনের বিক্রিও কমছে হু হু করে। এখন জীবনটাই চলে শুধু এক ক্লিকে। পরীক্ষাও তথৈবচ। তাহলে প্রথমেই সমাজের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশকে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, বাপু, উচ্চশিক্ষা তোমার জন্য নয়। মোদি সরকারের জাতীয় শিক্ষা নীতিও সেই বিভাজনেরই অস্ত্র হিসেবেই কাজ করছে। তার উপর দোসর মহামারীর ধাক্কা। সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে দূরত্ব তৈরির মতোই আজ শিক্ষাও তাই বিভেদের গ্রাসে। তাহলে বারবার এই সরকারের কেষ্টবিষ্টুরা যে ‘ইনক্লুসিভ গ্রোথ’-এর কথা বলেন তা কি শুধু কথার কথা! গরিবকে দূরে সরিয়ে ভারতের সার্বিক উন্নয়ন যে এক অবাস্তব কল্পনা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমরা সবাই জানি, গত দু’বছরে অন্তত ১২ কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। হয়তো সংখ্যাটা বাস্তবে আরও অনেক বেশি। সব হিসেব সরকারের কাছে নথিভুক্ত হয় না। হলেও প্রকাশ করা হয় না। পাল্লা দিয়ে ব্যবসাও হারিয়েছেন বহু মানুষ। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। আর সংসারে রোজগার কমলে শিক্ষার উপরই প্রথম কোপটা পড়ে। আমাদের মতো দেশে এটাই দস্তুর। ছোট বয়সের ছেলেমেয়েকেও পড়তে না পাঠিয়ে কাজে লাগিয়ে দেওয়ার ঝোঁক বেড়েছে সেই তাগিদ থেকেই। বাড়ির সামনে আলু পটলের দোকান সাজিয়ে বসলে তো কিছু আসবে। এই চিন্তা থেকেই পড়াশোনা ব্রাত্য হয়ে গিয়েছে গরিব ঘরে। দীর্ঘদিন একটানা স্কুল কলেজ বন্ধ সেই প্রবণতায় দ্বিগুণ শক্তিশালী অনুঘটকের কাজ করেছে। এখন মহামারীর আঘাত কিছুটা কমলেও দেশের কয়েক কোটি ছেলেমেয়ে স্কুলের পড়াশোনার বাইরে চলে গিয়েছে দারিদ্র্যের তাড়নায়। কোভিডে কত পড়ুয়া অভিভাবক হারিয়েছে, তার হিসেব কে রাখে। তাদের এখন স্কুলে পাঠাবে কে? এই ব্যাপক ড্রপ আউট সমাজের পক্ষে নিঃসন্দেহে উদ্বেগের। অথচ আর পাঁচটা ব্যর্থতা নিয়ে নির্লিপ্ত থাকার মতোই কেন্দ্রীয় সরকারের মুখে কুলুপ। সরকার বাহাদুর এখন পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের হিসেব নিকেশে ব্যস্ত। গরিবের ঘরে পড়াশোনার আলো জ্বেলে তো আর চব্বিশে তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতা দখল নিশ্চিত হবে না। তাই সেই দিকে নজর নেই কারও।
কিন্তু এই সরকারি উদাসীনতার সুযোগেই শিক্ষা এক বৃহৎ ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত হচ্ছে। সামাজিক দায়বদ্ধতাকে শিখণ্ডি করে মুনাফার দৌড়ে আজ শামিল বৃহৎ কর্পোরেট জগৎ। তাকে ঘিরে ক্রমাগত দুষ্টচক্র গড়ে ওঠা এই কুনাট্যেরই অনিবার্য পরিণতি। স্কুলশিক্ষার উপর নির্ভরতা যত কমছে, ততই এই ব্যাপারটা প্রকট হচ্ছে। ব্যাপারটা এমন, যার টাকা আছে তার যেমন সাতমহলা বাড়ি, বিলাসবহুল গাড়ি আর পাঁচটা বিনোদন, আরাম কেনার সামর্থ্য আছে, তেমনি শিক্ষাকেও সে অনায়াসে রঙিন ব্যাগে করে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে ছেলেমেয়ের জন্য। শিক্ষা সেখানে নিতান্তই আর পাঁচটা পণ্যের মতো খোলা বাজারে বিকচ্ছে। প্রতিভার দাম দেওয়ার কেউ নেই।
কোভিডের পর স্কুল খুলে প্রথমে দেখা যায়, কিছু ছাত্রছাত্রী অক্ষর জ্ঞান পর্যন্ত হারিয়েছে। এবিসিডি পর্যন্ত চিনতে পারছে না অনেকে। সিলেবাসের সঙ্গে যোগ নেই এক বিরাট অংশের। স্মার্ট ফোনই যে গ্রামে পৌঁছয়নি, সেখানে স্কুল বন্ধ থাকার অর্থ একটা প্রজন্মকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা। অনলাইন ক্লাসের গালভরা প্রচার সেখানে প্রকাণ্ড ঠাট্টা মাত্র। আমরা নিরাপদে থাকা মানুষ নীরব দর্শক মাত্র। এর মিলিত ফল, এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষীর উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল।
আসলে দূর ও অনলাইন শিক্ষার জন্য আমাদের দেশ কতটা প্রস্তুত সেটা প্রথম দেখতে হবে। নাহলে যাঁদের সাধ্য আছে, মোটা টাকা দিয়ে প্রাইভেট টিউটর রেখে ক্যালকুলাস থেকে কম্পিউটার শিক্ষার সব বাড়িতে বসে আয়ত্ত করবে। আর প্রান্তিক মানুষ অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। রাজনৈতিক বিভাজনের মতোই আমরা শিক্ষাক্ষেত্রেও নতুন করে ধনী দরিদ্র পার্থক্য আরও বাড়ানোর পথে। সৌজন্যে ভারতের সবচেয়ে সাহসী নেতা নরেন্দ্র মোদি! মহাধুমধামে তাঁর সরকারের আট বছর পূর্তির ঢাক পেটানো শুরু হয়ে গিয়েছে। সাফল্যের দুশো ফিরিস্তির সেই উচ্চকিত উদযাপনে শিক্ষার এই সঙ্কট বিশেষ প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না।