রাজনীতিক ও পেশাদারদের ব্যস্ততা বাড়বে। বয়স্করা শরীর স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিন। ধনযোগ আছে। ... বিশদ
আজ ভারতের সার্বভৌমত্ব তিলে তিলে নিঃশেষিত হচ্ছে। এর জন্য বাইরের কোনও শক্তি দায়ী নয়। দায়ী দেশের ভিতরের রাজনৈতিক শক্তি। আজ প্রতি মুহূর্তে প্রমাণিত হচ্ছে, সেই শক্তি কতটা বিপজ্জনক। ভারতের সংবিধানে যে ঐক্যমন্ত্রের সুর আছে, শাসক শক্তিই সেটাকে প্রতি মুহূর্তে ভেঙে নতুন এক হিংসুটে ভারতের জন্ম দিচ্ছে। দেশের মানুষের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষ। তাকে বারবার শিখিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তুমি আসলে একজন ভারতীয় নও। প্রথমে তুমি একজন হিন্দু।
আর ওই যে তোমার প্রতিবেশী, ও একজন মুসলমান। ও আমাদের কেউ নয়, ও আমাদের শত্রু। ওকে ঘৃণা কর।
এই ঘৃণার বীজ আজ ক্রমেই ভারতের আত্মার গভীরে পৌঁছে যাচ্ছে, আর তার সংবিধানের ভিতকে দুর্বল করে দিচ্ছে। দেশের মানুষের স্বাধিকার রক্ষার পথে বাধা সৃষ্টি করে চলেছে এই দুষ্টু ভাবনা। তার মানবাধিকারকে খর্বও করছে। এই অপশাসনে তার জীবন পর্যুদস্ত। অথচ মহা আহ্লাদে সরকার সাধারণতন্ত্র দিবস পালন করার ভণ্ডামি করে চলেছে। এই সংবিধানকে এদেশের সরকার প্রতি মুহূর্তে তাদের কাজের মধ্য দিয়ে অস্বীকার করে চলেছে। তারা সংবিধানের শক্তিকে খর্ব করে নিজেদের তত্ত্বকে জোর করে প্রচার করতে চাইছে, যে তত্ত্ব ভারতের সনাতন ধ্যান-ধারণা ও চরিত্রের সঙ্গে মেলে না। এটা অবশ্য ঠিক যে, বিগত কংগ্রেস সরকারও দেশের সংবিধানকে সার্বিক অর্থে মানেনি। কিন্তু তাদের এভাবে স্বৈরতান্ত্রিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সংবিধানকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলার মানসিকতাও দেখা যায়নি। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার জমানা গণতন্ত্রকে বিপন্ন করলেও দেশকে আজকের শাসকদের মতো এতটা দুর্বল করে দেয়নি। আজকের শাসকের মুখে গণতন্ত্রের এক পেল্লায় মুখোশ, আড়ালে তার স্বৈরতন্ত্র হাসে। সংবিধানের রূপকার আম্বেদকর বলেছিলেন, ‘আমি সেই ধর্মই মানি, যা মানুষের মনকে মুক্ত করে, আলো দেখায় এবং অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে এবং সেই ধর্মের মানুষকে ভাই বলে বুকে টেনে নিতে শেখায়।’ আজ তাঁর তৈরি সংবিধান, তাঁর ভাবনা ও ধারণা ভুলুণ্ঠিত। আজ দেশটা উল্টোদিকে ছুটছে। সংবিধানের আত্মাকে জখম করে হিংসা-বিলাসে নেমেছে দেশের হিন্দুত্ববাদী শক্তি। তার মানে কিন্তু হিন্দুধর্মের মধ্যে হিংসা নেই। এই হিন্দুধর্মের মধ্য দিয়েই আমাদের দেশের সাধুসন্ত, মহাপুরুষরা প্রেম বিলিয়ে গিয়েছেন, মানুষকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। আদ্বিজ চণ্ডালকে বুকে আঁকড়ে ধরতে শিখিয়েছেন। কিন্তু আজকের রাজনীতির পাণ্ডারা, অ-সাধুরা সেই ছদ্ম-হিন্দুধর্মকে কেন্দ্র করে বিষবাষ্প ছড়াচ্ছেন। এর একমাত্র উদ্দেশ্য রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল। ধর্ম আজ কারবারিদের কাছে একটা অস্ত্র মাত্র। সেই অস্ত্রে লেগে রয়েছে স্বার্থের রক্ত আর ক্ষমতার বিষ লালা। তাই দেখা যায়, গেরুয়াধারী নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধেও চলছে খুনের মামলা।
সংবিধান রচনার পর একজন একবার আম্বেদকরকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার বিচারে সংবিধান কেমন হয়েছে মনে হয়?’ উত্তরে আম্বেদকর বলেছিলেন, ‘সেটা নির্ভর করবে প্রয়োগের উপর। কেউ ভালো কাজ করলে মনে হবে ভালো সংবিধান। খারাপ কাজ করলে তখন মনে হবে খারাপ সংবিধান।’ অর্থাৎ দুষ্টের যেমন ছলনার অভাব হয় না, তেমনই ব্যর্থ শাসকও ভালো সংবিধানের মধ্য দিয়ে তার বদ মানসিকতার প্রয়োগ ঘটাতে পারেন। এটা সব দেশে সব কালেই দেখা গিয়েছে। আমাদের দেশে ইদানীং মানুষ সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। বুঝতে পারছেন, মোদিজি কীভাবে দিনের পর দিন মুখে গণতন্ত্রের মুখোশ এঁটে একের পর এক স্বৈরতান্ত্রিক কাজের মধ্য দিয়ে দেশটাকে রসাতলে পাঠাচ্ছেন। একটা অস্থির, দুর্বল ভারত গড়ে তুলছেন। ক্রমশ স্লো পয়জনিংয়ের মতো দেশের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন সমস্যা, অভাব, দারিদ্র, হিংসা, ঘৃণা, পাপাচার। একের পর এক সমীক্ষায় মোদি শাসনের কুফল প্রকাশিত হয়ে চলেছে। এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, এদেশের গরিবের আয় কমে গিয়েছে ৫৩ শতাংশ। অর্থাৎ তাঁর যা আয় ছিল, মোদি জমানায় সেই আয় অর্ধেকেরও বেশি কমেছে। পাশাপাশি দেশের ধনী সম্প্রদায়ের আয় প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়েছে। সুতরাং এই স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের অপকর্মের ফলে কারা লাভবান হচ্ছেন, এটা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আজ সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। তার চাকরির নিশ্চয়তা নেই। মোদি জমানায় কোটি কোটি মানুষের চাকরি গিয়েছে। তার খাদ্য নিরাপত্তার শৃঙ্খল ভেঙে গিয়েছে। ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা ক্রমেই কমছে। কেননা মোদিজির আমলেই হয়েছে অর্থনীতির গঙ্গাযাত্রা। এখন তিনি গঙ্গায় ডুব দিয়ে নিজের কর্মের শোধন করতে চাইছেন ভাবলে ভুল হবে। ওটা একটা ড্রামা। কিন্তু বুঝছেন না যে, নিজেরই তৈরি এক কলুষিত গঙ্গায় ডুব দিলে পাপস্খালন হয় না।
দেখা যাচ্ছে, হঠাৎ করে এখন আবার তাঁদের নেতাজি-প্রেম উথলে উঠেছে। দেখাতে চাইছেন, তাঁদের মতো নেতাজি-প্রেমী এই দেশে জন্মাননি। একটা কথা মনে রাখা দরকার, নেহরু-গান্ধীর কংগ্রেসের থেকে সুভাষচন্দ্রের যে দূরত্ব ছিল, তার থেকে নেতাজির অনেক বেশি দূরত্ব ছিল নাথুরাম-সাভারকারদের সঙ্ঘ পরিবারের। নেতাজি সেদিন গান্ধী-জওহরলালকে যতটা চিনেছিলেন, ততটাই চিনেছিলেন সাভারকর, শ্যামাপ্রসাদদের। সেই উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তিকে নেতাজি ঘৃণা করতেন। সুতরাং আজ তাঁদের মুখে নেতাজির স্তুতি বেমানান। বুঝতে হবে, এই ভণ্ডামির কোনও উদ্দেশ্য আছে। সেদিন কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভা উভয় শক্তিই পিছন থেকে সুভাষচন্দ্রকে ছুরি মারার চেষ্টা করেছিল। আজ সেই কলঙ্কিত ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না। যখন নেতাজি আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে দেশের উত্তর-পূর্ব ভারত দিয়ে ঢুকে দেশকে স্বাধীন করার তীব্র লড়াই চালাচ্ছেন, তখন সাভারকররা তাঁকে পর্যুদস্ত করার জন্য ইংরেজদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সেনাশক্তি দিয়ে সাহায্যের কথা বলেছিলেন। সেই সাভারকরকে আপনারা দেশভক্ত বানান, কিন্তু তাঁকে নেতাজির মতো মহান মানুষের সঙ্গে একাসনে বসাবেন না। এ এক ভয়ানক পাপ।
এই দেশের এমনই দুর্ভাগ্য যে, তাঁদের হাতেই পালিত হচ্ছে দেশের সাধারণতন্ত্র দিবস, পালিত হবে স্বাধীনতার প্লাটিনাম জুবিলি। কোন দেশপ্রেম আজ ছড়িয়ে দিচ্ছে এই সরকার? আমাদের ছেলেবেলায় মানুষের মধ্যে যে দেশাত্মবোধ দেখেছি, তার সঙ্গে আজকের দেশাত্মবোধের কোনও মিল নেই। আজ দেখছি, দেশপ্রেম মানে দেশকে ভালোবাসা নয়। আজ নিজেকে আগমার্কা দেশপ্রেমিক প্রমাণ করতে গেলে শত্রুদেশকে ঘৃণা করতে হয়, দেশের মুসলিম নাগরিকদের দেশান্তরী করার কথা ভাবতে হয়, গোমাংস বহন করতে দেখলে তাকে পিটিয়ে খুন করতে হয়, বেনারস-হরিদ্বারে দেশের মুসলিমদের ঢোকার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করতে হয়। আজ বারবার খুঁজে দেখতে হয়, এঁরা কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন আম্বেদকরের সংবিধানকে!
আজ ভারতে যেটা মোদি শাসনে চলছে, সেটা স্বৈরতন্ত্র ছাড়া যে আর কিছুই নয়, তা সারা বিশ্ব জেনে গিয়েছে। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক সমীক্ষায় কার্যত স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে মোদির স্বৈরতান্ত্রিক ভূমিকার কথা। সেখানে বিভিন্ন দেশের সম্পর্কে নানা কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে এ দেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, এখন ভারতের সামনে সব থেকে বড় বিপদ পাঁচটি। অর্থনীতিক বিপন্নতার কথা তো বলা হয়েছেই, তাছাড়া বলা হয়েছে দেশের যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় মৌলবাদের বিষ ঢুকিয়ে দেওয়ার কথাও। এটা খুব সচেতনভাবেই করা
হয়েছে। তাদের সামনে শিক্ষা, কেরিয়ার, পরিবার রক্ষার থেকেও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে গোরক্ষা, মুসলিমদের শত্রু ভাবা। সরকার চাকরি দেবে কী! উল্টে মানুষের চাকরি খেয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা ইতিমধ্যে করে ফেলেছে। তাই ধর্মীয় বিদ্বেষের আফিমের নেশায় তরুণদের বুঁদ করে রাখার চেষ্টা হচ্ছে। তাই এত মন্দিরের আদিখ্যেতা, এত সুবিশাল মূর্তি তৈরির রাজনীতি।
আজকের ভারত প্রসঙ্গে এক অর্থনীতিবিদের কথা উদ্ধৃত করা যায়। এই সময় সেটা আমাদের দেশের পক্ষে সুপ্রযুক্ত। সেই অর্থনীতিবিদ বলেছেন, ‘গণতন্ত্রে চেল্লামেল্লি বেশি, সমস্যা কম। আর স্বৈরতন্ত্রে থাকে স্তব্ধতা, কিন্তু যন্ত্রণা থাকে অনেক বেশি।’ মোদিজির নীরবতা এবং আমাদের দৈনন্দিন যন্ত্রণা কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের সেই পর্দা ফাঁস করে দিয়েছে।