কর্মে অগ্রগতি ও নতুন কাজের বরাত প্রাপ্তি। আইটি কর্মীদের শুভ। মানসিক চঞ্চলতার জন্য বিদ্যাচর্চায় বাধা। ... বিশদ
জেলার নাম কুশীনগর। এখানে প্রায় ৪০ শতাংশ দলিতের বাস। সিরাজ আহমেদ উচ্চবর্ণের মুসলমান হয়ে একজন দলিতকে অপমান করবেন, এটা প্রশাসন মেনে নেয়নি। আবার উল্টো যুক্তি সাজালে, লীলাবতী দেবী গ্রামপ্রধান এবং একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি বলেই যোগী প্রশাসন এহেন পদক্ষেপ নিয়েছিল। এখানেই শেষ নয়... বিজেপি বিধায়ক বিজয় দুবে তাঁর বাড়ি পৌঁছে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আপনার রান্না খাব। দলিতদের প্রতি এই অনাচার বন্ধ হওয়া দরকার।’
এই হল বিজেপির খিচুড়ি রাজনীতি। আজকের নয়। দীর্ঘদিনের। বেগতিক দেখলেই ঢাক-ঢোল-মিডিয়া পিটিয়ে দলিত বাড়িতে পৌঁছে যাওয়া। নেতার পিছনে প্রচ্ছন্নে সেঁটে থাকা প্ল্যাকার্ড—ভোট চাই। কারণ, এই সব খিচুড়ি রাজনীতিই ভোটের সঙ্গে শেষ হয়ে যায়। আবার ঘটে দলিত-বঞ্চনা, হেনস্তা। এর উদাহরণ উত্তরপ্রদেশে ভূরি ভূরি। পিছড়ে বর্গের এই রাজনীতিকে হাতিয়ার করেই উঠে এসেছিলেন কাঁসিরাম। আর তারপর মায়াবতী। মায়া বুঝেছিলেন, মসনদের চৌকাঠে পা রাখতে হলে উচ্চবর্ণ এবং নিম্নবর্ণের মধ্যে আড়াআড়ি একটা লাইন টানতে হবে। দেখাতে হবে, উচ্চবর্ণের কর্তাব্যক্তিরা দলিতদের কীভাবে বঞ্চিত করে। বোঝাতে হবে, দলিত নেত্রীর সরকার ক্ষমতায় এলেই পিছড়ে বর্গের উন্নতি হবে। এই লড়াইয়ে তাঁর অন্যতম সেনাপতি কে ছিলেন? স্বামীপ্রসাদ মৌর্য। ১৯৯৬ সাল থেকে তিনি মায়াবতীর সঙ্গে। টানা বিশ বছর চলেছিল এই সফর। মায়ার ক্ষমতায় আসা, আইনি যুদ্ধ, রাজনীতির যুক্তি-তর্ক... সবেতেই সঙ্গ দিয়েছিলেন স্বামীপ্রসাদ। ২০১৬ পর্যন্ত। মায়াবতীর ডানহাত ছিলেন। উত্তরপ্রদেশের ভোট রাজনীতিতে নিজেকে নির্ণায়ক ফ্যাক্টর বলে দাবি করেন তিনি। অনেকটাই ঠিক। কারণ, কুশীনগরের পডরোনা থেকে শেষ তিনবার জিতেছেন স্বামী মৌর্য। প্রমাণ করেছেন, তাঁর কথা দলিত-ওবিসিরা শোনে। ২০১৭ সালে বিজেপির হয়ে গলা ফাটিয়েছিলেন তিনি। এবার বলবেন সমাজবাদী পার্টির হয়ে।
উত্তরপ্রদেশের ভোট রাজনীতি চলে দু’টি সমীকরণে। প্রথমটি, জাতপাত। উচ্চবর্ণ এবং দলিত সমীকরণ। যেমন এলাকা, যেমন নেতা, ঠিক তেমনই জোর আসে প্রচারে। প্রত্যেকের নিজস্ব এজেন্ডা আছে। সেই মতো এখানে প্রার্থী ঠিক হয়। সেই মতো ঝড় ওঠে প্রচারে। দ্বিতীয় সমীকরণ হল, হিন্দু-মুসলিম। বিজেপি দ্রুতগতিতে দেশজুড়ে এই সমীকরণকে প্রাথমিক করে তুলেছে। হিন্দুত্ববাদী সমাজ, গো-রক্ষক, ঘর ওয়াপসি, লাভ জেহাদ—একের পর এক শব্দবন্ধ বাজার মাত করেছে। আর শক্তিশালী হয়ে উঠেছে অন্ধ ভক্তরা। বিজেপি সাংসদ আর এক স্বামী... অর্থাৎ সুব্রহ্মণ্যম স্বামী বলেন, এবি এবং জিবি। এবি কথার অর্থ, অন্ধ ভক্ত। আর জিবি, গন্ধ ভক্ত (কেউ কেউ অবশ্য এর অন্য মানেও করেন)। যাই হোক, গত কয়েক বছরে এই শব্দবন্ধগুলোই ছিল বিজেপির ইউএসপি। ইউনিক সেলিং প্রপোজিশন। এগুলি ভাঙিয়েই বিজেপির ধর্ম ও ক্ষমতার ব্যবসা চলেছে রমরমিয়ে। এখন সময় বদলেছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদের ক্লিশে রং এবং একের পর এক কেন্দ্রীয় সরকারি ফ্লপ শো আজ হিন্দু-মুসলিম রাজনীতির সমীকরণকে ব্যাক বেঞ্চে ঠেলেছে। অখিলেশ এটাই চাইছিলেন। তাঁর পার্টির রাজনীতি হিন্দু-মুসলিম নয়। উত্তরপ্রদেশে তাঁর ভোটব্যাঙ্কের একটা বড় অংশ মুসলিম। অথচ, দলিত এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির ভোট নিশ্চিত করতে না পারলে ভাগ্যের সূর্যোদয় কিছুতে হবে না। উত্তরপ্রদেশে দলিত ভোট যদি ২১ শতাংশ হয়, ওবিসি ভোট তাহলে ৪৪ শতাংশ। তাই মোক্ষম চাল দিলেন তিনি। পরপর সাইকেলে চড়ে বসা কয়েকটি নাম... উল্লেখযোগ্য অবশ্যই স্বামীপ্রসাদ মৌর্য এবং দারা সিং চৌহান। যোগী আদিত্যনাথ দেখলেন, বড্ড বিপদ। কী করা যায়? চেনা অস্ত্র তো আছেই! চলো কোনও দলিত-বাড়ি। সেখানে ফটোগ্রাফার থাকবে। যোগী দাওয়ায় বসবেন দলিতের পাশে। একসঙ্গে খিচুড়ি খাবেন। আর সেই ছবি ছড়িয়ে যাবে ফেসবুক থেকে টুইটারে। কিন্তু যোগীজি ভুলে গিয়েছেন, এই অস্ত্রটাও এখন ভোঁতা হয়ে গিয়েছে। এই তো সেদিন ভোট গেল বাংলার। তার আগে আপনারই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বাঘা বাঘা সব নাম এসেছিলেন বাংলায়। এর বাড়ি, তার বাড়ি গিয়ে পাত পেড়ে বসে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভোটের শেষে ৭৭। অর্থাৎ, বাংলার ভোটে অমিত শাহ, জে পি নাড্ডাদের এই খিচুড়ি রাজনীতি মোটেও কাজে আসেনি। উত্তরপ্রদেশেও আসবে না। বাংলার ক্ষেত্রে ছিল কেন্দ্রের শাসক। তাও বাংলার মানুষ ডবল ইঞ্জিনের ধোঁকা খায়নি। আর উত্তরপ্রদেশ? এখানকার ভোটাররা তো বছরের পর বছর দেখছেন এই ফাঁকা কলসির অধিক বাজনা। মানুষ এখন আর বোকা নয়। তারা ধাপ্পাটা বোঝে। নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ বা জে পি নাড্ডারা যে এই সবই ‘পেটের দায়ে’ করছেন, তা বিলক্ষণ বোঝে মানুষ। তারা জানে, বছরের ৩৬৫ দিন ওই দাওয়ায় বসে, মোটা চালের খিচুড়ি খাওয়া তাঁদের পোষাবে না। তাঁরা ওই এক-দু’দিন আসবেন। লোক দেখাবেন। আর চলে যাবেন। এবার অমিত শাহ, যোগী আদিত্যনাথদের একটু ভাবতে হবে... অন্য প্ল্যানিং। খিচুড়ি খাওয়ার রাজনীতি দিয়ে উত্তরপ্রদেশ ধরে রাখতে পারবেন না তাঁরা। আর অমিত শাহ ৪০৩টি কেন্দ্রে প্রচারে গিয়েও লাভের লাভ কিছু হবে না। যোগী সরকারের ব্যর্থতার উদাহরণ চারদিকে ছড়িয়ে আছে। সেইগুলিকে সাফল্যে বদলে ফেলার মতো পি সি সরকার আর যেই হোক না কেন, অমিত শাহ নন। আর সত্যপাল মালিকের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন বুঝিয়েছে, সমস্যা বিদ্যমান। নরেন্দ্র মোদি এখন কার্যত গ্যালারি শোয়ে পরিণত হয়েছেন। তাই তিনি সত্যপাল মালিককে বলেছিলেন, এখন থেকে আপনি বরং আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। মালিক মহাশয় পরে এই মন্তব্য থেকে পিঠটান দিলেও বিতর্কের আগুন জিইয়ে রয়েছে। তাই অমিত শাহের কাজ ভীষণ কঠিন উত্তরপ্রদেশে। লাইন লেগেছে। বিজেপি ছেড়ে সমাজবাদী পার্টিতে যোগ দেওয়ার লাইন। নেতা-মন্ত্রীরা গন্ধ পাচ্ছেন। তাঁরা আন্দাজ করছেন, ক্ষমতার ব্যাটনের হাতবদল হতে চলেছে। বাংলার সঙ্গে আজ উত্তরপ্রদেশের ভীষণ মিল—সবার দম বন্ধ লাগছে। প্রতিদিন কোনও না কোনও নেতা, বিধায়ক বা এমএলএ শ্বাস নেওয়ার জন্য ছুট্টে চলে যাচ্ছেন সমাজবাদী ছাউনিতে। বলছেন, এই বাঁচলাম। বিজেপি সরকার কোনও কাজের নয়। তারা দলিতদের জন্য, অনগ্রসর শ্রেণির জন্য কিচ্ছুটি করেনি। ভবিষ্যতেও করবে না। তাই বিজেপি বর্জন করতে হবে। একের পর এক এমন ঘটনায় কোণঠাসা হচ্ছেন যোগী আদিত্যনাথ। তিনি সেই গোরক্ষপুর মঠের আশ্রয়ে ফিরছেন। আর শক্তিশালী হচ্ছে বিরোধী শিবির।
বিজেপির রাজনীতি? সে এখন বাস্তবিকই খিচুড়িতে পরিণত। যেখান থেকে যা পাওয়া যাচ্ছে, সেটাই এক্সপেরিমেন্ট করে দেখা। হিন্দু-মুসলিম চলবে, জাতপাত বা দলিত রাজনীতিও চলবে। সঙ্গে থাকবে কিছুটা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে খোঁচাখুঁচি, কিছুটা সিএএ, বাকিটা মহামারী ও ভ্যাকসিন। আর অখিলেশ? খুব অঙ্কে কষে এগিয়েছেন যাদব কুলপতি। দলের যেখানে যেখানে ফাঁক রয়েছে, দ্রুত ভরাট করছেন তিনি। কাকার সঙ্গে রাজনৈতিক সমস্যাও মেটাচ্ছেন। অথচ, আলপটকা মন্তব্য করে বিজেপির হাতে অস্ত্র কিছুতেই তুলে দিচ্ছেন না। কারণ, তামাম দেশবাসীর মতো তিনিও জানেন, উত্তরপ্রদেশ যার, দিল্লি তার। আসন্ন ভোটে যে পার্টি ক্ষমতায় আসবে, দু’বছর পর লোকসভা ভোটের পাল্লাও ঝুঁকবে তার দিকে। বাকি রইল কংগ্রেস! নেতৃত্বহীনতার অভিশাপে ধুঁকতে থাকা একটা দলকে সঙ্গে নিলে লাভের লাভ তো কিছু হবেই না, মাঝখান থেকে বেশি কিছু আসন হাতছাড়া হবে। তার থেকে একা লড়ে নেওয়াই ভালো। যা থাকবে, সেটাই নিজস্ব। তাতে কারও ভাগ থাকবে না। অনধিকার চর্চাও নয়। সমাজবাদী পার্টির এবার মসনদ দখল মানে একটা বিষয় জলের মতো স্পষ্ট হয়ে যাবে—বিজেপিতে আর ভক্তি, শ্রদ্ধা বা আস্থা, কোনওটাই নেই। বরং আঞ্চলিক শক্তিগুলির যুগ ফের শুরু হতে চলেছে। এর প্রভাব লোকসভা ভোটে পড়বেই।
খেলা শুরু হয়েছে উত্তরপ্রদেশে। যোগী সাবধান!