রাজনীতিক ও পেশাদারদের ব্যস্ততা বাড়বে। বয়স্করা শরীর স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিন। ধনযোগ আছে। ... বিশদ
বাবা বিশ্বনাথ দত্তের রসুইখানার বাবুর্চিও ছিলেন মুসলিম। শ্রীরামকৃষ্ণও জানতেন, তাঁর প্রিয় শিষ্যের খাদ্যতালিকা থেকে মুরগি-পাঁঠা-মাছ-পোলাও কিচ্ছু বাদ যায় না। খাওয়াদাওয়ায় যে জাতপাতের ভাগাভাগি, তা ভেঙে দেওয়াই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। তিনি লিখেছেন, ‘যাঁর উদ্দেশ্য কেবল মাত্র ধর্মজীবন, তাঁর পক্ষে নিরামিষ, আর যাকে খেটে খুটে... জীবনতরি চালাতে হবে তাকে মাংস খেতে হবে বৈ কি।’ একবার এক শিষ্য নরেনের নামে নালিশ জানান রামকৃষ্ণকে। জবাবে ঠাকুর বলেন, ‘খেয়েছে বেশ করেছে। তুই যদি হবিষ্যিও খাস আর নরেন যদি হোটেলে খায়, তাহলেও তুই নরেনের সমান হতে পারবি না।’ ঠাকুর নিজে অবশ্য সাত্ত্বিক আহার করতেন। মাছ–মাংস ছুঁয়েও দেখতেন না।
সে সময়টা ছিল আষাঢ় মাস। বৃষ্টির দমকে গঙ্গার উপরে কুয়াশার মতো মায়া। বেলুড় আশ্রমের ঘর থেকে দেখা যায় শত শত মাছ ধরার নৌকো। স্বামীজি তাকিয়ে দেখছেন জেলেদের ইলিশ ধরার আনন্দ। সে বার একটা প্রমাণ মাপের গঙ্গার ইলিশ কেনা হল। সেই মাছ দেখে স্বামীজি তো শিশুর মতো হয়ে গেলেন। পূর্ববঙ্গীয় শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে ডেকে বললেন, ‘তোরা নতুন ইলিশ পেলে নাকি পূজা করিস, কি দিয়ে পূজা করতে হয় কর।’ স্বামী প্রেমানন্দ লিখেছেন, ‘...আহারের সময় অতি তৃপ্তির সহিত সেই ইলিশ মাছের ঝোল, অম্বল, ভাজা দিয়া ভোজন করিলেন।’ দ্বিপ্রাহরিক সেই তৃপ্ত ভোজন ছিল স্বামী বিবেকানন্দের অন্তিম আহার।
আক্ষরিক অর্থেই তিনি এক ছকভাঙা সন্ন্যাসী। সন্ন্যাসী ও গৃহী, উভয়ের জন্যই ছিল তাঁর কর্মযোগ। দেশ যখন শ্মশানপ্রায় তখন সন্ন্যাসীর মোক্ষবাসনা অনুচিত বলেই মনে করেন তিনি। সন্ন্যাসীর ধ্যানে নয়, দেশ ও সমাজের জন্য অবিরাম নিষ্কাম কর্মেই ভারত জেগে উঠবে, একথা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন এই স্বদেশপ্রেমিক সন্ন্যাসী। বিবেকানন্দের গুরুভাইরা এই কাজের দায়িত্ব হাসিমুখেই নিয়েছিলেন। দেশের মানুষকে শিক্ষা-স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করেছেন, অনাথ আশ্রম চালিয়েছেন, মহামারী দেখা দিলে পথে নেমেছেন। সে এক অন্য রকম সন্ন্যাসজীবন। স্বামীজি বুঝেছিলেন ‘ধর্ম’কে বনে আর পরমার্থে আটকে রাখলে চলবে না। শত শত বুদ্ধের কারুণ্য-নিষিক্ত হৃদয়বান মানুষই ছিল তাঁর কাঙ্ক্ষিত। অজ্ঞ, কাতর, পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কাজে, তাদের স্বমহিমায় উদ্ভাসিত করার লক্ষ্যে তিনি ছিলেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাই তাঁর ধর্ম-দর্শন-অধ্যাত্মচিন্তার সবটাই জুড়ে আছে মানুষের কথা।
বিবেকানন্দ লিখেছিলেন, ‘অতীতে যত ধর্মসম্প্রদায় ছিল, আমি সবগুলিই সত্য বলিয়া মানি এবং তাহাদের সকলের সহিতই উপাসনায় যোগদান করি। প্রত্যেক সম্প্রদায় যেভাবে ঈশ্বরের আরাধনা করে, আমি তাহাদের প্রত্যেকের সহিত ঠিক সেই ভাবে তাঁহার আরাধনা করি। আমি মুসলমানদিগের মসজিদে যাইব, খ্রিস্টানদিগের গির্জায় প্রবেশ করিয়া ক্রুশবিদ্ধ ঈশার সম্মুখে নতজানু হইব, বৌদ্ধদিগের বিহারে প্রবেশ করিয়া বুদ্ধের ও তাঁহার ধর্মের শরণ লইব, এবং অরণ্যে গমন করিয়া সেই–সব হিন্দুর পার্শ্বে ধ্যানে মগ্ন হইব, যাঁহারা সকলের হৃদয়–কন্দর–উদ্ভাষণকারী জ্যোতির দর্শনে সচেষ্ট।’ শিষ্যদের সবসময় বলতেন, হিন্দুরা সব ধর্মের মানুষকে শ্রদ্ধা করেন, হিন্দুত্ববাদীরা অহিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন। একটি প্রীতির কথা বলে, অন্যটি ঘৃণার কথা। হিন্দুধর্ম বনাম রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদ, কিংবা ইসলাম বনাম রাজনৈতিক ইসলামের দ্বৈততাটি না বুঝিলে ভারতের মতো দেশে পদে পদে সঙ্কট...।
যার সার কথা, হিন্দুত্ববাদ ক্ষমতালোভীদের কারবার, এর সঙ্গে ধর্মের সংযোগ বড়ই ক্ষীণ। আসলে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের বিকারগ্রস্ত একটা দিক আছে। যেখান থেকে হিন্দু মহাসভা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং বিজেপির উৎপত্তি। এদের কাজ হল বিবেকানন্দের মতো এক ব্যক্তিত্বের উদার শব্দগুলি নিজের মতো করে ব্যবহার করা। তাদেরই দরকার পড়ে বিবেকানন্দের হিন্দুবোধকে নিজের প্রয়োজনে আত্মসাৎ করার। এ এক ভয়ঙ্কর হন্তারক সময়, যেখানে জাতি, জাতীয়তাবাদ এবং সংস্কৃতি এক দল রাজনীতিকের ব্যক্তি ব্যবহারের যান্ত্রিকতায় পরিণত হয়েছে।
স্বামীজি বলেছিলেন, ‘আমরা মানবজাতিকে সেই স্থানে লইয়া যাইতে চাই-যেখানে বেদও নাই, বাইবেলও নাই, কোরানও নাই অথচ বেদ, বাইবেল ও কোরানের সমন্বয় দ্বারাই ইহা করিতে হইবে। মানবকে শিখাইতে হইবে যে, সকল ধর্ম ‘একত্বরূপ সেই এক ধর্মে’রই বিবিধ প্রকাশ মাত্র, সুতরাং যাহার যেটি সর্বাপেক্ষা উপযোগী সেটিকেই বাছিয়া লইতে পারে।’ আর মন্দির প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘কোটি টাকা খরচা করে, কাশী-বৃন্দাবনের ঠাকুর ঘরের দরজা খুলছে আর পড়ছে। এই ঠাকুর কাপড় ছাড়ছেন তো ওই ঠাকুর ভাত খাচ্ছেন তো ঠাকুর আঁটকুড়ির ব্যাটাদের গুষ্টির পিণ্ডি করছেন। এদিকে আসল জ্যান্ত ঠাকুর অন্ন বিনা, বস্ত্র বিনা মরছে।’ বিবেকানন্দ বলছেন, ‘সো লং অ্যাজ ইভন আ সিঙ্গল ডগ ইন মাই কান্ট্রি হ্যাজ নো ফুড, মাই হোল রিলিজিয়ন উইল বি টু ফিড দেম।’ এই বিবেকানন্দকে সম্ভবত নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহদের খুব অচেনা লাগছে। এই স্বামীজির সঙ্গে বর্তমানে ধর্মের ধ্বজাধারীদের দূরত্ব বেশ কয়েক যোজন। তাই এ দেশে এখন ভোট এলেই ধর্মের বাড়বাড়ন্ত হয়। ভোট এলেই কোনটি হিন্দু সভ্যতা, আর কোনটি বর্বর অহিন্দু, তার তালিকা পেশ করা শুরু হয়। প্রতিযোগিতামূলক গণতন্ত্রের মঞ্চে হয়তো এটাই অবশ্যম্ভাবী— যেখানে গণতন্ত্র মানে ভোট, ভোট মানে সংখ্যার খেলা, সংখ্যা মানে সংখ্যাগুরুর আবেগ, আর আবেগ উস্কে দেওয়ার সোজা রাস্তা ধর্মের ধুয়ো।
তাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বারাণসীতে গিয়ে মন্দির প্রসঙ্গে ঔরঙ্গজেবকে স্মরণ করতে হয়, এবং ঔরঙ্গজেব প্রসঙ্গে শিবাজিকে টেনে আনেন। গঙ্গাস্নানে জপের মালা হাতে কোমর-সমান জলে দাঁড়িয়ে পোজ দিতে হয়। সেই ছবি আলোকচিত্রের দৌলতে দেশের সর্বত্র ভাইরাল হয়। উত্তরপ্রদেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে হিন্দুত্ববাদী কার্যক্রমের পারদ-উচ্চতা, মন্দির নির্মাণ কিংবা প্রসারণের প্রতিশ্রুতি বর্ষণ, সাধুসন্ন্যাসীদের অতিসক্রিয়তা! ধর্মকে হাতিয়ার করে বিজেপি রাম মন্দির, কাশী-মথুরায় মন্দির তৈরি, তাজমহল ভেঙে শিবমন্দির তৈরির জিগির তোলে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ভোটকে সংহত করার উদ্দেশ্যে। দেশ ও রাজ্যের মানুষের সমস্যা— দারিদ্র, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের সমস্যা, পানীয় জল, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষের নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে কোনও বক্তব্য নেই বিজেপি নেতৃত্বের। বস্তুত বিজেপির সাধারণ মানুষকে সাম্প্রদায়িকতা ছাড়া, অর্থনীতি এবং রাজনীতিগতভাবে দেওয়ার মতো কিছু নেই। পরিষ্কার বোঝা যায়, সামনেই উত্তরপ্রদেশের ভোট! ধর্মের আফিম খাইয়ে জিততেই হবে। আমরা অবাক হয়ে যাই— ভারতের চেহারা সুস্থতার দিকে, না কি অসুস্থতার দিকে— কোন দিকে এগচ্ছে? সাধারণ মানুষ ধর্মীয় মাদক-জড়িবুটি কত দিন ধরে সেবন করে যাবেন? এই শিক্ষা অন্তত বিবেকানন্দের নয়...।
স্বামীজি এই সমস্যা প্রসঙ্গে আগেই সতর্ক করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘ধর্মের সংহতি-স্থাপনই ভবিষ্যৎ ভারত গড়িবার প্রথম সোপান। সেই মূল ঐক্যের দিকে লক্ষ্য রাখিয়া নিজেদের এবং জাতির কল্যাণের জন্য পরস্পরের সর্ববিধ মতভেদ ও অকিঞ্চিৎকর কলহ আমাদের বর্জন করিবার সময় আসিয়াছে। বহু দিকে বিকীর্ণ আধ্যাত্মিক শক্তিসমূহের সম্মিলন দ্বারাই ভারতে জাতীয় ঐক্যের প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে।’ বিবেকানন্দ কথিত এই ধর্মের সঙ্গে প্রচলিত সম্প্রদায়গত ধর্মের কোনও যোগ নেই। যোগ একমাত্র হৃদয়ে। অনেকেই আবার বিবেকানন্দের এই ‘জাতি’ শব্দটিকে সঙ্কীর্ণ অর্থে ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু তিনি নিজেই বলেছেন, ‘অন্যান্য দেশের সমস্যাসমূহ অপেক্ষা এদেশের সমস্যা জটিলতর, গুরুতর। জাতির অবান্তর বিভাগ, ধর্ম, ভাষা, শাসনপ্রণালী—এই সমুদয় লইয়াই একটি জাতি গঠিত।’
এই বিবেকানন্দই বলছেন, ‘আমার যদি একটা সন্তান থাকত, তাকে মনঃসংযোগের অভ্যাস এবং সেই সঙ্গে এক পংক্তির প্রার্থনা ছাড়া আর কোনও প্রকার ধর্মের কথা আমি শিখতে দিতাম না। তার পর সে বড় হয়ে খ্রিস্ট, বুদ্ধ বা মহম্মদ যাকে ইচ্ছা উপাসনা করতে পারবে। সুতরাং এটা খুবই স্বাভাবিক যে একই সঙ্গে সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে এবং নির্বিরোধে আমার ছেলে বৌদ্ধ, আমার স্ত্রী খ্রিস্টান এবং আমি নিজে মুসলমান হতে পারি।’
বিবেকানন্দ বুঝেছিলেন যে, দেবতা আকাশ থেকে নামেন না বা মাটি ফুঁড়েও ওঠেন না। বিবেকানন্দ চান জীবন্ত মানুষের পুজো। শিষ্যবর্গ এবং সতীর্থদের প্রতি তাঁর নির্দেশ, ‘মানুষের জন্য কাজ করে করে তোরা শেষ হয়ে যা, এটাই আমার আশীর্বাদ।’ বিশ্ববিজয় করে দেশে ফেরার পর একদিন সশিষ্য খুব শাস্ত্রচর্চা হচ্ছে, নাট্যকার গিরিশ ঘোষ বললেন, ‘বেদবেদান্ত তো ঢের পড়লে, এই যে দেশে ঘোর হাহাকার, অন্নাভাব... এর উপায় তোমার বেদে কিছু বলেছে?... এককালে যার বাড়িতে রোজ পঞ্চাশখানি পাতা পড়ত, সে আজ তিন দিন হাঁড়ি চাপায়নি— এ সকল রহিত করবার কোন উপায় বেদে আছে কি?’ নির্বাক বিবেকানন্দের চোখে জল। শাস্ত্রচর্চার আড্ডা ছেড়ে উঠে চলে গিয়েছিলেন। পিছন থেকে গিরিশচন্দ্র চেঁচিয়ে বলেছিলেন, ‘তোর স্বামীজিকে কেবল বেদজ্ঞ পণ্ডিত বলে মানি না। কিন্তু ওই যে জীবের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল, এই মহাপ্রাণতার জন্য মানি।’ এটাই বিবেকানন্দের বীক্ষা। তাঁর ধর্ম-দর্শন-অধ্যাত্মচিন্তার সবটাই জুড়ে আছে মানুষের কথা।
সেই দর্শনের সঙ্গে মোদিজির গেরুয়া শিবিরের ভাবনার আকাশ-পাতাল ফারাক। সংকীর্ণ হিন্দুত্ব তাঁকে দলে টানার চেষ্টা করলে বিপদে পড়বে!