কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
আর মাত্র ২৪ ঘণ্টার অপেক্ষা। তারপরই জানা যাবে আগরতলা সহ ত্রিপুরার বিভিন্ন পুরসভা ও নগর পরিষদের ২২২টি আসনের ফলাফল। পুরসভা নির্বাচনটা মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব এর জন্য ছিল রাজনীতির ‘ইউনিট টেস্ট’। সিলেবাস অতি সামান্য। প্রশ্নও জানা। তার উপর হোম সেন্টারে বসে পরীক্ষা। গার্ডও ঘরের লোক। তাই বিপ্লববাবুর দল পরিস্থিতির পুরো সুযোগ নিয়েছে।
ভোটের আগের রাতে বিরোধীদের তো বটেই, বিক্ষুব্ধ বিজেপি বিধায়ক সুদীপ রায়বর্মনের অনুগামীদের বাড়িতে গিয়েও পাইকারি হারে চমকানো হয়েছে। জারি করা হয়েছিল, ভোট দিতে না যাওয়ার ফতোয়া। তারপরেও যাঁরা সুপ্রিম কোর্টের ভরসায় বৃহস্পতিবার ভোট দিতে বেরিয়েছিলেন তাঁদের বেশিরভাগই বুথ পর্যন্ত যেতে পারেননি। বুথে যাওয়ার আগেই ধমকে বাড়ি পাঠিয়েছে। আর যাঁরা অবাধ্য হয়েছিলেন তাঁদের পিটিয়ে পাঠানো হয়েছে হাসপাতালে। শুধু সাধারণ ভোটার নয়, ভোট দিতে যাওয়ায় ফেলে পেটানো হয়েছে তৃণমূল প্রার্থীকেও।
বিজেপির নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার লোভের আগুন থেকে রেহাই পায়নি কেউই। সাতসকালে শুরু হয়ে যায় সিপিএমের ক্যাম্প অফিস ভাঙচুর, তৃণমূল প্রার্থীর মুখ ফাটিয়ে দেওয়া, প্রার্থীর ছেলেকে মারধর। সময় যত গড়িয়েছে মেরে বুথ থেকে এজেন্ট বের করা, ছাপ্পা, রিগিং, সন্ত্রাসের অভিযোগ ততই লম্বা হয়েছে। সুতরাং ‘ইউনিট টেস্টে’ বিপ্লববাবুর দলের ফুল মার্কস একপ্রকার নিশ্চিত। এরপরেও আগরতলার ৫১টি আসনই বিজেপি যদি না পায় তাহলে বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারটা বিপ্লব দেবের জন্য হয়ে যাবে অনিশ্চিত। অনেকে বলছেন, অপসারণের আশঙ্কা থেকেই বিপ্লববাবুর অনুগামীরা পুরভোটে অলআউট খেলেছেন।
দেবাংশু ভট্টাচার্য, জয়া দত্তদের দিয়ে ত্রিপুরায় তৃণমূলের জমি তৈরির কাজ শুরু। তারপর সুস্মিতা দেব, সায়নী ঘোষরা। মাঝে বার তিনেক গিয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাতেই বিপর্যয়ের আশঙ্কায় থরহরি কম্প ত্রিপুরা বিজেপি। তাও এখনও পা রাখেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাতেই পরাজয়ের ভূত তাড়া করেছে গোটা গেরুয়া শিবিরকে।
বিজেপি বিধায়ক অরুণচন্দ্র ভৌমিকের ভাষণে মিলেছে তারই ইঙ্গিত। অরুণবাবুর নিদান, ‘তৃণমূল কংগ্রেস দেখলেই তাড়া করুন। আপনাদের জন্য আমি করি। আমার জন্যও আপনাদের করতে হবে।’ কোনও গোপন বৈঠকে নয়, একেবারে প্রকাশ্যে। দলের মস্তান বাহিনীর কাছে একজন প্রবীণ বিধায়কের এমন আবদার! ভাবা যায়?
সমঝদারোকে লিয়ে ইশারাই কাফি হ্যায়। অরুণবাবু যখন এসব বলছিলেন তখন মঞ্চে ছিলেন স্বয়ং বিপ্লব দেব। তাই বিজেপি কর্মীদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি, নির্দেশটা আসলে কার! অতএব যতই মারো, যতই গুলি চালাও পুলিস টিকি ছোঁবে না। ক্রিকেটের পরিভাষায় যাকে বলে, ফ্রি হিট। তার পরিণতি? ত্রিপুরার পুরভোটে মাত্রা ছাড়িয়েছে সন্ত্রাস। সুপ্রিম কোর্টের শান্তিপূর্ণ ভোট করানোর নির্দেশ সত্ত্বেও রক্ত ঝরেছে ত্রিপুরায়।
সিপিএমের পার্টি অফিসে ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দিয়ে ত্রিপুরায় বামেদের আগেই কোণঠাসা করে ফেলেছে বিজেপি। তবুও মানিক সরকারের জন্য বামেরা লড়াইয়ে আছে। তা সত্ত্বেও বিজেপি বুঝেছে, ২০২৩ সালে তৃণমূলই হবে মাথাব্যথার কারণ। সিপিএমের অতীত দেখিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা গেলেও তৃণমূলকে দমানো কঠিন। সেটা চার মাসেই বুঝে গিয়েছে বিজেপি। তাই পুরভোটে তৃণমূলকেই দুরমুশ করেছে বেশি।
‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার। কেন্দ্রীয় বাহিনী বা কমিশনের কোনও ভয় নেই। তাই বিরোধীদের পাত্তা দেওয়া তো দূরের কথা, তাদের শায়েস্তা করাই বিপ্লববাবুর পুলিসের লক্ষ্য। সেই জন্য গাড়ির মধ্যে বসে ‘খেলা হবে’ বলায় সায়নী ঘোষকে ‘খুনের চেষ্টার’ অভিযোগে গ্রেপ্তার করতেও পুলিসের হাত কাঁপেনি। একজন অল্পবয়সি মহিলা নেত্রীকে সারা রাত থানায় আটকে রেখে বিপ্লব দেবের পুলিস প্রমাণ করে দিয়েছে, ত্রিপুরা আছে ত্রিপুরাতেই।
পুরসভা নির্বাচনের ৪৮ ঘণ্টা আগে বিজেপির দুই বিধায়ক সুদীপ রায়বর্মন ও আশিস সাহা নির্বাচনে গন্ডগোলের আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। ত্রিপুরায় সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবকে কাঠগড়ায় তুলেছিলেন। তাঁর সাফ কথা, উন্নয়ন হলে মারধরের দরকার হতো না। ভোট দিতে না যাওয়ার জন্য হুমকি দিতে হতো না। নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে ত্রিপুরার বুকে এমন সংস্কৃতি আমদানি করছেন ‘প্যারাট্রুপড লিডার’ (পড়ুন বিপ্লব দেব)। সিপিএমের কিছু লোক জার্সি বদলে বিজেপি হয়েছে। তারাই ত্রিপুরার পুরভোটকে প্রহসনে পরিণত করছে।
সুদীপবাবুর আশঙ্কা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের কড়া নির্দেশ সত্ত্বেও ত্রিপুরার পুরভোট শান্তিপূর্ণ হয়নি। ভোটের দিনে অশান্তি শুরু হতেই আরও দু’কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী নামানোর নির্দেশ প্রমাণ করেছে, বিপ্লব দেবের পুলিস পুরোপুরি ব্যর্থ।
বিজেপিতে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। এমনকী কোন্দল থামাতে কয়েকটি রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত বদল করতে হয়েছে। তবে, যে সব রাজ্যে স্রেফ হাওয়া ও ভাষণের জোরে বিজেপি ক্ষমতা দখল করেছে, সেখানে দ্বন্দ্ব চরম। ত্রিপুরা তারই একটা। এখানে বিপ্লব দেবের আর সুদীপ রায়বর্মনের সম্পর্ক সাপে নেউলের চেয়েও খারাপ। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বারবার চেষ্টা করেও মেটাতে পারেনি। উল্টে লড়াই তীব্র হয়েছে। পুরভোটের প্রচারের শেষদিনে সুদীপবাবু সাংবাদিক সম্মেলন করে বিপ্লববাবুকে ধুইয়ে কাপড় পরিয়ে দিয়েছেন। তারপরেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপই নেয়নি বিজেপি।
তার কিছুক্ষণের মধ্যেই ত্রিপুরা বিজেপির মুখপাত্র সুব্রত চক্রবর্তী পাল্টা সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। সেখানে তিনি সুদীপবাবুর তোলা সমস্ত অভিযোগ নস্যাৎ করলেও তাঁকে ঘাঁটানোর সাহস দেখাননি।
সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী বা শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দলের কেউ তোপ দাগলে তাঁর বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়াটাই দস্তুর। বিজেপির হাওড়া সদর সাংগঠনিক জেলা সভাপতির ক্ষেত্রে তেমনটাই দেখা গিয়েছে। বিরোধী দলনেতার সমালোচনা করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। কিন্তু সুদীপবাবুর ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটল না। কারণ বিজেপি নেতৃত্ব স্টেপ নিতে ভয় পাচ্ছে। সিপিএম বিরোধী ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা দখল করলেও ত্রিপুরায় বিজেপির মাটি এখনও জমাট বাঁধেনি। উল্টে প্রায় কোনও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে না পারায় ত্রিপুরায় বিজেপি কাযর্ত বারুদের স্তূপের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই অবস্থায় বিদ্রোহীদের শাস্তি না দিয়ে তোয়াজ করার রাস্তায় কি বিজেপি হাঁটতে চাইছে?
ত্রিপুরায় যদি কেবল সিপিএম বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকত তাহলে বিজেপি নেতৃত্ব সুদীপবাবুকে কিছুতেই রেয়াত করত না। কিন্তু বঙ্গ জয়ের পর তৃণমূল ত্রিপুরায় পা রাখতেই বদলে গিয়েছে রাজনৈতিক সমীকরণ। বাংলায় হ্যাটট্রিক করার পর মমতাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে জাতীয় রাজনীতি। বিভিন্ন রাজ্যের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা মোদি বিরোধী লড়াইয়ে তাঁর সঙ্গী ও সহযোদ্ধা হতে চাইছেন। বিজেপি শাসিত ত্রিপুরাতেও সেই একই প্রবণতা। সেখানে শাসক দলের বিধায়ক যোগ দিচ্ছেন তৃণমূলে। কারণ সম্ভাবনা জাগিয়েছে তৃণমূল।
এই পরিস্থিতিতে বিজেপির দুই বিধায়কের বিদ্রোহ গেরুয়া শিবিরে নতুন সঙ্কট তৈরি করেছে। বিক্ষুব্ধদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই চলে যাবে তৃণমূলে। আবার স্টেপ না নিলে বিপ্লব দেবের অনুগামীরা ছেড়ে কথা বলবে না। তাই পুরসভা ভোটের ফলের নয়, চর্চার বিষয় হয়েছে বিজেপি বিধায়কদের বিদ্রোহ। অনেকেই বলছেন, ত্রিপুরায় তৃণমূলকে শূন্য প্রমাণের জন্য পুরভোটে লাগামছাড়া সন্ত্রাস করে বিজেপি নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল মারল। ২০২৩ সালে আর ইউনিট টেস্ট নয়, বিপ্লব দেবকে বসতে হবে বোর্ডের পরীক্ষায়। পরীক্ষকের নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। টুকলি করে তাঁর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় না। সেটা বাংলায় পরীক্ষা দিতে এসে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন মোদি-অমিত শাহ জুটি। বুঝবেন বিপ্লব দেবও।