কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
রাষ্ট্র ও শাসক আজকের এই অবিশ্বাস্য টেকনোলজি, স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন আর ইনফরমেশন বিস্ফোরণের যুগে পুরনো সব প্রথাকে অতীত ও পরিত্যাজ্য হিসেবে তাচ্ছিল্য করেছিল। ভেবেছিল, আমরা যদি পাত্তা না দিই, আমরা যদি গুরুত্ব না দিই, আমরা যদি অগ্রাহ্য করি, তাহলেই একদিন এই রাস্তায় বসে থাকা কৃষকের দল নিজেরাই চলে যাবে মাথা নিচু করে। আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল অবাধ অপপ্রচার, অসম্মান, অপমান। কৃষকদের বলা হয়েছিল অ্যান্টি ন্যাশনাল। খলিস্তানি। আন্দোলনজীবী। কৃষি আইন খুব ভালো। একথা রাষ্ট্র বলেছিল। প্রচার করেছিল। কিন্তু তার থেকে বেশি সেই রাষ্ট্র ও শাসকদের পাশে দাঁড়িয়েছিল নাগরিক সমাজের বিপুল অংশ। তারাও দোহারের মতো বলে গিয়েছে অবিরত যে, হ্যাঁ, কৃষি আইন ভালো। কৃষকদের নিয়ে হাসাহাসি হয়েছে। কেন? কারণ তাদের মধ্যে শিক্ষিত ইংরেজি জানা যুবক যুবতীদের দেখা গিয়েছে পিৎজা খেতে আন্দোলনস্থলে। অর্থাৎ কৃষকদের পিৎজা খাওয়া বারণ। ইংরেজি জানা বারণ। রাষ্ট্র ও তার এই অনুগামীদের প্রবল এক ঝাঁকুনি দিলেন কৃষকরা।
রাষ্ট্র এটা দেখতে পায়নি যে, দিল্লির সীমানায় রোদে ঝড়ে বৃষ্টিতে, শীতে খোলা আকাশের নীচে বসে এক বৃদ্ধ জানুয়ারির অপরাহ্নে জোরে জোরে পড়ছিলেন জন রিডের বিখ্যাত বই ‘দুনিয়া কাঁপানো দশদিন’। গুরমুখী ভাষায় অনুবাদ। আর তাঁকে ঘিরে একঝাঁক সাধারণ কৃষক শুনছেন সেই কাহিনি। রাষ্ট্র অবজ্ঞা করেছে তাঁদের, আন্দোলনস্থলের মাদুরে শুয়ে যাঁদের হাতে হাতে ঘুরেছে রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’। কৃষকরা যতটা নরেন্দ্র মোদিকে ধাক্কা দিয়েছেন, তার থেকে অনেক বেশি ধাক্কা দিয়েছেন সেই নাগরিক সমাজকে, যারা এতদিন ধরে কৃষি আইনের পক্ষে সওয়াল করেছে। কেন? কারণ, এই নাগরিক সমাজ হুজুগে ভেসে থাকে।
নাগরিক সমাজের সিংহভাগকে সস্তার ইন্টারনেট ডেটা উপহার দিয়ে রাষ্ট্র এবং কর্পোরেট প্রত্যেককে প্রাইভেট এক সমাজের বাসিন্দা করে দিয়েছে। একজনের সমাজ। একটি করে মোবাইল। অন্তহীন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। পোর্টাল। এভাবে রাস্তায় নেমে আন্দোলন অথবা জনস্বার্থে দলমতনির্বিশেষে আন্দোলনে শামিল হওয়া থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে ক্রমেই। যে কোনও প্রতিবাদে প্রথমেই ফেসবুক খুলে লিখতে ইচ্ছে করে! তাই এই সমাজের কাছে কখনও মিডিয়া ভিলেন। কখনও রাজনীতি ভিলেন। কখনও কর্পোরেট ভিলেন। মনোভাবটি খুব সহজ। আমি ভালো। অন্য সবাই খারাপ। আমাকে মিডিয়া, কর্পোরেট, রাজনীতি খারাপ করে দিচ্ছে। এই ধারণা থেকেই নাগরিক সমাজের বৃহৎ অংশ অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছে। আর তার ফলে গণ আন্দোলনের শক্তির মর্ম তারা বুঝতেই পারেনি।
কৃষকরা প্রথম থেকেই বুঝেছিলেন যে, কৃষি আইন নিয়ে সবথেকে বেশি কথা বলছে এই দেশে তারাই, যারা কৃষিটাই বোঝে না। কতটা মাটিতে কতটা সার, কতটা বীজে কতটা জমিতে ফসল হবে, এই দুরূহ সমীকরণের পিছনে যে এক নিবিড় অনুশীলন, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা আর অভিনিবেশ থাকে, সেটা ক’জন মনে রাখে? তাই নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক দল, আইন আদালত কারও উপর একান্ত ভরসা করে না থেকে কৃষকরা একটাই কাজ করে গিয়েছেন। দাঁত দাঁত চেপে রাস্তায় বসে থাকা। নাগরিক সমাজের সকলেই কি দূরে সরে থেকেছেন? একেবারেই নয়। লাগাতার কৃষকদের এই অনড় আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে বহু যুবক যুবতী মধ্যবয়সি এসে হাজির হয়েছেন আন্দোলনের তাঁবু ও মঞ্চের সামনে।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, কেন্দ্রীয় সরকার প্রথম প্রথম কৃষকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। যখন বৈঠক করেছে, তখন কৃষকদের সঙ্গে একসঙ্গে লাঞ্চ করার ছবি পোস্ট করা হয়েছে। কৃষি মন্ত্রী, বাণিজ্য মন্ত্রীরা সৌহার্দ্য দেখিয়েছেন। যাতে প্রমাণ হয়, তাঁরা কৃষকদরদি। কিন্তু তিন কৃষি আইনে সবথেকে লাভ হবে কর্পোরেটের। আর সেই কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে অনড় হয়ে রইলেন কৃষকরা। একদিন সেটা বুঝে গেল সরকার। আর তারপর থেকেই কৃষক দরদি মুখোশটা খুলে গেল। আধুনিক রাষ্ট্র কৃষক দরদি, শ্রমিক দরদি হতেই পারে না। তাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য সর্বদাই বিশ্ববাণিজ্যে প্রমাণ করা যে, এই রাষ্ট্র প্রাইভেটাইজেশনের পূজারি। আর সেটা করতে হলে সবার আগে কর্পোরেট এবং কৃষক-শ্রমিকের স্বার্থের মধ্যে যে কোনও একটি দিক বেছে নিতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকার প্রত্যাশিতভাবেই বেছে নিয়েছে কর্পোরেটের দিকটি। তাই দ্রুত কৃষকদের গায়ে তকমা দেওয়া হয়েছে অ্যান্টি ন্যাশনাল।
নরেন্দ্র মোদির বিরোধীদের কাছে একটাই সুসংবাদ যে, তিনি ইতিহাস চর্চা করেন না। যদি করতেন, তাহলে বহু পদক্ষেপ নেওয়ার আগে একবার ভারতের ইতিহাসের দিকে চোখ রাখতেন। খুব বেশি পরিশ্রমও করতে হতো না। কারণ তাঁর হাতের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস রয়েছে। তাঁর নিজের রাজ্যে। ১৯২৮ সালে গুজরাতের বরদোলিতে (তখন গুজরাত নামক রাজ্য ছিল না) প্রবল কৃষক আন্দোলন শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ সরকারের কালা কানুনের বিরুদ্ধে। কৃষকদের উপর প্রভূত অত্যাচার হয়। বিপুল ট্যাক্স আরোপ করা হয়। কারারুদ্ধ করা হয় আন্দোলনরতদের। কিন্তু কৃষকদের দমানো যায়নি। এবং কৃষকদের ওই লাগাতার বিদ্রোহ ও আন্দোলনের চাপে পিছু হটে ব্রিটিশ সরকার। ২২ শতাংশ করবৃদ্ধি কমিয়ে আনা হয় ৬ শতাংশে। জয় হয় কৃষকদের। ওই কৃষক সত্যাগ্রহের অন্যতম নেতা ছিলেন এক কৃষকসন্তান। তিনি ১৯৩১ সালে করাচিতে আয়োজিত ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আপ্লুত সেই নতুন কংগ্রেস সভাপতি ভাষণে বলেছিলেন, আজ আপনারা সামান্য এক কৃষকসন্তানকে ভারতের এই সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত করলেন। এ আমার কাছে বিরাট প্রাপ্তি। আমি নিশ্চিত যে এই সম্মান আসলে গুজরাতের কৃষকদের। এই নতুন সভাপতির নাম ছিল বল্লভভাই প্যাটেল। বরদোলি সত্যাগ্রহের নেতৃত্ব দেওয়ার সময় থেকেই তাঁকে অভিহিত করা হয়েছিল ‘সর্দার’ নামে। সর্দার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন সাধারণ মহিলাদের। যাঁরা খাদি পরে, চরকা কেটে, গান গেয়ে, প্রতিদিন রান্না করে, খাবার বিলি করে কৃষক আন্দোলনকে সজীব রেখেছেন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস।
ঠিক এই চিত্রই দেখা যায় ২০২০ থেকে ২০২১ সালের গত এক বছরে। কৃষক আন্দোলনে। এই এক বছরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাতবার বিদেশ সফরে গিয়েছেন। একবারও কৃষকদের আন্দোলনস্থলে আসেননি। এলে দেখতে পেতেন, ১৯২৮ সালের বরদোলি আন্দোলনেরই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে দিল্লির সীমান্তে। রাষ্ট্র যখন নিজের দেশের ইতিহাস ভুলে গিয়ে নিজের ঐতিহ্যকেই অস্বীকার করে, তখনই সেই রাষ্ট্রের আসে দুঃসময়। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল মোদিজির কাছে রোল মডেল। তাহলে তাঁর একটি অমোঘ বাক্য মোদি রাখলেন না কেন? সর্দার বলেছিলেন, ‘কৃষক প্রাণের সঞ্চার ঘটায়, গোটা বিশ্বের মুখে খাদ্য জোগায়। আর সবথেকে বেশি পীড়নের শিকার হয় এই কৃষকই। তাই কৃষকের শক্তিকে অবহেলা করা সবথেকে বড় ভুল শাসকের।’ মোদি একই ভুল করেছেন প্যাটেলের অনুগামী হয়েও।
আমরা সাধারণ নাগরিক সমাজ বিগত কয়েকমাস ধরে ক্রমেই আগ্রহ ও উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমরা আর অত বেশি বেশি আলোচনা করতাম না কৃষক আন্দোলন নিয়ে। তাঁরা যে এখনও ওই একইভাবে অহিংস আন্দোলনে বসে আছেন, এটা আমরা ধীরে ধীরে ভোট, দুর্গাপুজো, আইপিএলের স্রোতে ভুলেই যাচ্ছিলাম। কম কম আলোচনা হতো আজকাল। আচমকা জিতে গিয়ে আমাদের সজোরে ধাক্কা দিলেন কৃষকরা। আমরা হতচকিত হয়ে দেখলাম, আত্মবিশ্বাসী আন্দোলনের কী বিপুল শক্তি!
কৃষকরা জানতেন, এই লড়াই তাঁদের আগামীতে বাঁচার লড়াই। অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। তাই তাঁরা অনড় রইলেন। ভারতবর্ষকে আবার উদ্বুদ্ধ করে বার্তা দিলেন যে, যত বড় শক্তিশালীই হোক, কোনও শাসকই লার্জার দ্যান লাইফ নয়। কেউ সুপারম্যান নয়। কেউ অপরাজেয় নয়। জনগণমনঅধিনায়ক হতে হলে মাটিতে নামতে হবে। নামতে রাজি না হলে? বাধ্য করতে হবে। কৃষকরা পারলেন! তাঁরা আমাদের মতো সাধারণ মানুষকেও আজীবনের মন্ত্র দিলেন যে, ধৈর্য আর সহনশীলতা বজায় রেখে, কঠোর আত্মত্যাগেও লক্ষ্য অবিচল থাকলে, জয় একদিন আসবেই! আমাদের যেন ভরসা হল, আমরাও তাহলে জীবনের ছোট ছোট লড়াইগুলো জিততে পারি! হাল ছাড়তে নেই!