কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
যে লড়াই শিখিয়েছে শাসকের চোখে চোখ রাখতে। ভয়ডরহীন প্রশ্ন ছুড়তে। যে লড়াই আঙুল তুলেছে সদর্পে। চেয়েছে উত্তর। দিল্লিতে শীত নেমে এসেছে রাতে। গোটা দিনরাত জবুথবু বসে। সঙ্গে কম্বল। দু’চারটে মোটা জামা। আর ছিল ওম। মানুষের। সংগ্রামের। জেদের। কৃষক স্বার্থের পক্ষে হানিকর তিনটি কৃষি বিল সংসদে কার্যত জবরদস্তি করে পাশ করিয়ে মোদি সরকার যে অন্যায়ের সূচনা করেছিলেন, পরবর্তী প্রায় দেড় বছর তারা সেই ট্র্যাডিশন সমানে চালিয়ে গিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কয়েকশো কৃষকের মৃত্যুও তাঁদের মনোবল ভাঙতে পারেনি। গেরুয়া শিবির স্বভাবসিদ্ধ ছল, বল ও কৌশল প্রয়োগ করতে গিয়ে ক্রমাগত পর্যুদস্ত হয়েছে, প্রতিবাদী কৃষকদের তীক্ষ্ণ ও সচেতন প্রশ্নবাণ তাদের সমস্ত ষড়যন্ত্র ছিন্ন করেছে। নিশ্চিত এই সমবেত প্রতিস্পর্ধা ইতিহাসের পাতায় দৃষ্টান্ত হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ঠিক তার বিপরীতে, এবং তার সমান অনুপাতে, গভীর কলঙ্কের অক্ষরে লিখিত থাকবে মোদি সরকারের ভূমিকা। কৃষক আন্দোলনের মোকাবিলায় তাঁদের দম্ভ এবং নির্বুদ্ধিতা নিজেদের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে চুরমার করেছে।
নির্মম নিষ্ঠুরতার নিদর্শন, অথচ...
মোদি বাহিনী একটা বিষয়ে কৃষক আন্দোলনের মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ। তাঁরা কৃষকদের প্রতিবাদের ক্ষমতাকে বুঝতে পারেননি। কৃষকদের মনোবল, আন্দোলনের প্রতি তাঁদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানসিকতা, আত্মনিবেদনের দুর্মর আকাঙ্ক্ষা বোঝার ক্ষমতা মোদি সরকারের নেই। নিজেদের অহমিকা ও আত্মম্ভরিতা, দর্প ও আত্মবিশ্বাস এমন পর্যায়ে যে, তাঁরা ভাবতেই পারেন না যে তাঁদের শক্তির কাছে মাথা নোয়াতে অস্বীকার করার সমান আত্মবিশ্বাস কৃষকদেরও আছে। সরকারের উচিত ছিল, আন্দোলনকারী কৃষকদের ‘প্রতিপক্ষ’ হিসেবে না দেখে তাঁদের কথা শোনা। এটা তো জয়-পরাজয়ের লড়াই নয়, গণতান্ত্রিক মানসিকতার পরীক্ষা। গত সাত বছরে মোদি সরকারের চালকরা সেই পরীক্ষায় ডাহা ফেল। নিখাদ নিরঙ্কুশ অহমিকা মোদি সরকারের স্বধর্ম হয়ে উঠেছে।
আন্দোলন যখন শুরু হয়েছিল, তখন বলা হয়েছিল এই কৃষকরা ‘সন্ত্রাসবাদী’, এঁরা পাঞ্জাবের ধনী চাষি, জোতদার। বিজেপির সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজাররা দেখিয়েছিলেন, এই চাষিদের শিবিরে এসি মেশিন লাগানো, মার্সিডিজ ও বিএমডব্লিউ গাড়ি আসছে, ট্রাক্টরে করে বহু পাঞ্জাবি পরিবার দিল্লি সীমান্তে এসে পিকনিক করছে, অনেকে তো আরও একধাপ এগিয়ে বলেছিলেন— কানাডা থেকে খলিস্তানিরা টাকা পাঠাচ্ছে। মোদি দেখলেন, ধনী-জোতদার জাতীয় তকমা দিয়েও কৃষক আন্দোলন ভাঙা যায়নি। উল্টে পাঞ্জাব-হরিয়ানার ধনী কৃষকদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন গোটা দেশের ভাগচাষি, প্রান্তিক চাষিরা। দলের নেতা-মন্ত্রীরা যখন দেশের অন্নদাতাদের অপমানকর আখ্যা দিয়েছেন, তখন রাজধর্ম পালন করে তাঁদের শাসন না করে মোদিজি স্বয়ং ‘আন্দোলনজীবী’ বলে কৃষকদের ব্যঙ্গ করেছেন।
শুধু তাই-ই নয়, তাঁর সরকার প্রথম থেকেই শান্তিপূর্ণ কৃষকদের মিছিল, প্রতিবাদ সভা ও ধর্নাস্থলগুলির উপর প্রকাশ্যে ও গোপনে অন্তর্ঘাতমূলক দমন-পীড়ন চালিয়ে গিয়েছে। প্রথমে দিল্লিমুখী কৃষক মিছিলগুলিতে লাঠিচার্জ, প্রচণ্ড ঠান্ডায় অমানবিকভাবে যথেচ্ছ জলকামানের ব্যবহার। প্রধান জাতীয় ও রাজ্য সড়কগুলিতে সরকারি লোক নিযুক্ত করে আড়াআড়ি ভাবে দশ ফুট গভীর ও পাঁচ ফুট চওড়া পরিখার মতো গর্ত খুঁড়ে রাখা। এর পাশাপাশি দিল্লির চারটি সীমানা আটকে দেওয়া হয়েছে নৃশংস কাঁটাতারে। ভারী ভারী কংক্রিটের আড়াল। ৮ থেকে ১০ সারির লোহার খাঁচার ঝালাই করা দেওয়াল। এমনকী, সামনের রাস্তায় অজস্র প্রাণঘাতী ছুঁচলো লোহার শলাকা পুঁতে দেওয়া, যাতে কৃষকরা এগতে না পারে। সঙ্গে পানীয় জলের যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার মতো নির্মম নিষ্ঠুরতা। সর্বশেষ সংযোজন, লখিমপুরে আট চাষিকে হত্যা। সরকার ভেবেছিল ভয় দেখিয়ে জমায়েত ভাঙবে। না, ভাঙা যায়নি। যাকে ইংরেজিতে বলে ‘পয়েন্টস অব নো রিটার্নস’। কৃষক আন্দোলনকে সেই অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছে মোদি সরকারই।
ভারতের ইতিহাসের পাতায় জয়ী হতে চাওয়ার এমন শান্ত সুদৃঢ় প্রত্যয় আর কখনও কি এভাবে দেখেছে দেশবাসী? কৃষকজনতা বিস্ময়কর এক শান্ত জনসমুদ্র, সমস্ত উত্তাপকে ভিতরে সংহত করে বাইরে কী অদ্ভুত রকমের নিস্তরঙ্গ। যে পুলিস একটু আগেই তাদের উপর নির্মম লাঠিচার্জ করেছে, তাদেরই রাজপথে পাত পেড়ে খাইয়েছে হাসিমুখে। অহিংস কৃষকসংগ্রামের চেতনায় রাজপথে জন্ম নিয়েছে সভ্যতার নতুন ব্যাকরণ।
ভোট, বুঝলেন ভোট...
৫৬ ইঞ্চি ছাতি মোদির এইভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা যে গত সাত বছরে দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেনি, তা বলাই বাহুল্য। কৃষি আন্দোলন মোকাবিলায় গোড়া থেকেই যেরকম রণং দেহি মূর্তিতে সরকার ছিল, তাতে এইভাবে পিছু হটা যে দেশবাসীর কাছে বড় চমক, সে ব্যাপারেও কোনও সন্দেহ নেই। কেন সাত বছরে এই প্রথমবার মোদিকে পিছু হটতে হল, তার রাজনৈতিক ব্যাখ্যা বিভিন্ন মহলে শুরু হয়েছে। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর মতো খবরের কাগজ লিখেছে, হিন্দুত্ব-নির্ভর জাতীয়তাবাদের প্রভাব যে শিথিল হয়ে গিয়েছে, তা মোদির এই পিছু হটা থেকে স্পষ্ট। রাজনীতিতে যখন এইরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়, অর্থাৎ কোনও দলের প্রধান মতাদর্শটি ভোঁতা হয়ে যায়, তখন তা মেরামত করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে।
পশ্চিমবঙ্গ, কেরল ও তামিলনাড়ু বিধানসভা নির্বাচনে হিন্দুত্বের কার্ড খেলেও বিজেপি সুবিধা করতে পারেনি। সম্প্রতি রাজস্থান, হিমাচলপ্রদেশের উপনির্বাচনেও হিন্দুত্ব-নির্ভর প্রচার কোনও কাজই দেয়নি। ফলে ২০২২-এর গোড়ায় বিজেপির কাছে মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ উত্তরপ্রদেশে জয়। নিন্দুকেরা বলছেন, মানুষ যে মোদি সরকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন, তা মাত্র ছ’মাস আগের উত্তরপ্রদেশের পঞ্চায়েত ভোটের ফল থেকেই স্পষ্ট। গ্রামীণ উত্তর প্রদেশের তিন হাজার আসনের মধ্যে মোদির দল পেয়েছে কোনওরকমে হাজারের কাছাকাছি আসন। বিরোধীদের দাবি, প্রধানমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট আছে, কৃষক আন্দোলনের জেরে উত্তরপ্রদেশে আর ক্ষমতা ধরে রাখা যাবে না।
তাই দেশবাসীর উদ্দেশে নত মস্তকে ক্ষমা চেয়ে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করার ঘোষণা করেছেন। এটা ভোট-রাজনীতির দাওয়াই। পিছু হঠার রাজনৈতিক রণকৌশল। কে না জানে, একটি শাসকদল পিছু হটে তখনই, যখন সে বুঝতে পারে তার পায়ের তলার মাটি সরছে। পায়ের তলার মাটি একবার সরতে শুরু করলে কী হয় তা বাংলার মানুষ জানেন। সিঙ্গুরেও পিছু হটে নজির গড়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। রাজনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা, বুদ্ধবাবুর ওই পিছু হটা বামফ্রন্টের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতেছিল। বুদ্ধবাবু ডুবেছিলেন, সিঙ্গুরের মানুষের মতামত না নিয়েই জোরজবরদস্তি জমি অধিগ্রহণ করে। মোদির ক্ষেত্রেও তাই। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা ছাড়া কৃষিতে সংস্কারমূলক তিনটি আইন আনতে গিয়ে তিনিও ডুবেছেন।
না আঁচালে বিশ্বাস নেই...
এ দেশের মানুষ বিলক্ষণ জানেন, সব রত্নাকর বাল্মীকি হন না! মোদি তো নন-ই। কৃষি আইন প্রত্যাহারে মোদির নাটকে অভ্যস্ত পোড়খাওয়া কৃষক আন্দোলনের সচেতন নেতারা তাই স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, সংসদের দুই কক্ষে এই তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার না করলে তাঁরা আন্দোলন থেকে সরে আসবেন না। দাবি তো শুধু নয়া কৃষি আইন প্রত্যাহার নয়, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের গ্যারান্টি কোথায়? নয়া বিদ্যুৎ বিলের কী হবে? চার লক্ষ কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন। তা নয়া কৃষি আইনের জন্য নয়, ফসলের দাম না পেয়ে। স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য না পেলে কৃষক বাঁচবে না, সেইসঙ্গে অপঘাতে মৃত্যু হবে ভারতীয় কৃষিরও। তাই আন্দোলন চলবে। কৃষকরা প্রধানমন্ত্রী কথার ওপর ন্যূনতম আস্থা রাখতে নারাজ।
কেউ কেউ বলছেন, এটাই মোদির শেষের শুরু! ২০২০-র করোনা সংক্রামিত দুনিয়ায় মৃত্যুযাত্রার পাশাপাশি ভারত এক আশ্চর্য রকমের বাঁচার, বাঁচতে চাওয়ার ছবিও দেখছে, ছবিটা ২০২৪-এ আরও উজ্জ্বল হবে। নিশ্চিত। সেই ছবি জুড়ে কাস্তে। ট্র্যাক্টর। লাঙল। স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। কাঁধে কাঁধ। ব্যারিকেড। লড়াই। বিদ্রোহ। দিকে দিকে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ। শাশ্বত। ঐতিহাসিক...।
ওরা জিতবে, জয়ী হয়েই ফিরবে কৃষকভারত।