কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
জাতিসঙ্ঘ ব্যবস্থার একটি অংশ হল ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব মাইগ্রেশন (আইওএম) নামক সংস্থাটি। আইওএম প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫১ সালে। অভিবাসনের সঙ্গে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের সম্পর্ককে স্বীকৃতি দেয় আইওএম। পাশাপাশি স্বীকৃতি দেয় চলাচলের স্বাধীনতা ও অধিকারকে। আইওএম বলে যে, নির্দিষ্ট সীমানার অভ্যন্তরে এবং তার বাইরে—এই দুই অভিবাসনের কোনওটাই বন্ধ করা যাবে না। (ভারতের অভ্যন্তরে সাড়ে ৬ কোটি আন্তঃরাজ্য অভিবাসন হয়।) আমরা কেবল আইওএমের মতো কাজ করতে পারি, ‘অভিবাসনের সুশৃঙ্খল ও মানবিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে সাহায্য করার জন্য।’
লাখো লাখো মানুষের অভিবাসন
দেশান্তরের একটি কারণ হল দেশভাগ। আর একটা কারণ হল যুদ্ধ। ভারত এই দুটিরই সাক্ষী। ১৯৪৭ সালে ভারত খণ্ডিত হওয়ার কারণে মানব ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ ‘বলপূর্বক’ অভিবাসনের ঘটনা ঘটেছিল। অনুমান করা হয় যে, প্রায় ১ কোটি ৮০ লক্ষ নরনারীকে উদ্বাস্তু হতে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের আগে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের পরে ৮০-৯০ লক্ষ শরণার্থী ভারতে এসেছিল। সেই উদ্বাস্তুদের অধিকাংশ বসতি স্থাপন করেছে পশ্চিমবঙ্গে। আর একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় উদ্বাস্তুরা অসমে বসতি স্থাপন করেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে হিন্দু ও মুসলমান উভয়ই। একই সময়ে, লক্ষ লক্ষ মুসলমান ভারতে, হাজার হাজার হিন্দু ও শিখ পাকিস্তানে এবং বিপুল সংখ্যক হিন্দু বাংলাদেশে থেকে গিয়েছিল। তিনটি দেশের মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশ কঠোর পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেদেরেক ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করে।
বছরের পর বছর ধরে হিন্দু, মুসলিম ও শিখসহ লক্ষ লক্ষ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে চলে গিয়ে থিতু হয়। আমরা গর্বের সঙ্গে তাদের ভারতীয় বংশোদ্ভব বলি। দেশটি মূলত খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের হলেও, তারা কিন্তু একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে রয়েছে। একইভাবে ভারতীয় অভিবাসীরা অনেক ইউরোপীয় দেশ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে বসতি স্থাপন করেছে। তাদের মধ্যে কেউ যখন জাতিগত বা ধর্মীয় কুসংস্কারের শিকার হয়, স্বভাবতই ভারত সরকার উদ্বিগ্ন হয়, এটা তার আইনগত বাধ্যবাধকতা।
সংখ্যাগুরুর লক্ষ্য
২১ কোটি ৩০ লক্ষ মুসলমানের বাড়ি ভারতে, সেখানে তাদের পূবর্পুরুষরা থাকত। অনুরূপভাবে, ভারতভাগ বা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পর্বে ভারতে চলে যায়নি, এমন হিন্দুদেরও দেড় কোটি বংশধর বাংলাদেশে (১৬ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে) রয়ে গিয়েছে।
মুসলমানদের উভয় দল—ভারতীয় নাগরিকদের বংশধর এবং অভিবাসীরা ভারতে বসবাস করে। নানা সময়ে তারা ধর্মীয় কুসংস্কারের শিকার হয়। তবুও, মোদি সরকার তাদের রক্ষা করতে বা তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার নিন্দা করতে অস্বীকার করে। কোনও দেশ এই বিষয়ে প্রশ্ন তুললে মোদি সরকার তাদের ‘ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের’ বিরুদ্ধে সতর্ক করে দেয়। বাংলাদেশে হিন্দু নরনারী এবং হিন্দুদের উপাসনালয়ে হামলার ব্যাপারে ভারতের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অতি দ্রুত স্পষ্ট বক্তব্য এবং সে-দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি তাঁর কঠোর নির্দেশাবলি আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।
আরএসএসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জনক এম এস গোলওয়ালকর তাঁর বই ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড’-এ যে-কথা লিখে গিয়েছেন তা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই: ‘হিন্দু জাতি ও সংস্কৃতির গৌরব ভিন্ন মুসলমানদের অন্যকোনও ধারণা গ্রহণ করা উচিত নয়। এই দেশে তারা সম্পূর্ণরূপে হিন্দু জাতির অধীনস্থ হিসেবে থাকতে পারে, কিছুই দাবি করতে পারে না—এমনকী নাগরিকের অধিকারও নয়।’
আরএসএস/ বিজেপির বর্তমান নেতারা কি ওই দর্শন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছেন? অনুমান করা হয় যে তাঁরা তাই করেছেন, কিন্তু তাঁদের কথা
ও কাজের তফাত আমাদের সেই অনুমানকে
মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। প্রকৃতপক্ষে, মুসলমানদের উপর বাড়াবাড়ি নিয়ে তাঁদের নীরবতা আমাদের আরও কিছু বলে।
> একটি ধর্মনিরপেক্ষ জাতি কি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) মতো পরিষ্কার বৈষম্যমূলক একটি আইনকে সমর্থন করবে যা অন্যসকল ধর্মের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করে আর শুধু মুসলিমদের বাদ দেয়? কেউ কি জোর দিয়ে বলতে পারেন, সিএএ এবং হাজার হাজার তথাকথিত ‘বিদেশি’ আটকের হুমকি ব্যাপারটা বাংলাদেশে এবং অন্যত্র প্রভাব ফেলবে না?
> সাংস্কৃতিক বৈচিত্র রয়েছে যে জাতিটার সে কি গণপিটুনিতে পেহলু খানের হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করবে, যিনি রাজস্থানে তাঁর ছোট দুগ্ধ খামারের জন্য কয়েকটি গোরু নিয়ে যাচ্ছিলেন? অথবা, সমর্থন করবে কি আকলাকের ঘটনাটি—উত্তরপ্রদেশের এই মানুষটি তাঁর বাড়িতে গোমাংস রেখেছিলেন, শুধু এই সন্দেহেই তাঁকে পিটিয়ে মারা হয়েছিল?
> বহু ধর্মাবলম্বীর একটি দেশ কি লাভ জিহাদের সর্বনাশা তত্ত্বটি সহ্য করবে, যখন ভিন্ন ধর্মের দুই যুবক-যুবতী প্রেমে পড়বেন অথবা বিয়ে করতে চাইবেন?
> ইন্টার ফেইথ কাপল বা ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী এক দম্পতি স্বামীর ঘরে সুখে সংসার করছেন। তানিশক-এর মতো একটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনের এটাই ছিল প্রতিপাদ্য। একটি আধুনিক জাতি কি এই বিজ্ঞাপনটি প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য চাপ দেবে?
> একটি বহুভাষিক দেশ কি ফ্যাবিন্ডিয়ার মতো একটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের পোশাক চালু করার অনুষ্ঠানের উর্দু নামাঙ্কনকে কি অপরাধ হিসেবে নেবে—দু’সপ্তাহ পরবর্তী একটি হিন্দু উৎসবকে ইসলামিক রং দেওয়ার অভিযোগ এনে?
> মুজাফফরনগর এবং উত্তর-পূর্ব দিল্লির সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় অভিযুক্তদের তদন্ত ও বিচারের ক্ষেত্রে যে ফলাফল দেখা গেল, আইনের শাসনের উচ্চ প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র তা কি মেনে নেবে?
এখানেই বহুত্ববাদ
ভারতেরই কিছু লোক (সবাই নয়) যদি ভারতীয় মুসলিমদের কটূক্তি, গালাগালি, ক্ষতি, আঘাত, সন্ত্রাস বা হত্যা করার ব্যাপারে অজুহাত খুঁজে পায়, তবে অন্যান্য দেশে বসবাসকারী হিন্দু ও শিখরা কি কটূক্তি, গালাগালি, ক্ষতি, আঘাত, সন্ত্রাস ও হত্যার লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠবেন না? এই উপমহাদেশটি উত্তেজনাপ্রবণ। এমন একটি জায়গায় ‘ক্রিয়া’ এবং ‘প্রতিক্রিয়া’-কে কখনওই সেভাবে আলাদা করা সম্ভব নয়।
বহুত্ববাদ একটি বাস্তবতা। বিভিন্ন সংস্কৃতি, ধর্ম বিশ্বাস, ভাষা এবং আরও কিছু বিভিন্নতার অনুসারী মানুষের সঙ্গে বসবাস করা অবশ্যই শিখে নিতে হবে প্রতিটি দেশকে। গ্রহণযোগ্যতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাই একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারত এই ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
মনে হচ্ছে যে সহিষ্ণুতার জায়গা নিয়েছে সহিংসতা। এই জিনিস যেকোনও জায়গায়, যেকোনও সময় ঘৃণার যোগ্য। হিংসা শুধু হিংসারই জন্ম দেবে। চোখের বদলে চোখ উপড়ে নেওয়ার নীতি পুরো পৃথিবীটাকেই অন্ধ করে দেবে। নিজেকে প্রশ্ন করুন, এটি কে বলেছেন?
লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত